সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৩, পৌষ ৯, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
(উপ-সম্পাদকীয়)
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে
আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়ম
মো.
মুজিবুর রহমান | তারিখ: ২৩-১২-২০১৩
এক-দুই কোটি টাকা নয়, ৬৫০ কোটি
টাকার দুর্নীতির অভিযোগ! তাও আবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে! এমনটিই
জানা গেছে ৩ ডিসেম্বর দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনে
উল্লেখ করা হয়েছে, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভিসির বিরুদ্ধে উত্থাপিত
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি এবং মালয়েশিয়ায় ৩ কোটি টাকা
পাচারের অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা
মন্ত্রণালয়। যুগান্তরের প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির দুর্নীতি নিয়ে
ইতোপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তদন্ত করে। এর বাইরে ওই
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডও অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে ভিসির বিরুদ্ধে ৬৫০
কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য পায়। উত্থাপিত অভিযোগটি সত্য নাকি মিথ্যা, সেটা নিশ্চয়ই
দুদকের তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে। অবশ্য তা দেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে
হবে। তবে আমরা বুঝতে পারি না, দেশে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন এবং দুর্নীতির
বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃঢ় অবস্থান থাকার পরও কীভাবে দুর্নীতি করার সাহস
হয়?
প্রসঙ্গত,
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়, সেটা নিয়ে কিছুটা
আলোচনা করা দরকার। আমাদের দেশে শিক্ষা বিকাশের প্রচেষ্টা পর্যালোচনা করলে দেখা
যায়, আগে শিক্ষা ব্যবস্থার নিচের স্তরে বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন
করা হতো। তাও সেটা করা হতো খুব সীমিত আকারে। যেসব এলাকায় কোনো স্কুল থাকত না, সেসব
এলাকায় বিদ্যোত্সাহী ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে আসতেন। কেউ কেউ নিজস্ব জমিও দান করতেন
প্রতিষ্ঠানের নামে। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য থাকত এলাকার
শিশুদের পড়ালেখার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে
আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়—এমন
চিন্তাও তখনকার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে থাকত না। কিন্তু এখন যুগের পরিবর্তন হয়েছে।
আজকাল একইভাবে বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন অব্যাহত থাকলেও এসবের
অধিকাংশের পেছনে থাকে ব্যবসায়িক মনোভাব। স্কুলের পেছনে টাকা বিনিয়োগ করে কীভাবে তা
অধিক হারে তুলে আনা যায়, সেই চেষ্টা থাকে অনেক উদ্যোক্তার মধ্যে। স্কুল স্থাপন করে
যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে ডোনেশনের
নামে আদায় করা হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। এভাবে আদায় করা টাকা স্কুলের উন্নয়নে ব্যয়
অথবা স্কুল ফান্ডে জমা করার পরিবর্তে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের
মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে টাকার
বিনিময়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। পরে নানামুখী
প্রচেষ্টা চালিয়ে, কখনো রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে এসব ব্যক্তির নামে সরকারি
বেতনের অংশ বরাদ্দের অনুমতিপত্রও সংগ্রহ করা হয়। সেখানেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
কাজেই এ প্রক্রিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। ফলে দেখা যায়,
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের শুরুতেই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। এখানে বণিক বার্তার
পাঠকদের বলে রাখা ভালো, সরকারিভাবে চালু বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন
কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে নিবন্ধন পদ্ধতিও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম পুরোপুরি দূর করতে পারছে না।
এভাবে
অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ যখন বেশ লাভজনক বলে প্রমাণ
হয়ে গেল, তখন ধীরে ধীরে শুরু হলো বেসরকারি প্রচেষ্টায় উচ্চ শিক্ষা স্তরে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের হিড়িক। প্রায় ১৫-২০ বছর আগ থেকেই শুরু হয়েছে বেসরকারি
পর্যায়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ স্থাপন। এখন দেশে টেকনিক্যাল
এডুকেশনের প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা বেসরকারি উদ্যোগে
স্থাপিত হয়নি। বাস্তবে এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের
সুযোগ সৃষ্টি হলেও শিক্ষার মান বজায় থাকছে কিনা, সেটা দেখার কেউ নেই বলেই মনে হয়।
একই
প্রক্রিয়ায় দেশে স্থাপিত হচ্ছে বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়। দেখা যায়, এসব
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের অনেকেই একসময় জড়িয়ে পড়েন বেআইনিভাবে ও অনিয়মের
মাধ্যমে অর্থ রোজগারে। ফলে দুর্নীতি ঘটে ব্যাপকভাবে। যেভাবে দেশে একের পর এক
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে, তাতে শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—সেটা ভেবে শঙ্কিত হতে হয় বৈকি। অথচ আমরা ভেবে পাই না, দেশে এত
বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও কেন বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের টেনে আনা যাচ্ছে না? কেন
আমাদের ছাত্রছাত্রীরা উন্নত শিক্ষার খোজে এখনো বিদেশগামী?
নির্দ্বিধায়
বলা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মূল
উদ্দেশ্য থাকে অর্থ কামানো। এভাবে অর্থ উপার্জন করায় কোনো ঝুঁকি নেই। শিক্ষা খাতে
বিনিয়োগ অনেকটাই নিরাপদ। এ বিনিয়োগ থেকে লাভ উঠে আসে দ্রুত, তাও বহুগুণে। ফলে
অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে অনেক সময়
আর্থিক কারণে মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতেও দেখা যায়। আবার কখনো কখনো
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও হয়। ফলে কার্যত বিঘ্ন ঘটে
পড়ালেখায়। কিন্তু এদিকে মালিকপক্ষের তেমন একটা খেয়াল থাকে না বললেই চলে। তারা
ব্যস্ত থাকেন অর্থ নিয়ে।
আমরা
জানি, আমাদের দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম এবং
যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেগুলোয় আসন সংখ্যাও সীমিত। ফলে উচ্চ শিক্ষা
পর্যায়ে ভর্তি উপযোগী শিক্ষার্থীরা অনন্যোপায় হয়ে ধাবিত হয় বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থপতিরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে
উচ্চহারে ভর্তি ফিসহ নানা খাতে বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় করেন। অবিশ্বাস্য হলেও
সত্য, এখন কোনো কোনো বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শুধু ভর্তি হতেই লাগে ১৫ থেকে ২০ লাখ
টাকা! এর বাইরে প্রতি মাসে ৫-৭ হাজার টাকা টিউশন ফিসহ বিভিন্ন খাতে অর্থ দিতে হয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে উচ্চহারে ভর্তি ফি।
আদায়কৃত টাকার বেশির ভাগ অংশই তসরুফ করার অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং সরকারের উচিত হবে,
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেয়ার আগে কঠিন নিয়ম অনুসরণে
মালিকদের বাধ্য করা। একই সঙ্গে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কী কী খাতে কী পরিমাণ অর্থ
আদায় করতে পারবে, তাও নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন
সংখ্যাও নির্ধারণ করতে হবে সরকারকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভিসি একটানা
সর্বোচ্চ কত বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সেটাও স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে। নিজ
উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করায় একজন ব্যক্তি আজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি
থাকবেন—এটা সমর্থন করা যায় না।
আমরা চাই না গুটিকয়েক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের
পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবমূর্তি সংকটে পড়ুক।
আলোচ্য
এশিয়ান ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। এ অভিযোগের
পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান
বর্জন করেছিলেন। পরে এ ঘটনা নিয়ে তদন্তও হয়েছিল। ইউজিসি তদন্ত করে দুবার। কিন্তু
এর পর কী ঘটল, সেটা আর আমরা জানতে পারিনি। এবার শুধু শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে
এটুকু জানা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গভীর পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
এ পর্যবেক্ষণ কত দিন ধরে চলবে, সেটা স্পষ্ট করা দরকার। একই সঙ্গে দেশের অন্য
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কী ঘটছে, সেটাও অনুসন্ধান করা জরুরি। কারণ ভেতরে
ভেতরে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে না, তার
নিশ্চয়তা কী?
লেখক:
সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.comhttp://www.bonikbarta.com/sub-editorial/2013/12/23/26544
No comments:
Post a Comment