Wednesday, June 11, 2014

অবহেলিত শিক্ষা খাত



বুধবার জুন ১১, ২০১৪ জ্যৈষ্ঠ ২৮, ১৪২১
(উপ-সম্পাদকীয়)
অবহেলিত শিক্ষা খাত
মোঃ মুজিবুর রহমান
সারা দুনিয়ায় শিক্ষা সব ধরনের উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক ও মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করলেও বাংলাদেশে খাতটি বিভিন্নভাবে উপেক্ষিত হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। বিগত কয়েক বছরে শিক্ষা খাতে এ সরকারের অনেক সাফল্য থাকলেও শিক্ষকদের জীবনমানের তেমন দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেড়েছে, ঝরে পড়া হ্রাস পেয়েছে, পড়ালেখা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে অনেক, সব ধরনের পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। অথচ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি স্কুল-কলেজে কর্মরত শিক্ষকরাও অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন নানাভাবে। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে অনেক আগে শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর আশা করা হয়েছিল, শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হবে; তাও হয়নি। তবু শিক্ষকরা আশায় বুক বেঁধে আছেন, কোনো না কোনো সময় তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, ঘোষণা করা হবে আলাদা বেতন কাঠামো।
বলতে দ্বিধা নেই, দেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরা। তাদের সামাজিক মর্যাদা কতটুকু, সেটা আমাদের চারপাশে ভালো করে দেখলেই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করাকে এখন মর্যাদাপূর্ণ কাজ বলে গণ্য করা হয় না। আমাদের সমাজে এখনো এমন ধারণা প্রচলিত, যারা অন্য কোথাও ভালো কোনো চাকরি জুটিয়ে নিতে পারেননি, তারাই অনন্যোপায় হয়ে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেন। আবার সুযোগ পেলে এ চাকরি পরিত্যাগও করেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকারের কাছ থেকে যে পরিমাণ বেতন পান, সেটাও দিয়ে ভালোভাবে সংসার পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বাড়িভাড়া ভাতা হিসেবে শিক্ষকদের যে টাকা দেয়া হয়, সেটা উল্লেখ করার মতো নয়। তবু শিক্ষকদের আত্মতৃপ্তি এই যে, তারা দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন; দেশকে আলোকিত করে যাচ্ছেন।
এটা তো গেল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের বঞ্চনার কথা। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও আশাব্যঞ্জক তেমন কিছু দেখা যায় না। এখনো সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা পদোন্নতিবঞ্চিত। তারা চাকরির শুরুতে যে পদে যোগদান করেন, অবসর গ্রহণের দিন পর্যন্ত প্রায় সবাই একই পদে কর্মরত থাকেন। অথচ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা বিভাগে যোগ্যতাভিত্তিক পদোন্নতি ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। এটা করা দূরের কথা, নিয়মিত পদোন্নতিই পাওয়া যায় না এ দেশে।
এবার আলোচনা করা দরকার সরকারি কলেজে কর্মরত বিসিএস ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে। এ শ্রেণীর শিক্ষকরা অন্য ক্যাডারের প্রার্থীদের সঙ্গে একই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করলেও এদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তেমন একটা নেই। শিক্ষা ক্যাডার দেশের অন্যতম বড় ক্যাডার হওয়ার পরও এখানেও দেখা যায় নানা রকমের অবহেলা আর বঞ্চনা। এ ক্যাডারে কর্মরতদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির খতিয়ান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দুটোর মধ্যে বঞ্চনার পাল্লাই ভারী। ফলে শিক্ষা ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনেকেই চলে যাচ্ছেন প্রশাসন, পুলিশ, কর, পরিসংখ্যান ইত্যাদি ক্যাডারে। যে কেউ যে কোনো সময় এক চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে যোগদানের অধিকার রাখলেও কেন অনেকেই শিক্ষা ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে যান, তার কারণ অনুসন্ধান করা কি জরুরি নয়? প্রশাসন, পুলিশ, কর ক্যাডার অনেককে আকর্ষণ করতে পারে, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডার পারে না কেন? উন্নত দেশগুলোয় অধ্যাপকদের মর্যাদা অনেক বেশি। বাংলাদেশে তা নেই। এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে শিক্ষাজীবনের সেরা ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্র নিয়োগ দেয়। আর আমাদের দেশে প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই উপেক্ষা করেন শিক্ষকতাকে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষক হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন, তারাও নিয়মিত পদোন্নতি পান না। শুধু তাই নয়, ক্যাডার চাকরির প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত ছিল, চাকরিগত কাঠামোর দিক থেকে বিবেচনা করে সব ক্যাডারের জন্য সমমর্যাদার পদ সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সরকারের অভিজাত ক্যাডার হিসেবে পরিচিত কয়েকটি ক্যাডারে সর্বোচ্চ সিনিয়র সচিব পদ থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারে সমমর্যাদার তেমন পদ নেই। শিক্ষা ক্যাডারে এখনো নিয়মিত পদোন্নতি হয় না। এ সরকারের আগের আমলে বেশ কয়েকবার শিক্ষকদের পদোন্নতি হলেও তা একেবারে প্রত্যাশিত মাত্রায় ঘটেনি। যে পদে শিক্ষকদের পাঁচ বছর চাকরি করার পর পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল, সে পদে অনেকেই আছেন দশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে; যে পদে তিন বছর কাজ করার পর পদোন্নতি হওয়ার নিয়ম রয়েছে, সে পদে থাকতে হচ্ছে ১২ বছরেরও বেশি, আর সহযোগী অধ্যাপক পদে দুই বছর চাকরি করার পর অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে দেখা যায়, শিক্ষকদের অনেকেই অধ্যাপক হওয়ার আগে ৮-১০ বছর ধরে চাকরি করে যাচ্ছেন একই পদে। তার পরও পদোন্নতির কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতি বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না শিক্ষকদের পদের সংখ্যা। শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরতদের পদোন্নতি নিয়ে কী ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেটা দেখা যায় তাদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখলে। এ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি এখন বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি বৈষম্য নিরসনে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপক পদে ব্যাচভিত্তিক দ্রুত পদোন্নতি প্রদানের দাবিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সামনে সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালনের দিকেও এগিয়ে গেছে। আমাদের প্রশ্ন, সরকারের ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা হওয়ার পরও কেন তাদের পদোন্নতির দাবি নিয়ে অধিদফতরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে হবে? পদোন্নতির জন্য আন্দোলন করতে হবে কেন? তাহলে ক্যাডারের মর্যাদা থাকল কোথায়? অন্য অভিজাত ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কি পদোন্নতির জন্য এ ধরনের কর্মসূচি পালন করতে হয়? এ অবস্থার পরিবর্তন করা না গেলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মাত্রার গুণগত মান অর্জন কীভাবে সম্ভব, সেটা প্রশ্ন হিসেবেই থেকে গেল।
শিক্ষা খাত আর্থিকভাবে কতটুকু অবহেলার শিকার হয়েছে, সেটা বোঝা যায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই। বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের। কিন্তু এবারের বাজেটে যে বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে, সেটা দেখে খোদ শিক্ষামন্ত্রী হতাশ হয়েছেন বলে মনে হয় । তিনি বলেছেন, যে বরাদ্দ পাওয়া গেছে, তাতে শিক্ষা খাতের উন্নয়নে লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম হবে না। বিগত পাঁচ বছরে খাতটিকে অনেক উপরে তুলে আনা হয়েছে। স্কুলে ভর্তি বৃদ্ধির কারণে এখন ১৯ কোটির পরিবর্তে ৩১ কোটি বই বিনামূল্যে দিতে হচ্ছে। কারিগরিতে ভর্তি সাত গুণ বেড়েছে। তার মতে, এই যে পরিবর্তন তা প্রাপ্ত অর্থে ধরে রাখা কঠিন হবে। কাজেই বাজেটে বরাদ্দ কম থাকলে প্রত্যাশিত লক্ষ্য কতটুকু অর্জন সম্ভব হবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে জাতীয় বাজেটের ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এটা আগের বাজেটের তুলনায় কম বলে এরই মধ্যে পত্রিকায় উঠে এসেছে (যুগান্তর, ০৭.০৬.১৪)অবশ্য বাজেটের ব্যয় বিভাজনে শিক্ষা ও প্রযুক্তি নামে সৃষ্ট খাতে চার মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ মিলিয়ে দেখানো হয়েছে ১৩ দশমিক শতাংশ। শেষ পর্যন্ত যদি এ খাতে সংশোধিত আকারে বরাদ্দ আর বাড়ানো না হয়, তাহলে নতুন অর্থবছরে শিক্ষার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অনেক কাজই করা যাবে না। পাশাপাশি শিক্ষকদেরও অনেক চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের অতীত হার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১০-১১, ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে সংশোধিত বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ১৪, ১১ দশমিক ৪ এবং ১১ দশমিক ১ শতাংশ। এরও আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সংশোধিত ব্যয়ই ছিল জাতীয় বাজেটের ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অবশ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা বেড়েছে। আর শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১৪ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্ক বাড়লেও জাতীয় বাজেট বৃদ্ধির তুলনায় সেটা কম। আর এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি যুক্ত করলে গড় বরাদ্দ আরো কমে যাবে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন। এসব দিক বিবেচনা করলে বোঝা যায়, আমাদের শিক্ষা খাতের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই। মোট কথা, জাতীয় বাজেটেও খাতটি উপেক্ষিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কি শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment