Monday, December 30, 2013

নতুন করে শিক্ষা নিয়ে ভাবুন



ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩, সোমবার : পৌষ ১৬, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
নতুন করে শিক্ষা নিয়ে ভাবুন
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেও দেশে যে ধরনের পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় অস্থিতিশীল রাজনীতির উত্তাপ সহজে কমবে না। বরং দিন দিন তা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে চলেছে দেশ। অন্যদিকে, নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধীদলীয় নেতৃত্বাধীন জোট বর্তমান নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যক্রম বাতিল করে নতুনভাবে তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে তারা নবম সংসদ ভেঙে দেয়ারও দাবি উত্থাপন করেছে। নির্বাচন নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে প্রবাহিত হয় সেটাই দেখার বিষয় হয়ে রইল।
এদিকে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি, রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এরই মধ্যে একরকম ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে; শিক্ষাকে এক ধরনের টেনে নিয়ে গেছে খাদের কিনারে। এ নিয়ে আমরা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বহু আবেদন-নিবেদন করেছি, একই কথা বিভিন্নভাবে বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কার্যত আমাদের আবেদন-নিবেদন কোনো কাজে আসেনি। গণমাধ্যমও গুরুত্বের সঙ্গে এসব বিষয় তুলে ধরেছে, তাতেও তেমন কোনো ফল দেখা যায়নি। বরং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পরিকল্পনা মতোই এগিয়ে চলেছে। অথচ ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এবং তাতে শিক্ষার্থীদের কী ক্ষতি হচ্ছে, সেদিকে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না! রাজনৈতিক পরিস্থিতির সর্বশেষ ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে আমাদের মনে এখন এমন ধারণার জন্ম হচ্ছে যে, আগামী দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও মহাবিপদ! কারণ আমরা দেখলাম, রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার কবলে পড়ে ২০১৩ সালের পুরো বছর শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। রাজনৈতিক তাণ্ডবের মুখে বিপর্যস্ত হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা বিঘ্নিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। উচ্চশিক্ষা স্তরে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা, দেখা দিয়েছে সংশয়। এখনও প্রায় ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে আছে। ২০১৪ সালের শুরুতেই যদি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে না আসে তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আর বাঁচানো যাবে কিনা তাতে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। কারণ এমনিতেই শিক্ষার যতটুকু ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে, এখন আগামী দিনগুলোতে যদি শিক্ষা কার্যক্রম নিরাপদে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া না যায় তাহলে শিক্ষার্থীদের কপালে আরও দুর্ভোগ আছে- এটা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়!
রাজনৈতিক কার্যক্রম কিভাবে চলবে তা রাজনীতিকদের ওপর নির্ভর করলেও শিক্ষা কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে সেটা নিয়েও রাজনীতিকদের ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভর করে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। একইভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন নির্ভরশীল। যে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যত বেশি স্থিতিশীল, সে দেশ তত বেশি উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারে। অথচ আমাদের দেশে উন্নয়নকামী মানুষরা শিক্ষা নিয়ে সৃষ্টিশীল চিন্তা করবে কখন, তাদের অধিকাংশের সময় কাটে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের হিসাব করতে। আমরা দেখছি, বর্তমানে দেশে শিক্ষা যেন কোনো গুরুত্বই পাচ্ছে না। বরং এক কথায় বলা যায়, শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত খাত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে শিক্ষায় যতটুকু সফলতা অর্জিত হয়েছিল তাও এখন মলিন হতে চলেছে। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, তেমনি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দায়িত্বও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এড়াতে পারে না। বরং শিক্ষাসহ সব খাতের নিরাপদ পরিচালনা নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। দেশে যদি সারা বছর রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে তাহলে কোনো কার্যক্রমই স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। মোটা দাগে কথা হল, রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে সব ধরনের কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে, বিঘ্নিত হয় উন্নয়ন কার্যক্রম। শিক্ষা এমন একটি খাত যে খাতের স্বাভাবিক বিকাশ এবং সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অথচ এটাই আমাদের দেশে সম্ভব হয়নি আজও। শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় মূল্যবোধ সুসংগঠিত হয়, মানুষের মধ্যে নীতি ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হয়, পারস্পরিক সহনশীলতা ও সহমর্মিতাবোধ গড়ে ওঠে। শিক্ষা মানুষকে নিরাপদ রাখে এবং জাতিকে আলোর পথ দেখায়। মানুষকে ভালোভাবে বাঁচিয়েও রাখে শিক্ষা। শিক্ষাই মানুষকে উন্নত জীবনের পথে টেনে নিয়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জনও সম্ভব করে তুলে শিক্ষা। অথচ আমাদের শিক্ষা এখন অন্যকে বাঁচাবে দূরের কথা শিক্ষা নিজেই যেন এখন গভীর অন্ধকারের দিকে ধাবমান! এসব ঘটছে শুধু শিক্ষাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে। শিক্ষাকে নিরাপদ রেখে যদি রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হতো তাহলে ভালো থাকত দেশের মানুষ। বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, আজ আমাদের অনেকের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে আশংকাজনকভাবে, ন্যায়-নীতি ও নৈতিকতাবোধ হ্রাস পাচ্ছে, কমছে সহনশীল আচরণ ও সহমর্মিতা দেখানোর গুণাবলি। এখন আর আগের মতো মানবতাবোধ প্রকাশ হতে দেখা যায় না। তাহলে কোথায় শিক্ষার প্রভাব?
সামনে এগিয়ে আসছে ২০১৪ সাল। নতুন বছরটা কেমন যাবে সেটা এরই মধ্যে কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। তবুও আমরা আশাবাদী হতে চাই। আমরা আবারও আবেদন জানাব, শিক্ষা ব্যবস্থা নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিন। আশা করি, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন আনবেন এমনভাবে যাতে শিক্ষা তার কাক্সিক্ষত পথে নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে স্বাভাবিক গতিতে। আমরা বলব, নতুন বছরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন কিছু ভাবুন, সেই সঙ্গে শিক্ষা নিয়েও ভাবুন নতুন করে। তাহলেই এ জাতি পাবে আলোর দিশা। তা না হলে আমরা কেবল পেছনের দিকেই যেতে থাকব। আর অন্য দেশগুলো এগিয়ে যাবে সামনের দিকে তরতর করে উন্নয়নের পথে।
মোঃ মুজিবুর রহমান :সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
http://www.jugantor.com/window/2013/12/30/54379


Wednesday, December 25, 2013

কমছে কর্মদক্ষতা!



ঢাকা, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩, ১১ পৌষ ১৪২০, ২১ সফর ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়) 
কমছে কর্মদক্ষতা!
মো. মুজিবুর রহমান
দেশে এখন দীর্ঘদিন ধরে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এটা আরম্ভ হয়েছে এ বছরের গোড়া থেকে। হরতালের কারণে ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল ২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষা। তখন অনেকগুলো বিষয়ের পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখ পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। একইভাবে এইচএসসি পরীক্ষাও বিঘ্নের মুখে পড়েছিল। চলতি বছরের অনেকটা সময় কেটেছে বড় বড় হরতালের মধ্য দিয়ে। ফলে পুরো বছর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও নিয়মিত ক্লাস হতে পারেনি। এমনকি পরীক্ষাও নেয়া যায়নি নির্দিষ্ট সময়ে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সময় কেটেছে একপ্রকার অলসভাবে। আর অভিভাবকরা ছিলেন উদ্বিগ্ন। তবে তাদের উদ্বেগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। কারণ একই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে বছরের শেষ সময়ে এসেও। আগে যেমন হরতাল থাকত দিনের পর দিন। এখন থাকছে অবরোধ কর্মসূচি!
ডিসেম্বর মাস প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আশা ছিল, এ মাসের শেষ সপ্তাহে হলেও রাজনৈতিক কর্মসূচি কিছুটা শিথিল থাকবে এবং এ সময়ের মধ্যেই স্কুলগুলোয় অসমাপ্ত পরীক্ষা শেষ করা যাবে। অনন্যোপায় হয়ে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুক্রবারেও পরীক্ষা নেয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য ছুটির দিন বলতে আর কিছু রইল না। কিন্তু এখন সরকারি ছুটির দিন শুক্রবারের আগে ও পরে অবরোধ আহ্বান করায় শিক্ষার্থীরা পড়েছে চরম বিপাকে। তারা এমনিতেই হতাশা ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। চতুর্থ বারের মতো ডাকা অবরোধ কর্মসূচি ডিসেম্বরের ২০ তারিখ সকালে শেষ হওয়ার পর মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ২১ ডিসেম্বর পঞ্চম দফায় তা আরম্ভ হওয়ায় সবার মনে আতঙ্ক আরও বেড়েছে সন্দেহ নেই। সরকার চেষ্টা করছে বিভিন্নভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার। অনেকের ধারণা, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বহাল থাকবে আগামী নির্বাচনের দিন পর্যন্ত। অবশ্য কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, যেহেতু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে এখনও সমঝোতা হয়নি সে কারণে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আরও দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাদের মতে, এ ধারা বহাল থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না বড় দুই দলের মধ্যে কার্যকর বৈঠক এবং সহনশীলতার মাধ্যমে কোনো চূড়ান্ত আপসরফা হবে। অথচ বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পরিষ্কারভাবে ধারণা পাওয়া যায়, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আপাতত উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। এখন শোনা যাচ্ছে, যতদিন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে জটিলতার অবসান না হবে ততদিন পর্যন্ত লাগাতার হরতাল-অবরোধ চলবে। এমনকি প্রয়োজনে ছুটির দিনগুলোতেও চলবে রাজনৈতিক কর্মসূচি!
রাজনৈতিক অঙ্গনে যা কিছুই ঘটুক না কেন সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার ভার রাজনীতিকদের ওপরই রইল। কিন্তু আমরা ভাবছি, রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট জটিলতার কারণে দেশের কর্মক্ষম মানুষের কর্মদক্ষতা কমে যাওয়া নিয়ে। কারণ দীর্ঘদিন যদি কোনো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে তাহলে মানুষের কর্মদক্ষতা কমে যায়এটা নতুন করে আর বলার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জনগণের মনোবল ভেঙে যায়, নাগরিকদের মধ্যে দেখা দেয় হতাশা, সৃষ্টি হয় বিষণ্নতার, ভেতরে ভেতরে ক্ষোভেরও জন্ম হয়। ফলে কর্মস্পৃহা হ্রাস পেতে থাকে।
প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির ফলে মানুষের কর্মদক্ষতা কমার কারণ কী? এটা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কর্মজীবী মানুষেরা যদি নিরাপদে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করতে না পারেন এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করার সুযোগ না পান তাহলে তাদের মনোজগতে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তন এমনভাবে ঘটে যা নিয়ন্ত্রণ করা তখন ব্যক্তির পক্ষে অনেকটা দুরূহ হয়ে ওঠে। বাস্তব জগতে যেসব পরিবর্তন ঘটে সেগুলো যদি প্রত্যাশিত ও ইতিবাচক হয় তাহলে মানুষের অবচেতন মন সচেতনভাবেই সেগুলো সহজে গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। কিন্তু ঘটনা প্রবাহ যদি অনাকাঙ্ক্ষিত হয় তাহলে তা একইভাবে মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। আর সাধারণভাবে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের চেয়ে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রভাব দ্রুত পড়তে আরম্ভ করে। এ অবস্থায় মানুষের কর্মদক্ষতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কর্মদক্ষতা কমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। এটা কাজকর্মে স্থবিরতাও সৃষ্টি করে। অস্থিতিশীল ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশের কারণে কাজের গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন। কখনও কখনও সম্পাদিত কাজের পরিমাণ কমে যায়, এমনকি যতটুকু কাজ সম্পন্ন হয় সেটাও হয় নিম্নমানের। আর্থিকভাবেও নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুধু কর্মক্ষম ব্যক্তির ওপর নয়, বরং তার পরিবারের সদস্যদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ফলে পরিবারে দেখা দেয় অশান্তি। পারিবারিক অশান্তি মানুষকে সহজেই অস্থির করে তোলে। আর অস্থির আচরণ মানুষের মধ্যে কর্মদক্ষতার কোনো কিছুই অবশিষ্ট রাখে না। কাজেই স্পষ্টভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর দেশের মানুষের কর্মদক্ষতার উন্নয়ন নির্ভরশীল।
একইভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনও নির্ভর করে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর। দেশে যদি শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি না থাকে তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিখনবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এর ফলে শিক্ষার্থীরা জীবনের জন্য দরকারি দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এবার দেখা যায়, প্রায় সারা বছর শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটেছে। ফলে পাঠ্য বিষয়ে বর্ণিত যেসব দক্ষতা অর্জন করা তাদের জন্য জরুরি ছিল তারা সে সবের কিছুই আয়ত্ত করতে পারেনি। এটিও অদক্ষ জনবল তৈরির অন্যতম কারণ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMTJfMjVfMTNfMV81XzFfOTU5NjY=

Monday, December 23, 2013

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়ম



সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৩, পৌষ ৯, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়ম
মো. মুজিবুর রহমান | তারিখ: ২৩-১২-২০১৩
এক-দুই কোটি টাকা নয়, ৬৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ! তাও আবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে! এমনটিই জানা গেছে ৩ ডিসেম্বর দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভিসির বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি এবং মালয়েশিয়ায় ৩ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যুগান্তরের প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির দুর্নীতি নিয়ে ইতোপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তদন্ত করে। এর বাইরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডও অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে ভিসির বিরুদ্ধে ৬৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য পায়। উত্থাপিত অভিযোগটি সত্য নাকি মিথ্যা, সেটা নিশ্চয়ই দুদকের তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে। অবশ্য তা দেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমরা বুঝতে পারি না, দেশে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃঢ় অবস্থান থাকার পরও কীভাবে দুর্নীতি করার সাহস হয়?
প্রসঙ্গত, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়, সেটা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা দরকার। আমাদের দেশে শিক্ষা বিকাশের প্রচেষ্টা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগে শিক্ষা ব্যবস্থার নিচের স্তরে বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হতো। তাও সেটা করা হতো খুব সীমিত আকারে। যেসব এলাকায় কোনো স্কুল থাকত না, সেসব এলাকায় বিদ্যোত্সাহী ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে আসতেন। কেউ কেউ নিজস্ব জমিও দান করতেন প্রতিষ্ঠানের নামে। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য থাকত এলাকার শিশুদের পড়ালেখার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়এমন চিন্তাও তখনকার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে থাকত না। কিন্তু এখন যুগের পরিবর্তন হয়েছে। আজকাল একইভাবে বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন অব্যাহত থাকলেও এসবের অধিকাংশের পেছনে থাকে ব্যবসায়িক মনোভাব। স্কুলের পেছনে টাকা বিনিয়োগ করে কীভাবে তা অধিক হারে তুলে আনা যায়, সেই চেষ্টা থাকে অনেক উদ্যোক্তার মধ্যে। স্কুল স্থাপন করে যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে ডোনেশনের নামে আদায় করা হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। এভাবে আদায় করা টাকা স্কুলের উন্নয়নে ব্যয় অথবা স্কুল ফান্ডে জমা করার পরিবর্তে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। পরে নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে, কখনো রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে এসব ব্যক্তির নামে সরকারি বেতনের অংশ বরাদ্দের অনুমতিপত্রও সংগ্রহ করা হয়। সেখানেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কাজেই এ প্রক্রিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। ফলে দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের শুরুতেই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। এখানে বণিক বার্তার পাঠকদের বলে রাখা ভালো, সরকারিভাবে চালু বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে নিবন্ধন পদ্ধতিও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম পুরোপুরি দূর করতে পারছে না।
এভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ যখন বেশ লাভজনক বলে প্রমাণ হয়ে গেল, তখন ধীরে ধীরে শুরু হলো বেসরকারি প্রচেষ্টায় উচ্চ শিক্ষা স্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের হিড়িক। প্রায় ১৫-২০ বছর আগ থেকেই শুরু হয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ স্থাপন। এখন দেশে টেকনিক্যাল এডুকেশনের প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হয়নি। বাস্তবে এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হলেও শিক্ষার মান বজায় থাকছে কিনা, সেটা দেখার কেউ নেই বলেই মনে হয়।
একই প্রক্রিয়ায় দেশে স্থাপিত হচ্ছে বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়। দেখা যায়, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের অনেকেই একসময় জড়িয়ে পড়েন বেআইনিভাবে ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ রোজগারে। ফলে দুর্নীতি ঘটে ব্যাপকভাবে। যেভাবে দেশে একের পর এক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে, তাতে শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেসেটা ভেবে শঙ্কিত হতে হয় বৈকি। অথচ আমরা ভেবে পাই না, দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও কেন বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের টেনে আনা যাচ্ছে না? কেন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা উন্নত শিক্ষার খোজে এখনো বিদেশগামী?
নির্দ্বিধায় বলা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য থাকে অর্থ কামানো। এভাবে অর্থ উপার্জন করায় কোনো ঝুঁকি নেই। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ অনেকটাই নিরাপদ। এ বিনিয়োগ থেকে লাভ উঠে আসে দ্রুত, তাও বহুগুণে। ফলে অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে অনেক সময় আর্থিক কারণে মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতেও দেখা যায়। আবার কখনো কখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও হয়। ফলে কার্যত বিঘ্ন ঘটে পড়ালেখায়। কিন্তু এদিকে মালিকপক্ষের তেমন একটা খেয়াল থাকে না বললেই চলে। তারা ব্যস্ত থাকেন অর্থ নিয়ে।
আমরা জানি, আমাদের দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম এবং যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেগুলোয় আসন সংখ্যাও সীমিত। ফলে উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে ভর্তি উপযোগী শিক্ষার্থীরা অনন্যোপায় হয়ে ধাবিত হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থপতিরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে ভর্তি ফিসহ নানা খাতে বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় করেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এখন কোনো কোনো বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শুধু ভর্তি হতেই লাগে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা! এর বাইরে প্রতি মাসে ৫-৭ হাজার টাকা টিউশন ফিসহ বিভিন্ন খাতে অর্থ দিতে হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে উচ্চহারে ভর্তি ফি। আদায়কৃত টাকার বেশির ভাগ অংশই তসরুফ করার অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং সরকারের উচিত হবে, দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেয়ার আগে কঠিন নিয়ম অনুসরণে মালিকদের বাধ্য করা। একই সঙ্গে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কী কী খাতে কী পরিমাণ অর্থ আদায় করতে পারবে, তাও নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসন সংখ্যাও নির্ধারণ করতে হবে সরকারকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভিসি একটানা সর্বোচ্চ কত বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সেটাও স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে। নিজ উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করায় একজন ব্যক্তি আজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকবেনএটা সমর্থন করা যায় না। আমরা চাই না গুটিকয়েক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবমূর্তি সংকটে পড়ুক।
আলোচ্য এশিয়ান ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে তকালীন রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন। পরে এ ঘটনা নিয়ে তদন্তও হয়েছিল। ইউজিসি তদন্ত করে দুবার। কিন্তু এর পর কী ঘটল, সেটা আর আমরা জানতে পারিনি। এবার শুধু শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে এটুকু জানা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গভীর পর্যবেক্ষণে রয়েছে। এ পর্যবেক্ষণ কত দিন ধরে চলবে, সেটা স্পষ্ট করা দরকার। একই সঙ্গে দেশের অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কী ঘটছে, সেটাও অনুসন্ধান করা জরুরি। কারণ ভেতরে ভেতরে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে না, তার নিশ্চয়তা কী?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
http://www.bonikbarta.com/sub-editorial/2013/12/23/26544