ঢাকা, মঙ্গলবার,
২১ জানুয়ারি ২০১৪
(উপ-সম্পাদকীয়)
জাতিবিনাশী ক্ষোভ
মো. মুজিবুর রহমান
শুধু হিংসা,
হানাহানি,
ক্ষোভ ও
বিদ্বেষের কারণে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা বাংলাদেশে ঘটেনি। বাঙালির গর্বের প্রতীক
জাতীয় পতাকা পোড়ানো থেকে আরম্ভ করে পবিত্র কোরআন শরীফ পোড়ানো,
শহীদ মিনার
ভাঙচুর, বিভিন্ন
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উগ্রভাবে হামলা চালিয়ে সেগুলোর ক্ষতিসাধন করাসহ আরও নানা
ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে এ দেশে অহরহ। এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে অনেকটা
গায়ের জোরে, শক্তি প্রয়োগ করে। অনেক ঘটনা ঘটছে প্রকাশ্যে সংঘবদ্ধভাবে
আক্রমণের মাধ্যমে, আবার কখনও ঘটছে রাতের অন্ধকারে। নির্বিচারে এসব ঘটনা ঘটে
গেলেও কেউই যেন কিছুই করতে পারছে না। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমরা দেখি
তদন্ত কমিটি করা হয় গতানুগতিকভাবে। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আর আলোর মুখ
দেখে না সচরাচর। আবার তদন্তের মাধ্যমে কখনও যদি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা
হয়, তাহলেও
অনেক ক্ষেত্রে অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়
না। ফলে বারবার বর্বর ও মধ্যযুগীয় কায়দায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে।
সর্বশেষ ঘটল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে
দেয়ার ঘটনা। আসলে এটা সর্বশেষ ঘটনা নয়। কারণ এসব উন্মত্ত ঘটনা যে ভবিষ্যতে এ দেশে
আবারও ঘটবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্কুল,
কলেজ,
মাদরাসা মিলিয়ে
পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটায়
পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে, কোনোটায় কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া
হয়েছে। কোনোটির দরজা-জানালা, ছাত্রছাত্রীদের বসার চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ এবং অন্যান্য আসবাবপত্র পুড়েছে।
কোথাও খাতাপত্র ও কাগজপত্র পুড়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে রাখা নতুন বইও পুড়ে
ভস্মীভূত হয়েছে। পুড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোয় এখন আর ক্লাস করার কোনো অবস্থা
নেই। আগুন লাগার খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজন তা নিভিয়ে ফেলায় পুরোপুরি ধ্বংসের হাত
থেকে বেঁচে গেছে খুব অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান। অনেক জায়গায় আগুনের ভয়াবহতা এতটাই
ব্যাপক ছিল যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দমকল বাহিনীকেও ছুটে যেতে
হয়েছিল। যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেগুলো জাতীয় নির্বাচনে
ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার কথা ছিল।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়ার
প্রেক্ষাপটে শিক্ষামন্ত্রী স্কুল-কলেজের আশপাশের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক, এলাকাবাসীসহ সর্বস্তরের জনগণকে অশুভ
শক্তির হাত থেকে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। এখানে আমরা
বলব, এ
আহ্বানের পাশাপাশি নিরাপদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে
হবে শক্তভাবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে
জন্য এখনই নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে,
দেশের সম্পদ
নষ্ট করার মধ্য দিয়ে ভালো কিছু করা যায় না; এতে নিজেদেরই ক্ষতি হয়। তবে এসব কথা কেবল
বইপুস্তকে লিখে দিলেই হবে না। বড়দেরই আগে করে শিশুদের সামনে উদাহরণ সৃষ্টি করতে
হবে। শুধু বইয়ের কথা নয়, বাস্তবে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে সহনশীল আচরণ এবং
দেশপ্রেমের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
প্রশ্নের সৃষ্টি হয়,
নির্বাচনকে
কেন্দ্র করে যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়া হলো সেগুলো কী ক্ষতি করেছিল?
কী দোষ ছিল
ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের? পুড়ে যাওয়া স্কুলগুলোয় এখন কিভাবে ক্লাস করবে তারা?
জাতিবিনাশী
ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে শিশুদের মনে যে
ধরনের ভীতিকর ও আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো এবং এর ফলে তাদের মনস্তাত্ত্বিক
ক্ষতি হয়েছে যতটুকু তা কে পূরণ করবে? শিশুরা দেখল,
ভোটাভুটিকে
কেন্দ্র করে তাদের প্রিয় স্কুল, তাদের খেলাধুলা করার জায়গায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে!
ক্ষোভের প্রকাশ
কত ভয়ঙ্কর!
এমনিতেই আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক
স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত অবস্থা ভালো নয়। অধিকাংশই জরাজীর্ণ ও
দুর্বল। বহু স্কুল রয়েছে যেগুলোয় দরজা-জানালা নেই,
এমনকি বেড়া
পর্যন্ত নেই অনেক প্রতিষ্ঠানের; শুধু কয়েকটি বাঁশের খুঁটির ওপর কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছে
স্কুলঘর। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের অভাবে বহু প্রতিষ্ঠানে পালাক্রমে ক্লাস অনুষ্ঠিত
হয়। অনেক স্কুলে ক্লাস হয় খোলা মাঠে। এ অবস্থায় যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়েছে
সেগুলো কত দ্রুত মেরামত করে দেয়া হবে সেটাই আসল প্রশ্ন। আমরা জানি না,
এগুলো পুনরায়
তৈরি করতে যত টাকা লাগবে তা সরকারের কাছ থেকে সহজে পাওয়া যাবে কি-না। অবশ্য এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে
ঘোষণা এসেছে, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যে
মেরামত করার ব্যবস্থা নেয়া হবে। সুতরাং আমরা একদিকে সরকারের কাছে দাবি জানাব,
ক্ষতিগ্রস্ত
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দ্রুত আর্থিক বরাদ্দ দিয়ে সেগুলো অগ্রাধিকারের
ভিত্তিতে সংস্কার ও প্রয়োজনানুসারে পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে। অন্যদিকে,
জাতীয় সংসদের
১৫৩টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন না হওয়ায় এসব আসনের অব্যয়িত অর্থ থেকে
ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মেরামতের জন্য আর্থিক বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব
রইল নির্বাচন কমিশনের কাছেও। আমরা মনে করি, শিক্ষার স্বার্থে এটি ন্যায়সঙ্গত ও
ন্যায্য প্রস্তাব এবং এ প্রস্তাব বিবেচনা করা নির্বাচন কমিশনের নৈতিক দায়িত্ব। আশা
করি, সরকার
এবং নির্বাচন কমিশন আমাদের এ আহ্বানে দ্রুত সাড়া দেবে। তাহলেই শিশু শিক্ষার্থীদের
পড়ালেখার ক্ষতি কিছুটা হলেও পূরণ করার পথ সুগম হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,
সরকারি টিচার্স
ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment