ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩, সোমবার : পৌষ ১৬, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
নতুন করে শিক্ষা নিয়ে ভাবুন
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেও দেশে যে ধরনের পরিস্থিতি দেখা
যাচ্ছে, তাতে
মনে হয় অস্থিতিশীল রাজনীতির উত্তাপ সহজে কমবে না। বরং দিন দিন তা আরও বাড়বে। এরই
মধ্যে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে চলেছে দেশ।
অন্যদিকে, নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধীদলীয় নেতৃত্বাধীন জোট বর্তমান
নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যক্রম বাতিল করে নতুনভাবে তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। এ
উদ্দেশ্যে তারা নবম সংসদ ভেঙে দেয়ারও দাবি উত্থাপন করেছে। নির্বাচন নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে প্রবাহিত হয় সেটাই দেখার
বিষয় হয়ে রইল।
এদিকে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি,
রাজনৈতিক কারণে
সৃষ্ট সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এরই মধ্যে একরকম
ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে; শিক্ষাকে এক ধরনের টেনে নিয়ে গেছে খাদের কিনারে। এ নিয়ে
আমরা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বহু আবেদন-নিবেদন করেছি,
একই কথা
বিভিন্নভাবে বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কার্যত আমাদের আবেদন-নিবেদন কোনো কাজে আসেনি। গণমাধ্যমও গুরুত্বের
সঙ্গে এসব বিষয় তুলে ধরেছে, তাতেও তেমন কোনো ফল দেখা যায়নি। বরং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের
পরিকল্পনা মতোই এগিয়ে চলেছে। অথচ ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের শিক্ষা
ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এবং তাতে শিক্ষার্থীদের কী ক্ষতি হচ্ছে,
সেদিকে কারও
কোনো ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না! রাজনৈতিক পরিস্থিতির সর্বশেষ ঘটনাবলী
পর্যবেক্ষণ করে আমাদের মনে এখন এমন ধারণার জন্ম হচ্ছে যে,
আগামী দিনগুলোতে
শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও মহাবিপদ! কারণ আমরা দেখলাম,
রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার কবলে পড়ে ২০১৩ সালের পুরো বছর
শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। রাজনৈতিক তাণ্ডবের মুখে বিপর্যস্ত হয়েছে শিক্ষা
ব্যবস্থা। প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা
বিঘ্নিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। উচ্চশিক্ষা স্তরে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে
অনিশ্চয়তা, দেখা দিয়েছে সংশয়। এখনও প্রায় ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি
পরীক্ষা স্থগিত হয়ে আছে। ২০১৪ সালের শুরুতেই যদি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে
না আসে তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আর বাঁচানো যাবে কিনা তাতে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। কারণ
এমনিতেই শিক্ষার যতটুকু ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে, এখন আগামী দিনগুলোতে যদি শিক্ষা
কার্যক্রম নিরাপদে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া না যায় তাহলে শিক্ষার্থীদের কপালে আরও
দুর্ভোগ আছে- এটা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়!
রাজনৈতিক কার্যক্রম কিভাবে চলবে তা রাজনীতিকদের ওপর নির্ভর
করলেও শিক্ষা কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে সেটা নিয়েও রাজনীতিকদের ভাবার প্রয়োজন
রয়েছে। কারণ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভর করে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির
ওপর। একইভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন নির্ভরশীল। যে
দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত বেশি স্থিতিশীল, সে দেশ তত বেশি উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা
করতে পারে। অথচ আমাদের দেশে উন্নয়নকামী মানুষরা শিক্ষা নিয়ে সৃষ্টিশীল চিন্তা করবে
কখন, তাদের
অধিকাংশের সময় কাটে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের হিসাব করতে। আমরা দেখছি,
বর্তমানে দেশে
শিক্ষা যেন কোনো গুরুত্বই পাচ্ছে না। বরং এক কথায় বলা যায়,
শিক্ষা সবচেয়ে
অবহেলিত খাত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে শিক্ষায় যতটুকু সফলতা অর্জিত
হয়েছিল তাও এখন মলিন হতে চলেছে। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব যেমন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, তেমনি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দায়িত্বও
রাজনৈতিক নেতৃত্ব এড়াতে পারে না। বরং শিক্ষাসহ সব খাতের নিরাপদ পরিচালনা নির্ভর
করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। দেশে যদি সারা বছর রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি
বিরাজ করে তাহলে কোনো কার্যক্রমই স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। মোটা
দাগে কথা হল, রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে সব ধরনের কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে,
বিঘ্নিত হয়
উন্নয়ন কার্যক্রম। শিক্ষা এমন একটি খাত যে খাতের স্বাভাবিক বিকাশ এবং সুষ্ঠু
পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অথচ এটাই আমাদের দেশে
সম্ভব হয়নি আজও। শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় মূল্যবোধ সুসংগঠিত হয়, মানুষের মধ্যে নীতি ও নৈতিকতাবোধ
জাগ্রত হয়, পারস্পরিক সহনশীলতা ও সহমর্মিতাবোধ গড়ে ওঠে।
শিক্ষা মানুষকে নিরাপদ রাখে এবং জাতিকে আলোর পথ দেখায়। মানুষকে ভালোভাবে বাঁচিয়েও
রাখে শিক্ষা। শিক্ষাই মানুষকে উন্নত জীবনের পথে টেনে নিয়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে
সমৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব করে তুলে শিক্ষা। অথচ আমাদের শিক্ষা এখন অন্যকে বাঁচাবে
দূরের কথা শিক্ষা নিজেই যেন এখন গভীর অন্ধকারের দিকে ধাবমান! এসব ঘটছে শুধু
শিক্ষাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে। শিক্ষাকে নিরাপদ রেখে যদি রাজনৈতিক কর্মকা-
পরিচালিত হতো তাহলে ভালো থাকত দেশের মানুষ। বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, আজ আমাদের অনেকের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে আশংকাজনকভাবে,
ন্যায়-নীতি ও নৈতিকতাবোধ হ্রাস পাচ্ছে, কমছে
সহনশীল আচরণ ও সহমর্মিতা দেখানোর গুণাবলি। এখন আর আগের মতো মানবতাবোধ প্রকাশ হতে
দেখা যায় না। তাহলে কোথায় শিক্ষার প্রভাব?
সামনে এগিয়ে আসছে ২০১৪ সাল। নতুন বছরটা কেমন যাবে সেটা
এরই মধ্যে কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। তবুও আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা আবারও আবেদন
জানাব, শিক্ষা ব্যবস্থা
নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিন। আশা করি, আমাদের
রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন
আনবেন এমনভাবে যাতে শিক্ষা তার কাক্সিক্ষত পথে নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে স্বাভাবিক
গতিতে। আমরা বলব, নতুন বছরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন
কিছু ভাবুন, সেই সঙ্গে শিক্ষা নিয়েও ভাবুন নতুন করে।
তাহলেই এ জাতি পাবে আলোর দিশা। তা না হলে আমরা কেবল পেছনের দিকেই যেতে থাকব। আর
অন্য দেশগুলো এগিয়ে যাবে সামনের দিকে তরতর করে উন্নয়নের পথে।
মোঃ মুজিবুর রহমান
:সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
http://www.jugantor.com/window/2013/12/30/54379
No comments:
Post a Comment