Monday, December 9, 2013

শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়



সোমবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৩
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়
মো. মুজিবুর রহমান | তারিখ: ০৯-১২-২০১৩
দেশে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত বিভিন্ন কোর্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। স্কুলপর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষার তারিখও পরিবর্তন করতে হচ্ছে। বিভিন্ন পরীক্ষা স্থগিতের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, দেশে এখন শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিতের হিড়িক পড়ে গেছে। স্কুলগুলো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস থাকছে বন্ধ। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোথাও নিয়মিত পাঠদান করতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা এক রকম স্থবির হয়ে আছে। বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ধরনের অস্থিরতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এভাবে অস্থির পরিবেশের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে পড়ালেখা করতে পারে না; এগিয়ে যেতে পারে না দেশ। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
এইচএসসি পরীক্ষা পাসের পর উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রবেশের লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের ঠেলে দিয়েছে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। তারা এখন উদ্বেগের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। তাদের অভিভাবকরাও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের ছয় মাস হতে চললেও শিক্ষার্থীরা উপর্যুপরি হরতাল ও অবরোধের কারণে এখনো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারেনি। ফলে তাদের পরবর্তী শিক্ষায় সেশনজটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় তারা কীভাবে সেশনজটমুক্ত উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রবেশ করবে, সেটা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।
রাজনৈতিক কারণে শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাওয়ার উদাহরণ খুব বেশি নেই। উন্নত দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও তেমন একটা দেখা যায় না। তবে সেসব দেশে রাজনৈতিক টানাপড়েন যে একেবারে হয় না, তা নয়। মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে যতটুকু টানাপড়েন সৃষ্টি হতে দেখা যায়, সেটা হয় খুব স্বল্প সময়ের জন্য। অথচ আমাদের দেশে এমনটি ঘটছে বারবার এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য। এটাই আমাদের আক্ষেপ। স্বাধীনতা অর্জনের চার দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রত্যাশিতভাবে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি তখনো। দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা প্রচুর। গণতান্ত্রিক দেশে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা থাকাটাই স্বাভাবিক। নানা ইস্যুতে ভিন্ন মত থাকবে, এটাও সত্য। নির্বাচন নিয়েও থাকতে পারে নানামুখী অবস্থান। তাই বলে কি জাতীয় ইস্যুতে একমত হওয়া যাবে না কখনই? কেন দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে অচলাবস্থা বিরাজ করবে? কেন অস্থিতিশীল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবে শিক্ষাব্যবস্থা পর্যুদস্ত হবে? শিক্ষাক্ষেত্রে যে ধরনের লাগাতার স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, এর শিকার কেন হতে হবে নিরীহ শিক্ষার্থীদের?
এখন বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা কার্যক্রমসহ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। শিক্ষার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষার অর্থনৈতিক মূল্য অনেক বেশি। শিক্ষাই একমাত্র উপাদান, যা অন্য সব উন্নয়নের মূল ভিত্তি ও চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। যে জাতি শিক্ষাক্ষেত্রে যত বেশি এগিয়ে রয়েছে, সে জাতি তত বেশি উন্নত; আর্থিকভাবেও তারা হয়ে ওঠে শক্তিশালী। জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণায় এগিয়ে থাকতে হলেও দরকার শিক্ষা। কাজেই শিক্ষাকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের কথা চিন্তা করা যায় না। শিক্ষার ভবিষ্যৎ ক্ষতির কথা না হয় বাদই দিলাম। অস্থির রাজনীতির কবলে পড়ে প্রতিদিন আমাদের কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব করা কি জরুরি নয়? আর্থিক ক্ষতি হয়তো একসময় কোনো না কোনোভাবে পুষিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু শিক্ষার যে ক্ষতি হচ্ছে, তা কোনো দিন পূরণ করা সম্ভব হবে কি? আমাদের ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যকোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? আজ যে শিক্ষার্থীরা স্কুলে পড়ছে, যারা স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠেছে এবং যারা বিশ্ববিদ্যালয়মুখী, তাদের জন্য শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করতে না পারার কী জবাব দেয়া যাবে?
এখানে জোর দিয়ে বলা দরকার, রাজনীতির ওপর দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করলেও এটি একমাত্র নিয়ামক নয়, যার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব। বরং রাজনীতির পাশাপাশি আরো অনেক সূচক রয়েছে, যেগুলোর উপযুক্ত প্রয়োগ ও অনুশীলন জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো সূচক এতটাই অপরিহার্য যে, সেগুলো ছাড়া উন্নয়নের কথা চিন্তাই করা যায় না। এ রকম একটি সূচক হলো শিক্ষা। বিশ্বে যত রকমের উন্নতির কথা বলা হোক না কেন, শিক্ষাকে উপেক্ষা করে তা কখনই অর্জন সম্ভব নয়। আমাদের হতাশ হয়ে দেখতে হয়, অন্যান্য দেশ রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। আর আমরা অস্থিতিশীল রাজনীতির ফাঁদে পড়ে থেমে আছি মাঝপথে। হরতাল ও অবরোধের কারণে প্রতিনিয়ত দেশের শতকোটি টাকার ক্ষতি হতে দেখছি। এখন সাধারণ মানুষ নিরাপদে পথ চলতে পারছে না। অসুস্থ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে। শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে। যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্থবির হয়ে আছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।
রাজনীতি করবেন রাজনীতিকরা এটাই স্বাভাবিকজাতীয় রাজনীতির প্রকৃতি ও গতিধারা ঠিক করবেন তারাই। রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও রাজনীতিকদেরদেশের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার দায়িত্বও তাদের ওপরই বর্তায়। আশা করব, দেশের স্বার্থে এবং আমাদের আগামী প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে অন্তত শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক ও নির্বিঘ্ন রাখার কর্মকৌশল প্রণয়ন করবে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন নিয়ে দেশে দীর্ঘদিন ধরে অচলাবস্থা বিদ্যমান থাকবে এটা কাম্য নয়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment