জানুয়ারি ২১,
২০১৪, মঙ্গলবার : মাঘ ৮, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবতে হবে
মোঃ
মুজিবুর রহমান
প্রকাশ
: ২১ জানুয়ারি, ২০১৪
প্রায়
দুই সপ্তাহ আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) রাষ্ট্রপতির কাছে জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। ওই প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে
যুগান্তর ১১ জানুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
সুপারিশ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে। যুগান্তরের খবরে বলা হয়েছে,
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে দেয়ার কারণগুলো ইউজিসির প্রতিবেদনে
বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ ধরনের সুপারিশ নতুন নয়। এর আগেও প্রায় একই উদ্যোগ নেয়া
হয়েছিল ২০০৯ সালে। রাষ্ট্রপতির কাছে পেশকৃত বর্তমান প্রতিবেদনটি মূলত অনেকটা
তখনকার উদ্যোগের অনুরূপ। ওই সময়ে গঠিত ১১ সদস্যের কমিটিকে নির্দিষ্টভাবে কয়েকটি দায়িত্ব
দেয়া হয়েছিল বলে যুগান্তর লিখেছে। এগুলো ছিল- ১. স্নাতক ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের
কলেজের অধিভুক্তি ও আনুষঙ্গিক ক্ষমতা অর্পণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন,
২. এ উদ্দেশ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের
বিদ্যমান আইনে কী ধরনের সংযোজন ও সংশোধন প্রয়োজন সে সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়ন,
৩. সুপারিশকৃত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিক্ষেত্র নির্বাচন ও
আওতাধীন কলেজের তালিকা তৈরি, ৪. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধীনে যেসব কলেজ রাখা হবে সেগুলোর তালিকা তৈরি, ৫. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে
গবেষণা ও উচ্চতর শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের
জন্য করণীয় নির্ধারণ ইত্যাদি। কিন্তু তখন নানা কারণে সরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি
বিভক্ত করতে পারেনি। দীর্ঘ কয়েক বছর পর আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে দেয়ার
সুপারিশ করা হয়েছে ইউজিসির পক্ষ থেকে।
জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হয়ে
আসছিল। বিশেষ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশজুড়ে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায়
যে ধরনের দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটের সৃষ্টি হয়েছে সেটা নিয়ে আলোচনা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
এ ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। দেখা
যাচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উচ্চশিক্ষায়
সেশনজট কমার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ভয়াবহ সেশনজটের কবলে পড়ে এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধ্যয়নরত বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন অনেকটাই
অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি যথাসময়ে পরীক্ষা আরম্ভ করবে দূরের কথা,
নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন কোর্সের ভর্তি কার্যক্রম শুরুই করতে
পারছে না।
জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে কলেজ পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার প্রক্রিয়া
পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশের
সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলো আগে আঞ্চলিক ভিত্তিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম
ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। তখন এসব বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত
কলেজগুলোর শিক্ষাক্রম অনুমোদনসহ, ছাত্রছাত্রী ভর্তি,
রেজিস্ট্রেশন প্রদান, পরীক্ষা গ্রহণ,
ফল প্রকাশ এবং উত্তীর্ণদের মধ্যে সনদপত্র বিতরণের কাজ করত। অবশ্য
তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেশনজট ছিল। তবে এখনকার মতো এতটা ব্যাপক ছিল না। একসময়
বিদ্যমান সেশনজট নিরসন, বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত কলেজগুলোর
শিক্ষা ব্যবস্থায় সমতা আনা এবং শিক্ষাক্রমে সামঞ্জস্য বিধান করা, শিক্ষার্থীদের একই মানের সনদপত্র দেয়াসহ আরও কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়টি সেশনজটমুক্ত থেকে শিক্ষা কার্যক্রম
পরিচালনা করতে পারলেও বর্তমানে সেশনজট ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এমনকি এক বছর
মেয়াদি শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কোর্সেও সেশনজট দেখা দিয়েছে। এখন সাধারণ শিক্ষায় যে কোনো
শিক্ষাবর্ষ আরম্ভ করতেই এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক
কোর্সে কয়েক বছরের সেশনজট। বিশ্ববিদ্যালয় যতই বলুক, সেশনজট
নিরসনের জন্য উত্তরপত্র মূল্যায়নে একক পরীক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সেটা আশানুরূপভাবে কাজ করছে না। সেশনজটের কারণে এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কাজেই সেশনজট
নিরসন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে কিংবা আদৌ তা সম্ভব কি-না সেটাই
এখন গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার গুণগত মান নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। খোদ সরকারি মহলেও এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে অনেকবার। প্রায় আড়াই
বছর আগে দৈনিক সমকাল লিখেছিল, সারা
দেশে ১২ লাখ ছাত্রছাত্রীর উচ্চতর শিক্ষার দায়িত্ব পালনকারী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের
সার্বিক মানও সন্তোষজনক নয় (০৬.০৯.১১)। এদিকে যুগান্তর
লিখেছে, বর্তমান সুপারিশের নেপথ্য কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে
ইউজিসি বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত
স্নাতকদের গুণগত মান মোটেই আশানুরূপ নয়। অধিভুক্ত কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষা
কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থা উদ্বেগজনক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত দুই হাজারেরও
বেশি কলেজ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে একটি দুরূহ কাজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট বর্তমানে গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেশনজট নিরসনে
বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ধারণা করি, বস্তুত এসব কারণেই এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে কয়েকটি এফিলিয়েটিং
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তাভাবনা চলছে ভেতরে ভেতরে।
প্রসঙ্গত,
২০১১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভাবতে হবে শীর্ষক আমার এক লেখায় প্রস্তাব রেখেছিলাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীসহ
সংশ্লিষ্টদের সীমাহীন দুর্ভোগ লাঘবের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সরকারের
উচ্চতর পর্যায়ে নতুন করে ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ১৯৯২
সালের ৩৭ নং অ্যাক্টেও সংশোধনী আনার সুপারিশ রেখেছিলাম তখন। এর পর গত কয়েক বছরে এ
বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের গণমাধ্যমে আরও অনেকবার শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু
বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর কার্যত কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।
এবার ইউজিসির পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ পেশ করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকার
কতটুকু বিবেচনা করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এখানে
উল্লেখ করা দরকার, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধীনে কলেজগুলোয় যেসব ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করছে তাদের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৪
লাখ। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো ছাত্রছাত্রী নেই, শ্রেণীকক্ষ
নেই, আনুষ্ঠানিক পাঠদানের প্রয়োজনীয়তাও নেই। তারপরও এ
বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে প্রভাষক থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ অধ্যাপক পর্যন্ত বিভিন্ন
পদবিধারী অনেক শিক্ষক। তাদের মধ্যে অনেক পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকও আছেন। তারা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক মর্যাদায় বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।
অথচ তাদের কোনো ক্লাস নিতে হয় না। শুধু তাই নয়, দেশজুড়ে
পরীক্ষা পরিচালনার সময় কোনো একটি এলাকায় কোনো কারণে (প্রাকৃতিক কিংবা রাজনৈতিক)
পরীক্ষা গ্রহণ সম্ভব না হলে অনেক ক্ষেত্রে সারা দেশের পরীক্ষা স্থগিত করে দিতে হয়।
এ ধরনের পরিস্থিতি কাম্য নয় কারও কাছেই। এ অবস্থায় শুধু এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়
হিসেবে অধিভুক্ত প্রায় দুই হাজার কলেজের লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী নিয়ে একটি
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি-না সেটা পুনরায় ভেবে দেখতে হবে।
বিগত
কয়েক বছরের মধ্যে দেশে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমান
সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে, আরও পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। আমরা এখানে প্রস্তাব রাখব, জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে দিয়ে দেশের কলেজগুলোকে আগের মতো অঞ্চলভিত্তিক বিদ্যমান বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হবে। তাহলে উচ্চশিক্ষায় গতি আসবে, সেশনজট কমবে, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ হ্রাস
হবে, শিক্ষার গুণগত মানও নিশ্চিত করা সহজ হবে। একই সঙ্গে
উচ্চতর শিক্ষায় গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের প্রস্তাব রইল সরকারের কাছে। কারণ দেশে সরকারি ও বেসরকারি
মিলিয়ে প্রায় একশ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে টিচার্স
ট্রেনিং কলেজগুলোয় পরিচালিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়েও অনেক অভিযোগ রয়েছে।
এসব কলেজে মানসম্মত শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হলে দরকার একটি পৃথক শিক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা। আমরা আশা করব, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
স্থাপনের সংশ্লিষ্ট অ্যাক্ট সংশোধনের মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ
শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে মানসম্মত
শিক্ষক-প্রশিক্ষণ এবং উচ্চশিক্ষায় গবেষণা নিশ্চিত করার স্বার্থেই।
মোঃ
মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি
টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment