ঢাকা, রবিবার ১৫ জুন ২০১৪, ১ আষাঢ় ১৪২১, ১৬ শাবান ১৪৩
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষা
খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ, বাড়বে হতাশা
মো. মুজিবুর রহমান
যে সরকার শিক্ষার উন্নয়নের জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে
চলেছে বিগত কয়েক বছর ধরে, সেই সরকারের ঘোষিত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে কী
পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হবে তা নিয়ে আগ্রহ ছিল শিক্ষক,
শিক্ষার্থী,
অভিভাবকসহ
শিক্ষানুরাগী মানুষের মনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিকাংশই হতাশ হয়েছেন বরাদ্দের
পরিমাণ দেখে। এ হতাশার একটি রেখা ফুটে উঠেছে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে খোদ
শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায়। তিনি বলেছেন, যে বরাদ্দ পাওয়া গেছে তাতে শিক্ষা খাতের
উন্নয়নে লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম হবে না। বিগত পাঁচ বছরে এ খাতটিকে অনেক উপরে তুলে
আনা হয়েছে। স্কুলে ভর্তি বৃদ্ধির কারণে এখন ১৯ কোটির পরিবর্তে ৩১ কোটি বই
বিনামূল্যে দিতে হচ্ছে। কারিগরিতে ভর্তি সাত গুণ বেড়েছে। তার মতে,
এই যে পরিবর্তন
তা প্রাপ্ত অর্থে ধরে রাখা কঠিন হবে। কাজেই বাজেটে বরাদ্দ যদি কম থাকে তাহলে
প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না, সেটা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
ঘোষিত বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়,
শিক্ষা খাতে
বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে জাতীয় বাজেটের ১১ দশমিক ৬৬ ভাগ। এটা আগের বাজেটের
তুলনায় খুব কম বলে এরই মধ্যে পত্র-পত্রিকায় উঠে এসেছে। অথচ দেশের সামগ্রিক
উন্নয়নের জন্য শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো জরুরি ছিল। এ খাতে জাতীয়
বাজেটে বরাদ্দের অতীত হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১০-১১, ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে সংশোধিত বরাদ্দ ছিল
যথাক্রমে ১৪, ১১.৪ এবং ১১.১ ভাগ। এরও আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সংশোধিত ব্যয়ই ছিল জাতীয়
বাজেটের ১৪.৩ ভাগ। এবার এটা আরও কমেছে। যদিও পর্যালোচনায় দেখা যায়,
প্রস্তাবিত
বাজেটে চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা বেড়েছে। আর শুধু শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৫ হাজার
৫৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ১৪ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী
বরাদ্দের দিক থেকে মোট অর্থের পরিমাণ বাড়লেও মূল্যস্ফীতির তুলনায় তা গড়ে আরও কম
বলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,
বরাদ্দকৃত অর্থ
দিয়ে শিক্ষা খাতের অনেক দরকারি কাজই করা যাবে না। অপূর্ণ থেকে যাবে শিক্ষকদের বহু
চাহিদা। যেখানে সরকারের লক্ষ্য ছিল, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ
মানবসম্পদ সৃষ্টি করা, সেখানে এ অপ্রতুল বরাদ্দ দিয়ে কিভাবে তা সম্ভব হবে সেটা
প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যায়।
২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি এখনো পুরোপুরি
বাস্তবায়ন হয়নি। এরই মধ্যে প্রায় চার বছর পার হয়ে গেছে। এটা বাস্তবায়ন করতে হলেও
বিপুল পরিমাণ টাকার প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার
ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে শুধু টাকার অভাবে সন্দেহ নেই। পুরো শিক্ষা খাতকে
যেভাবে সরকার খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল
সেটাও বিঘ্নিত হবে বলে আমরা মনে করি। কারণ কম্পিউটার প্রযুক্তির সহায়তা বাড়ানো
এবং এ সেবার পরিধি বাড়াতে হলে দেশজুড়ে অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে;
দিতে হবে
কমমূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোয় সাধারণ
মানুষদের আগ্রহী করে তুলতে হলে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে প্রচুর
সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। উন্নত
দেশগুলো শিক্ষা খাতে প্রতিনিয়ত বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে। আমরাই শুধু ব্যতিক্রম। অবশ্য
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় শিক্ষা খাতে আমাদের বরাদ্দ একটু বেশি হলেও এটা
নিয়ে আত্মম্ভরিতার কিছু নেই। কারণ অনেক দেশ তাদের শিক্ষা খাতে জিডিপির যত অংশ
বরাদ্দ করে আমরা করি তার প্রায় অর্ধেক। যেমন- মালদ্বীপ বরাদ্দ করছে জিডিপির ৭.৫ শতাংশ আর ভুটান করছে ৪.৭ ভাগ। এ ছাড়া অনেক দেশই ৬-এর কাছাকাছি থাকছে। অথচ শিক্ষা খাতে
বরাদ্দের দিক থেকে আমরা এখনো আছি জিডিপিতে তিনের নিচে।
আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার অধিকাংশই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি প্রচেষ্টায়। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই নির্ভর করছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর। সরকারের তালিকাভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক, কর্মচারীদের বেতনভাতা সরকার থেকে দেয়া হলেও এদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা বাজেটে দেখা যায় না। তাদের জন্য কোনো উদ্দীপনামূলক কর্মসূচিও আমরা দেখছি না। তাহলে প্রশ্ন উঠে, যারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার বিশাল দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তাদের জন্য বাজেটে কী দিকনির্দেশনা থাকবে?
আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার অধিকাংশই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি প্রচেষ্টায়। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই নির্ভর করছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর। সরকারের তালিকাভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক, কর্মচারীদের বেতনভাতা সরকার থেকে দেয়া হলেও এদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা বাজেটে দেখা যায় না। তাদের জন্য কোনো উদ্দীপনামূলক কর্মসূচিও আমরা দেখছি না। তাহলে প্রশ্ন উঠে, যারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার বিশাল দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তাদের জন্য বাজেটে কী দিকনির্দেশনা থাকবে?
পাঠ্যবইয়ের উন্নয়ন, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার সংস্কার,
শিক্ষার্থীর
সংখ্যার বৃদ্ধির তুলনায় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ সৃষ্টি,
যথাসময়ে শিক্ষক
নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা, পদোন্নতি ইত্যাদির জন্যও বিপুল পরিমাণ
টাকার প্রয়োজন। টাকা ছাড়া শিক্ষা খাতের গুণগত মান উন্নয়ন
কঠিন। আর যদি সরকার শিক্ষা খাতে দুর্নীতির পরিমাণ আরো কমিয়ে আনতে পারে তাহলে
অর্থের কিছুটা সাশ্রয় সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত শিক্ষা
খাতের বিভিন্ন বিশেষায়িত পদে যোগ্য ও দক্ষদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে
শিক্ষায় দক্ষতা বাড়বে। আর কার্যসম্পাদনে দক্ষতা বাড়লেই প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব।
এসব দিক মনে রেখেই সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য আর্থিক বরাদ্দ বাড়াতে হবে
এবং নিশ্চিত করতে হবে দক্ষতাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা। তাহলে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের হতাশা
কিছুটা হলেও কাটবে বলে আমি মনে করি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.comhttp://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDZfMTVfMTRfMV80XzFfMTM3OTA2
No comments:
Post a Comment