জানুয়ারি ৬, ২০১৪, সোমবার : পৌষ ২৩, ১৪২০
(বাতায়ন)
ভাবতে হবে শিক্ষার মান নিয়েও
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি, ২০১৪
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি, ২০১৪
দেশে এখনও চলছে ভয়ানক রাজনৈতিক অস্থিরতা। স্বাভাবিকভাবে
চলাফেরা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে বিরাজ করছে আতংক আর অনিশ্চয়তা। নতুন বছরের শুরুই
হয়েছে বিরোধী দলের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের মধ্য দিয়ে। নির্বাচন নিয়ে প্রধান
দুই দলের দুই মেরুতে অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে আছে বহুদিন ধরে।
এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি আর কত দীর্ঘ হবে সেটাই এখন
আলোচনার প্রধান বিষয়। তবে এ লেখায় সম্প্রতি প্রকাশিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের
দুটি বড় পাবলিক পরীক্ষার ফল নিয়ে কিছুটা পর্যালোচনা করতে চাই।
দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৩ সালের
বেশিরভাগ সময় কেটেছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। ফলে স্কুল-কলেজে নিয়মিত ক্লাস অনুষ্ঠিত হতে পারেনি
বিঘ্নিত হয়েছে পরীক্ষা কার্যক্রম। এর পরও শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের সমাপনী
পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। একইভাবে নানা বিপত্তি ও বিঘ্নের মুখেও মাধ্যমিক
স্তরের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক দিন আগে এসব
পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত ফল খুব সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এবার সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে ২৯ লাখ ৫০ হাজার ১৯৩
জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রাথমিক সমাপনীতে ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৪০৬ জন এবং ইবতেদায়ি
সমাপনীতে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৭ জন পরীক্ষার্থী ছিল। উভয় পরীক্ষা মিলিয়ে পাসের হার ৯৮.৫৮ শতাংশ। পরীক্ষার ফল দেখেই বোঝা যায়,
আগের বছরের
তুলনায় এ বছর পাসের হার বেড়েছে। অন্যদিকে এবারের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় গড়
পাসের হার ৮৯.৯৪ শতাংশ। জেএসসি পরীক্ষায় আলাদাভাবে পাসের হার ৮৯.৭১ ভাগ এবং জেডিসি পরীক্ষায় ৯১.১১ ভাগ। এ দুটি পরীক্ষায়ও পাসের হার আগের
বছরের তুলনায় বেড়েছে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নিয়মিত পড়ালেখা না হলেও কীভাবে পাসের হার বেড়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার মান
উপেক্ষিত হওয়ার কোনো কারণ সৃষ্টি হচ্ছে কি-না সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি
রাখে।
পরীক্ষায় পাসের হার বাড়াটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
যারা পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল করেছে, আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই। একই সঙ্গে তাদের শিক্ষক ও
অভিভাবকদের প্রতিও অভিনন্দন রইল। কারণ সবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টার কারণে এবার
পরীক্ষার ফল আরও ভালো হয়েছে। এবার জেএসসি ও জেডিসি পর্যায়ে জিপিএ-৫ পাওয়ার হার বাড়ার পেছনে যেসব কারণ কাজ
করেছে তার মধ্যে রয়েছে, প্রথমবারের মতো চতুর্থ বিষয়ের নম্বর মূল নম্বরের সঙ্গে যোগ
করে ফলাফল প্রকাশ করা। এ ছাড়া মনে করা হয়, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির সঙ্গে
শিক্ষার্থীরা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। স্কুলগুলোয়
পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটলেও সন্তান নিয়ে অভিভাবকদের চেষ্টার কোনো অন্ত ছিল না। তারা
স্কুলের বাইরে থেকে হলেও নানাভাবে সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। এটিও
ভালো ফল করার অন্যতম কারণ।
কিন্তু ভালো ফল করার মধ্যেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে
যায়। যেসব শিক্ষার্থী ভালো ফল করে পরীক্ষায় পাস করেছে,
তারা পাঠ্য
বিষয়ে বর্ণিত সব শিখনফল যথাযথভাবে অর্জন করতে পেরেছে কি-না সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ গত
বছরের প্রায় পুরো সময়ই ছিল বিরোধী দলের নানা রকমের রাজনৈতিক কর্মসূচি। এর মধ্যে
লাগাতার হরতাল ছিল অনেক দিন পর্যন্ত। এর পর যুক্ত হয়েছে অবরোধের মতো পড়ালেখা ও
পরীক্ষা কার্যক্রম স্থবির করা কর্মসূচি। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে
শুধু শিক্ষা খাত নয়, বরং দেশের সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বছরের কিছুটা সময়জুড়ে প্রাথমিক ও
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচিও ছিল।
ফলে সন্দেহ নেই,শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটেছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখিও হয়েছে,
অনেক
খবর-প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। কাজেই দেখা যায়,দেশজুড়ে প্রায় পুরো বছর রাজনৈতিক
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করলেও পরীক্ষায় ঠিকই ভালো ফল হয়েছে। সুতরাং বলা যায়,ধারাবাহিকভাবে চলে আসা হরতাল ও অবরোধ
শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটালেও তাদের
ফলাফলে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচির মুখে পাসের হার আরও বেড়েছে। কাজেই এটা
কী কৌশল অনুসরণ করে এবং কীভাবে সম্ভব
হয়েছে সেগুলোই পরবর্তী পরীক্ষার্থীদের ওপর ভবিষ্যতে প্রয়োগের উদ্দেশ্যে পর্যালোচনা
করে দেখা দরকার।
যে কোনো স্তরের পরীক্ষাতেই যারা অংশগ্রহণ করে, তারা সবাই ভালোভাবে পাস করবে এটা একদিকে যেমন পরীক্ষার্থী
ও শিক্ষকদের প্রত্যাশা থাকে, অন্যদিকে অভিভাবকরাও আশা করেন তাদের সন্তান পরীক্ষায় ভালো
ফল করবে। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে পাসের হার শতভাগ হওয়াটাই অধিক প্রত্যাশিত। কারণ
কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করে সাধারণত এ স্তরে তাদের এমন
কোনো প্রশ্ন করা হয় না যার ফলে তারা পরীক্ষায় ফেল করতে পারে। আগে যখন পঞ্চম
শ্রেণির পড়ালেখা শেষে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো না, তখন স্কুল পর্যায়ে গৃহীত পরীক্ষায় সবাই পাস করত। শিশুদের
উৎসাহ দেয়ার জন্য হলেও অনেক আগ থেকেই প্রাথমিক স্তরে প্রায় শতভাগ পাস করার ধারা
চালু ছিল। সুতরাং প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় এ বছর পাসের হার শতভাগের কাছাকাছি চলে
যাওয়ায় শিক্ষার মান নিয়ে
প্রশ্ন উত্থাপন
করার তেমন কোনো সুযোগ নেই। কারণ শিশুদের জন্য এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ওপরের শ্রেণীতে যেমন জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় পাসের হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে শিক্ষার মানের বিষয়টি কী পর্যায়ে আছে সেটা নিয়ে
আলোচনা করা দরকার। অনেকেই মনে করেন, আজকাল পড়ালেখার গুণগত মান বৃদ্ধির চেয়ে
পরিমাণগত বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে বেশি। আমরা জানি না,
এ ধরনের ধারণার
বাস্তবতা কতটুকু রয়েছে। তবে আমরা বলতে চাই, পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে
যদি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার গুণগত মান বাড়ছে কি-না সেটা যাচাই করার কোনো একটা উপায় বের করা যেত তাহলে খুব ভালো হতো। অভিযোগ রয়েছে,
শিক্ষা
মন্ত্রণালয় ও তার অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পাসের হার বাড়ানোর দিকে যতটা
মনোযোগ, তত
মনোযোগ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মান বাড়ানোর দিকে নয়। এ ধরনের অভিযোগ আরও রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ানোর জন্য পরীক্ষার খাতায় নম্বর বেশি দেয়া হচ্ছে। এ
ছাড়া পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তো রয়েছেই। এমনকি পরীক্ষার দিন
পত্রপত্রিকায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের অনেক মিলও পাওয়া গেছে। অবশ্য শিক্ষা বিভাগ
বলছে, তদন্তের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের
সত্যতা পাওয়া যায়নি;এগুলো ছিল সাজেশন।
এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হোক আমরা এটাই দেখতে চাই। কারণ মানের ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হলে
সেটা জাতিকে ধ্বংস করার শামিল বলে গণ্য হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে পাসের হার বৃদ্ধির আড়ালে মানের ব্যাপারটি চাপা পড়ে যাচ্ছে বলে যে ধরনের
গুঞ্জন রয়েছে সেটা আসলে সত্য কি-না তা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে শিক্ষা বিভাগকেই। এ গবেষণার কিছুটা ভার
সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। কারণ মাধ্যমিক স্তরে
যে শিক্ষকরা পড়ান, টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো তাদেরই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সুতরাং
টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে কী মানের শিক্ষক বেরিয়ে যাচ্ছেন, তা অনুসন্ধান করা দরকার। এটা করা দরকার জরুরিভিত্তিতে।
কারণ এখন যারা শিশু-শিক্ষার্থী, তারা যদি
জীবনের শুরুতেই গুণগত পড়ালেখার মাধ্যমে তাদের জ্ঞানের ভিত্তিটা মজবুত ও দৃঢ় করতে
না পারে, তাহলে দেশের জন্য তারা ভবিষ্যতে কী কাজে লাগবে এমন প্রশ্ন থেকে যায়। কাজেই
পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ার পেছনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যেমন নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে,তেমনি মানের ব্যাপারেও নিতে হবে কার্যকর
পদক্ষেপ; ভাবতে হবে শিক্ষার মান নিয়েও।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক,সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment