শনিবার,
২৫ জানুয়ারি, ২০১৪
(উপ-সম্পাদকীয়)
এসএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের প্রশ্ন
মো. মুজিবুর রহমান |
তারিখ: ২৫-০১-২০১৪
আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে ২০১৪ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পরীক্ষা সামনে নিয়ে একদিকে পরীক্ষার্থীরা যেমন
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তেমনি তাদের অভিভাবকরাও উদ্বেগের মধ্যে
রয়েছেন। রাজনৈতিক কারণে গত বছর যেভাবে এসএসসি পরীক্ষা বিঘ্নিত হয়েছিল, এবারো একইভাবে পরীক্ষার সময়ে ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি আসে কিনা—
এটাই মূলত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অন্যতম কারণ। এছাড়া পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র
ফাঁসের আশঙ্কাও পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলছে। এর আগে ২০১২
সালের এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল।
২০১৩ সালে অনেক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। বিগত সময়ে যেসব পরীক্ষার
প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর বেরিয়েছিল গণমাধ্যমে, সেগুলোর
মধ্যে রয়েছে খাদ্য বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষা, মাধ্যমিক
স্কুলে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
পরীক্ষাসহ আরো কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। স্কুলশিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁসের
সঙ্গে জড়িত চক্রের কয়েকজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতারও করেছিল।
গত
বছর স্কুলপর্যায়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের
অভিযোগ উঠেছিল বেশ জোরেশোরে। অবশ্য প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছে ভিন্ন
কথা। তাদের মতে, প্রাথমিক সমাপনী
পরীক্ষা ও জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আদৌ ফাঁস হয়নি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ
ওঠার পর তদন্ত করে দেখা গেছে, সেগুলো নাকি ছিল সাজেশন।
ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র যদি সত্যিই সাজেশন হয়ে থাকে, তাহলেও
এটা পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের ব্যাপার। কারণ পরীক্ষার পূর্ব
মুহূর্তে যদি কোনো দুষ্টচক্র সাজেশনের নামে ভুয়া প্রশ্নপত্র পরীক্ষার্থীদের সামনে
হাজির করে সেগুলো মূল প্রশ্নপত্র বলে চালিয়ে দেয়, তাহলে
তারা বিভ্রান্ত না হয়ে পারে না।
অস্বীকার
করার উপায় নেই, যেকোনো পরীক্ষার
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে অর্থলোভী একাধিক চক্র জড়িত। তারা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের
অপকর্মের মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভারী করার উপায় খুঁজতে থাকে। তাদের সংঘবদ্ধ
প্রক্রিয়ার কাছে সরকারের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অনেক সময় হুমকির মুখে পড়ে।
সাজেশন হোক আর পরীক্ষার মূল প্রশ্নপত্রই হোক, এগুলো ওই
চক্র দেশজুড়ে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের নজরে এনে দ্রুত এবং সুযোগ বুঝে তাদের
কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় বিপুল অর্থ। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে অনেক কোচিং সেন্টারের
জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। এমন কথাও শোনা যায়, কোনো কোনো
কোচিং সেন্টার সাজেশন বের করার আড়ালে ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের
কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। অথচ কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করার জন্য শিক্ষা
মন্ত্রণালয় কত কিছুই না করেছে, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি
বলেই মনে হয়। কারণ দেখা যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন
কোচিং সেন্টার স্থাপন হচ্ছে বেশ ঘটা করেই।
প্রশ্নপত্র
যেখানে মুদ্রণ হয়, সেখান থেকেও
সেগুলো ফাঁসের কথা শোনা যায় প্রায়ই। কাজেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না বা যেগুলো ফাঁস
হয় তার সবই সাজেশন, এটা মানতে অনেকের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব
দেখা দিতে পারে। এ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে বহু অভিভাবক নগদ টাকা দিয়ে হলেও সাজেশন
কিংবা ভুয়া প্রশ্নপত্র হোক সেগুলো ক্রয়ে আগ্রহী হন। অনেক অভিভাবকের নৈতিক ভিত্তি
এতটাই দুর্বল যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর পেলেই তারা
সন্তানসহ এর পেছনে ছুটতে থাকেন। যত টাকাই লাগুক প্রশ্নপত্র কেনার জন্য তারা অস্থির
হয়ে ওঠেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর শুনলে পরীক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়,
পরীক্ষা নিয়ে তাদের স্বাভাবিক প্রস্তুতি গ্রহণেও বিঘ্ন ঘটে। শুধু
তাই নয়, যেভাবেই হোক প্রশ্নপত্র ক্রয়ের জন্য তারা
অভিভাবকদের ওপর চাপও প্রয়োগ করে। ঠিক এ সুযোগটাই গ্রহণ করে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী
চক্র।
এটা
ঠিক যে, যেকোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরকার কঠোর
গোপনীয়তায় মুদ্রণ করার চেষ্টা করে। এবারো প্রশ্নপত্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধানে
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিজি প্রেসকে চিঠি দিয়ে রেখেছে আগেই। ধারণা করি, যেখানে প্রশ্নপত্র মুদ্রণ করা হয়, সেখানে কয়েক
স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তার পরও অনেক সময় সেখান থেকেও প্রশ্নপত্র
ফাঁসের কথা শোনা যায়। অবশ্য মডারেশন করার সময়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের শঙ্কা থেকে যায়।
প্রশ্নপত্র মুদ্রণের পর যেখানে সংরক্ষণ করা হয় সেখান থেকেও এটি ফাঁস হতে পারে।
অনেক সময় প্রশ্নপত্র মুদ্রণকারীদের কেউ কেউ প্রভাবশালী চক্রের ফাঁদে পড়ে
প্রশ্নপত্র ফাঁস করার মতো বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে
জড়িতরা অবৈধভাবে বিরাট অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের অপকর্ম করে,
তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি পুরো
শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য হতাশাজনক।
পরীক্ষার
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জাতির নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। যে
দেশের নাগরিকদের মধ্যে উচ্চমানের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ রয়েছে,
সে দেশে কখনই প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে না। অথচ এটিই এখন আমাদের
দেশে ঘন ঘন ঘটে চলেছে। শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর শুনে আমরা বিস্মিত হই,
হতবাক হই। আমাদের প্রশ্ন, যারা শিক্ষক
হতে চান, তারা কি শিক্ষকতাকে শুধুই চাকরি হিসেবে দেখেন?
নইলে তাদের অনেকেই কেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অনৈতিক পন্থা
অবলম্বন করে শিক্ষকতায় আসতে চান? যারা শিক্ষকতাকে অন্য
সাধারণ চাকরির মতো বিবেচনা করেন, তাদের এ পেশায় না আসাই ভালো।
কারণ শিক্ষকতা অন্য আর দশটা-পাঁচটা চাকরির মতো নয় যে, শুধু
নির্দিষ্ট কিছু কাজ করার পর মাস শেষে বেতন-ভাতা নিলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। বরং
শিক্ষকতা এমন একটি মহৎ পেশা, যার মাধ্যমে দেশ ও জাতি
গঠনের কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজেই শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের উদ্দেশে যে
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়, সে পরীক্ষার
প্রশ্নপত্র কীভাবে পাওয়া যাবে এ পথ যারা অনুসন্ধান করেন, তাদের
শিক্ষকতা পেশায় আসা উচিত নয়। কারণ যারা একবার অবৈধ পথে শিক্ষকতায় ঢুকবেন, তারা কখনই ছাত্রছাত্রীদের ন্যায়নীতি শেখাতে পারবেন না। একইভাবে
ছাত্রছাত্রীরা যদি অবৈধ পথে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়ার সুযোগ পায়, তখন তাদের মধ্যে নীতিবোধ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। এটাও চরম
উদ্বেগের ব্যাপার।
আগামী
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা একেবারে কাছে চলে এসেছে। এরই মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে
অভিভাবক মহলে নানা ধরনের গুঞ্জন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, এবারো পরীক্ষার আগে
প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র পাওয়ার
প্রসঙ্গটিও টেনে আনছেন। এ পরিস্থিতিতে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা কঠোরভাবে
নিশ্চিত করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আগাম সতর্কতা
হিসেবে সরকার গোয়েন্দাশক্তি ব্যবহার করলে সেটা অভিভাবকদের কাছে প্রশংসিত হবে। এর
সুফল হিসেবে পরীক্ষার্থীরাও দুশ্চিন্তামুক্ত থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
লেখক:
সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
http://www.bonikbarta.com/sub-editorial/2014/01/25/29994
No comments:
Post a Comment