মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি,
২০১৪
(উপসম্পাদকীয়)
রাজনৈতিক অস্থিরতায় কার
লাভ?
মো.
মুজিবুর রহমান | তারিখ: ১৪-০১-২০১৪
মনিটর
ফ্রন্টিয়ার মার্কেটস প্রকাশিত ২০১৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকের দক্ষিণ এশিয়া আউটলুক
প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘৫০
কোটি ডলারের ব্যবসা চলে গেছে ভারতে’ শীর্ষক
একটি খবর ২৩ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশ করে দৈনিক বণিক বার্তা। তাতে বলা হয়েছে, চলতি
বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পোশাক খাতের এ বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ হারানোর
মূল কারণ রাজনৈতিক সহিংসতা। পাশাপাশি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণকে কেন্দ্র করে ঘন ঘন
শ্রমিক অসন্তোষও পোশাক খাতে বিপর্যয় নেমে আসার কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে মন্তব্য
করা হয়েছে। ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক অর্থনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করেই যে বণিক বার্তা
পোশাক খাত নিয়ে এভাবে প্রধান শিরোনাম করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু খবরটি আমাদের
নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কতটুকু সক্ষম হয়েছে, সেটাই আসল
প্রশ্ন।
খবরের
এখানেই শেষ নয়। বণিক বার্তা লিখেছে, মনিটরের প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ
করে বলা হয়েছে, নির্বাচন ঘিরে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সহিংসতা
ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ফলে সহিংস রাজনীতি সামনের প্রান্তিকের সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো
খারাপের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আগামী দিনগুলোয় এটা যদি বাস্তব পরিস্থিতির রূপলাভ
করে, তাহলে বলতে হবে আমাদের পোশাক খাতের জন্য অপেক্ষা করছে আরো করুণ ও দুঃখজনক
পরিণতি! এ অবস্থা আমাদের পুরো আর্থিক খাতে সৃষ্টি করতে পারে আরো বড় ধরনের
অনিশ্চয়তা। দেখা দিতে পারে অস্থির পরিস্থিতি। কমতে পারে কর্মসংস্থানের সুযোগ।
ধারণা
করি, দেশে দীর্ঘদিন ধরে যে ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, তাতে আলোচ্য খবরটি
অনেকের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে নাও হতে পারে। এছাড়া রাজনৈতিক খবরের চাপে
পড়ে এটি আড়ালে চলে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। কারণ এখন প্রায় সবার কাছে অন্য অনেক কিছুর
চেয়ে রাজনীতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও রাজনীতি নিয়ে
যতটুকু আগ্রহ রয়েছে, সে রকম আগ্রহ অন্য কোনো কিছুতে দেখা যায় না। কাজেই শেষ
পর্যন্ত খবরটিও হয়তো গুরুত্বহীন হয়ে উঠবে একসময়। অথচ অর্থাভাবে শক্তিশালী করতে হলে
অবশ্যই ব্যবসা-বাণিজ্য গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে
পারেন, সেজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ
অর্থনৈতিকভাবে যেমন দেশকে সমৃদ্ধশালী করে তোলে, তেমনি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্যও
সহায়ক ভূমিকা রাখে। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব
রাজনীতিকদের ওপরই বর্তায়। কারণ তাদের ওপর নির্ভর করে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি।
রাজনৈতিক নেতৃত্বই ঠিক করে দেশ কীভাবে চলবে। কাজেই বলা যায়, রাজনৈতিক অঙ্গন ভালো থাকলে
দেশ ভালো থাকবে।
রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতার ওপর সব ধরনের উন্নয়ন নির্ভরশীল। এমনকি শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ
খাত, যা সবকিছু গড়ে ওঠার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, সেটার গুণগত উন্নয়ন ও বিকাশ
নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। শিক্ষা অর্জন নাগরিকদের মৌলিক অধিকার
হিসেবে সাংবিধানিকভাবেই স্বীকৃত। অথচ প্রতিনিয়ত তাদের এ সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত
হয়ে আসছে। আর এভাবে যে প্রকারান্তরে সংবিধানই লঙ্ঘন করা হচ্ছে, সেদিকে কারো দৃষ্টি
নেই বলেই মনে হয়। বাংলাদেশে কেবল রাজনীতির ক্ষেত্রে সংবিধান লঙ্ঘনের প্রশ্ন উঠতে
দেখা যায়। কিন্তু যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষালাভের অধিকার
ক্ষুণ্ন করার মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়, তখন সেটা নিয়ে কেউ তেমন একটা প্রশ্ন
তোলেন না। এমনকি শিক্ষার সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে প্রয়োজনের সময় খুব একটা
সাড়াশব্দ করতে দেখা যায় না। শিক্ষার্থীদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হলে শিক্ষক
সংগঠনকেও এ নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও এমন যে,
শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে শিশুদের যতই সমস্যা হোক, সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই বলে মনে
হয়। পড়ালেখা নিয়ে উদ্বেগ যতটুকু থাকে, সেটা অভিভাবকরা ভেতরে ভেতরে নিজেরাই সয়ে
নেন।
শিক্ষা
নিজেই সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত থাকলে
এটা ঠিকঠাকমতো কাজ নাও করতে পারে। বর্তমানে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
স্বাভাবিকভাবে ক্লাস হচ্ছে না। এমনকি উচ্চশিক্ষায় ভর্তি কার্যক্রমও বিপর্যস্ত হয়েছে।
সবে শুরু হলো স্কুলপর্যায়ের নতুন শিক্ষাবছর। আর শুরুতেই বছরের প্রথম দিনটা
রাজনৈতিক ধাক্কা খেল অবরোধের কবলে পড়ে। সেজন্য বলা যায়, শিক্ষার যতই প্রভাব
বিস্তারকারী সম্মোহনী শক্তি থাকুক, রাজনৈতিক অস্থিরতার কাছে শিক্ষাও অনেক সময়
পরাস্ত হয়। অন্তত এটা বাংলাদেশে হয় এবং বেশ নিয়মিতই।
আমাদের
মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে রফতানি খাতের বিপুল অর্ডার অন্য দেশে
চলে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। এরূপ ধারণার পক্ষে প্রমাণ রয়েছে। এরই মধ্যে পোশাক
খাতের বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ ভারতে চলে গেছে—এ
খবর বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমে এসেছে। প্রশ্ন ওঠে, কেন আমাদের পোশাক শিল্পের এত বিরাট
অঙ্কের ক্রয়াদেশ চলে গেল ভারতে? উত্তর খুব সহজ—রাজনৈতিক
অস্থিরতা। কারণ অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ পরিবেশের মধ্যে বিদেশী ক্রেতাদের অনেকেই
বাংলাদেশে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তারা এখন ছুটছেন অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ ও
স্থিতিশীল দেশের দিকে। এ রকম একটি দেশ হলো ভারত। ভারত বড় দেশ হওয়ার পরও সে দেশে
রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতি আমাদের মতো এতটা মারমুখী হয় না। কাজেই বিদেশী ক্রেতাদের
কাছে ভারত অনেক আকর্ষণীয় হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রসঙ্গক্রমে আরো অনেক প্রশ্নের
সৃষ্টি হয়। এসব প্রশ্নের একটি হলো, আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করলে কার
লাভ? এর উত্তরও পাঠকদের জানা আছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, রাজনৈতিকভাবে আমাদের এখন
কী করা উচিত? দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বীমা, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য
বাঁচানোর জন্য আমরা কি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব, নাকি
নির্বিকার থেকে এসব খাতের ক্ষয়িষ্ণু চরিত্র দেখব? এটাও ঠিক করতে হবে রাজনৈতিক
নেতৃত্বকেই।
কোনো
কিছু না হোক, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে
এটি আমাদের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতার
সৃষ্টি করতে পারে—এ দিকটি
বাংলাদেশকে বিবেচনায় রেখেই নিজের রাজনৈতিক সমস্যা দ্রুত সমাধানের পথে এগোতে হবে।
এজন্য বাংলাদেশকে এখনই সতর্ক হওয়া দরকার।
লেখক:
সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি
টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
http://www.bonikbarta.com/sub-editorial/2014/01/14/28940
No comments:
Post a Comment