Monday, June 16, 2014

প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ অসম্ভব নয়



(বাতায়ন))
জুন ১৬, ২০১৪, সোমবার : আষাঢ় ২, ১৪২১
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ অসম্ভব নয়
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ১৬ জুন, ২০১৪
এসএসসি ও এইচএসসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে দেশজুড়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদরা এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছেন অনেক। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ সামনে নিয়ে দেখা যায়, আজ শুধু পাবলিক পরীক্ষা নয়, বরং সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ অন্য অনেক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে প্রায় নিয়মিত। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছিল আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে- কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে প্রশ্নপত্র মুদ্রণ এবং তা সতর্কতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে প্রেরণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু তারপরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ থেমে নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে এখন নতুন কী পদক্ষেপ নেয়া হয় সেটিই দেখার বিষয়।
এসএসসি পরীক্ষার যেসব প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় বলে পত্রপত্রিকায় খবর আসে, তার অধিকাংশই সৃজনশীল অংশের। আর সৃজনশীল অংশটি সব বোর্ডের অধীনে অভিন্ন প্রশ্নপত্র হওয়ায় এটি ফাঁস হলে দেশজুড়ে পরিচালিত পরীক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। কাজেই সৃজনশীল অংশের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন ও মুদ্রণ প্রক্রিয়ার কোনো স্তর থেকে ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা সেটা কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ সৃজনশীল অংশের প্রশ্ন প্রণেতার সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। ঘুরে-ফিরে নির্দিষ্ট কয়েকজনই প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন বলে খবর রয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণেতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। এছাড়া বিশেষ কোনো ধরনের প্রশ্নপত্র বিশেষ কোনো স্থান থেকে ফাঁস হয় কিনা সেটা নিয়েও অনুসন্ধান চালাতে হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা অসম্ভব কিছু নয়। এখন উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একদিকে যেমন প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রকে খুব সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব, তেমনি প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে নেয়া যায় কার্যকর পদক্ষেপ। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, এখনও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সঠিক পথ খুঁজে বের করা যায়নি। কারণ দেখা যায়, খুব ঘনঘনই প্রায় সব ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠছে। সর্বশেষ রাজশাহীতে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁসের খবর বেরিয়েছে গণমাধ্যমে। পরীক্ষার ঠিক আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এসব খবর বেশ উদ্বেগজনক।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে এর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি না হয়ে পারে না। কারণ বারবার যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে, তাহলে এর ব্যবস্থাপনাগত কোনো ত্রটি আছে কিনা এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে এরই মধ্যে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা চাই, প্রশ্নপত্র ফাঁস কঠোরভাবে রোধ করা হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেধাবী শিক্ষার্থীরা। আর যারা অনৈতিকভাবে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র জোগাড় করে পরীক্ষায় অংশ নেয়, তারা লাভবান হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। অবশ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তদন্ত করে দেখা গেছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নগুলো ছিল সাজেশন। প্রসঙ্গত, যারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশন করছেন তাদের কেউ কেউ প্রশ্নপত্রের আকারে পরীক্ষার্থীদের সাজেশন দিচ্ছেন কিনা এমন ধারণা অমূলক নয়। এ ক্ষেত্রে আমরা বলব, সাজেশন হোক আর মূল প্রশ্নপত্রই হোক, পরীক্ষার আগে যে কোনো উপায়ে এগুলো পরীক্ষার্থীদের সামনে চলে এলে তারা বিভ্রান্ত না হয়ে পারে না। এ বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য হলেও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের কার্যকর উপায় খুঁজে বের করতে হবে দ্রুত। আমরা মনে করি, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের সঠিক উপায় বের করা কঠিন কিছু নয়। এরই মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে অনেক সুপারিশ চলে এসেছে কর্তৃপক্ষের হাতে। কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কিনা সেটাই হল আসল প্রশ্ন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কিছু সুপারিশ এখানে তুলে ধরা হল- ১. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে পরীক্ষা শুরুর ৮-১০ দিন আগে; ২. সৃজনশীল প্রশ্নপত্র বোর্ডভিত্তিক আলাদা আলাদাভাবে প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে; ৩. যারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবেন, তাদের বাছাই করার জন্য কঠোরভাবে নৈতিকতার পরীক্ষা নিতে হবে। মডারেশনের সময় মডারেশনকারী ও অন্য সহায়ক ব্যক্তিদের কেউই যাতে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস, সেল ফোন ইত্যাদি ব্যবহার না করেন তা নিশ্চিত করতে হবে; ৪. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রকাশ ইত্যাদি কাজ পরীক্ষা পরিচালনা বিধি অনুযায়ী গোপনীয় বলে বিবেচিত হলেও প্রায়ই দেখা যায়, এ ধরনের কাজে যারা জড়িত তাদের অনেকেই বিভিন্ন গাইড বই লিখে তাতে নিজেকে প্রশ্নপত্র প্রণেতা, বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষক পরিচয়ে পরিচিত করেন। আর শিক্ষার্থীরা এসব শিক্ষকের লেখা গাইডই বেশি পড়তে আগ্রহী হয়। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টাও করেন অনেকে। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে; ৫. সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী মাস্টার ট্রেইনারদের সংখ্যা বাড়াতে হবে; ৬. একই ব্যক্তি যাতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনের সঙ্গে একবারের বেশি জড়িত না থাকেন, সেটা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে; ৭. প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য গ্রামের স্কুল থেকে ভালো শিক্ষককে বেছে নিয়ে তাদের দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করাতে হবে; ৮. যেসব শিক্ষক কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত আছেন বলে তথ্য রয়েছে, তাদের প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সুযোগ না দেয়া; ৯. এক বোর্ডের প্রশ্নপত্র অন্য বোর্ডের আওতাধীন শিক্ষক দিয়ে প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ; ১০. শিক্ষাবোর্ডে কর্মরতদের আন্তঃবোর্ডে বদলির ব্যবস্থা করা। এজন্য দরকার হলে শিক্ষা আইনের মাধ্যমে এডুকেশন বোর্ড রিক্রুটমেন্টস অথরিটি (ইবিআরএ) গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে দ্রুত; ১১. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি দুই বছরে একবার করে বদলি নিশ্চিত করতে হবে; ১২. সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন এবং পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment