ঢাকা, সোমবার ০২ জুন ২০১৪, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২১, ০৩ শাবান ১৪৩৫
(উপসম্পাদকীয়)
এই সময়
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কয়েকটি সুপারিশ
মো.
মুজিবুর রহমান
দেশের
সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি ও এইচএসসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের
অভিযোগ উঠছে প্রায়ই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ
প্রমাণিত হওয়ায় পরীক্ষার আগে তা স্থগিত করা হয়েছে। আবার সরকারের আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনী প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছিল অনেক
আগে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে নানামুখী
উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের একটি হলো, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে প্রশ্নপত্র মুদ্রণ এবং তা যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে প্রেরণ। কিন্তু তার পরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অব্যাহত
রয়েছে। এ নিয়ে এখন অন্য রকমভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠছে বিভিন্ন মহল। প্রশ্নপত্র
ফাঁস বন্ধের দাবি নিয়ে এখন সরব রয়েছেন অনেকেই। শিক্ষামন্ত্রী নিজেও প্রশ্নপত্র
ফাঁস রোধে মন্ত্রণালয়ের দৃঢ় অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরেছেন গণমাধ্যমে অনেকবার।
এমনকি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দৃঢ় প্রত্যয়ও
ব্যক্ত করেছেন তিনি; এ কাজে সবার সহযোগিতাও চেয়েছেন।
কিভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যায় এ নিয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে এখন। এত কিছুর
পরও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ হবে কিনা সেটাই হলো আসল প্রশ্ন। কারণ প্রশ্নপত্র ফাঁস
রোধে কার্যকর কোনো উপায়ই এখন পর্যন্ত বের হয়ে আসেনি বলে দেখা যাচ্ছে। ফলে
সামনের দিনগুলোয় প্রশ্নপত্র ফাঁসের আরো নতুন নতুন অভিযোগ উঠবে না তা নিশ্চিত নয়।
এসএসসি
ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ সামনে রেখে কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা
করে দেখা দরকার। প্রথমত, এ দুটো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র
প্রণয়ন, মডারেশন ও মুদ্রণ প্রক্রিয়ার কোনো একটি বা
একাধিক স্তর থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কিনা তা বিবেচনায় রাখতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ কোনো
ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কিনা সেটাও ভাবনায় রাখতে হবে। কারণ এসএসসি ও এইচএসসি
পরীক্ষার যেসব প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেগুলো সৃজনশীল অংশের প্রশ্নপত্র। আর সৃজনশীল অংশটি অভিন্ন প্রশ্নপত্র
হওয়ায় তা ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠলে সব বোর্ডের পরীক্ষার্থীদের উপর এর প্রভাব পড়ে।
দ্বিতীয়ত, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনের সঙ্গে যারা জড়িত
তাদের কারো মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে কিনা এটাও তদন্তের বিবেচনায় রাখতে হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সহায়ক হবে এমন কয়েকটি সুপারিশ এখানে তুলে ধরা হলো।
১.
প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে পরীক্ষা শুরুর ৮-১০ দিন আগে;
২. সৃজনশীল প্রশ্নপত্র বোর্ডভিত্তিক আলাদা আলাদাভাবে প্রণয়নের
উদ্যোগ নিতে হবে; ৩. যারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবেন তাদের
বাছাই করার জন্য কঠোরভাবে নৈতিকতার পরীক্ষা নিতে হবে। মডারেশনের সময় মডারেশনকারী ও
অন্যান্য সহায়ক ব্যক্তিদের কেউই যাতে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস, সেল ফোন ইত্যাদি ব্যবহার না করেন তা নিশ্চিত করতে হবে; ৪. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রকাশ পরীক্ষা
পরিচালনা বিধি অনুযায়ী গোপনীয় কাজ বলে বিবেচিত হলেও দেখা যায়, এ ধরনের কাজে যারা জড়িত তাদের অনেকেই বিভিন্ন গাইড বই লিখে থাকেন এবং
তাতে নিজেকে প্রশ্নপত্র প্রণেতা, বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের
পরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষক ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত করেন। আর
কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এসব শিক্ষকের লেখা গাইড বেশি পড়তে আগ্রহী হয়। তাদের সঙ্গে
যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টাও করেন অনেকেই। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে;
৫. সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী মাস্টার ট্রেনারদের সংখ্যা
অত্যন্ত কম হওয়ায় কেবল নির্দিষ্ট কয়েক জনই প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন
বলে তথ্য রয়েছে। কাজেই দেখা যায়, সৃজনশীল অংশের প্রশ্নপত্র
প্রণয়নকারীদের সংখ্যা বাড়াতে না পারায় ঘুরে-ফিরে নির্দিষ্ট কয়েক জনই প্রশ্নপত্র
প্রণয়ন করছেন। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। দরকার হলে আরো নতুন নতুন শিক্ষককে
প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে; ৬. একই ব্যক্তি যাতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনের সঙ্গে একবারের বেশি
জড়িত না থাকেন সেটা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে; ৭. প্রশ্নপত্র
প্রণয়ন করার জন্য গ্রামের স্কুল থেকে ভালো শিক্ষককে বেছে নিয়ে তাদের দিয়ে
প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করাতে হবে; ৮. যেসব শিক্ষক কোচিং
করানোর সঙ্গে জড়িত আছেন বলে তথ্য রয়েছে তাদের প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সুযোগ না দেয়া;
৯. এক বোর্ডের প্রশ্নপত্র অন্য বোর্ডের আওতাধীন শিক্ষক দিয়ে
করানোর উদ্যোগ গ্রহণ; ১০. শিক্ষাবোর্ডে কর্মরতদের
আন্তঃবোর্ডে বদলির ব্যবস্থা করা। এজন্য দরকার হলে শিক্ষা আইনের মাধ্যমে এডুকেশন
বোর্ড রিক্রুটমেন্টস অথরিটি (ইবিআরএ) গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে দ্রুত। 'শিক্ষা আইন ২০১৩ : কয়েকটি সুপারিশ' শীর্ষক
আমার একটি নিবন্ধে ইবিআরএ গঠন নিয়ে বিস্তারিত সুপারিশ রেখেছিলাম (দৈনিক ইত্তেফাক,
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩); ১১. প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সরকারি
চাকরিজীবীদের প্রতি দুই বছরে একবার করে বদলি নিশ্চিত করতে হবে; ১২. সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন এবং পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন
করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ,
ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.comhttp://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDZfMDJfMTRfMV80XzFfMTM1MDUw
No comments:
Post a Comment