নভেম্বর ২৯, ২০১৩,
শুক্রবার : অগ্রহায়ণ ১৫, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
অনিশ্চিত গন্তব্যে জাতির ভবিষ্যৎ
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর, ২০১৩
দেশের
রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। ধারণা করি,
রাজনীতিকরাও রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। সাধারণ মানুষও রাজনীতির
গতিপ্রকৃতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে
পড়ে খেটে খাওয়া মানুষদের যেন দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কৃষক-শ্রমিক থেকে আরম্ভ করে
শিক্ষক, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণী
ও পেশার মানুষের অধিকাংশই চরম দুর্ভাবনার মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন। স্কুল
শিক্ষার্থীরাও এখন আমাদের অস্থিতিশীল রাজনীতির নির্মম শিকার হচ্ছে। বছরের শেষ সময়ে
এসে তারা নিরাপদে পরীক্ষাও দিতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা তো একরকম অসহায় হয়ে আছেন
সহিংস রাজনীতির কাছে। উপর্যুপরি হরতাল ও অবরোধের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত
হয়ে পড়ছে। কিভাবে এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির হাত থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পাবে
সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে।
গত
২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। এর কিছুক্ষণ পরই দেশজুড়ে টানা অবরোধ
কর্মসূচিরও ঘোষণা দেয়া হয় প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের পক্ষ
থেকে। অবরোধ চলাকালে বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনায় বেশ কিছু লোক প্রাণ হারিয়েছে। এতে
মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে সন্দেহ নেই। সবার মনে প্রশ্ন, কী হতে যাচ্ছে
দেশে? শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে কি-না এমন
প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অভিভাবক ও
শিক্ষার্থীরা।
প্রতিটি
গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় নির্বাচন
অনুষ্ঠান একটি অপরিহার্য বিষয়। স্বীকৃত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত
শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে
যাওয়া সম্ভব হয়। গণতন্ত্রকে সুসংহত ও শক্তিশালী করতে হলেও দরকার নিয়মিত নির্বাচন
অনুষ্ঠান করা। নির্বাচন এমন এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার ব্যত্যয় ঘটলে দেশে বিপর্যয়
সৃষ্টি হয়; সর্বত্র দেখা দেয় বিশৃংখল পরিস্থিতি। শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত ও
আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব
হয় না। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রায়ই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। এ দেশে নির্বাচনের
সময় এলেই দেশজুড়ে দেখা দেয় অস্থিরতা। আরম্ভ হয় নানামুখী ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড।
হামলা-পাল্টাহামলা, জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর, হরতাল-অবরোধ দিয়ে দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়
এক রকম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এমনকি নির্বাচনের আগে ও পরেও ধ্বংসাÍক কর্মকাণ্ড
অব্যাহত থাকতে দেখা যায়। রাজনীতি নিয়ে বছরজুড়ে নানা ধরনের নেতিবাচক কর্মসূচি তো
থাকেই। এ ধরনের প্রবণতা জাতীয় উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
আমাদের
নির্বাচন নিয়ে শুধু দেশজুড়ে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এখন।
কয়েকদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টের আলোচনাতেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
ইইউর পার্লামেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার
আহ্বান জানিয়েছে। এ আহ্বান কতটুকু সফল হবে সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা
করতে হবে। কিন্তু তার আগে অস্থির রাজনীতি শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে
সেটা ভেবে দেখা দরকার আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই। কারণ রাজনীতিকে যতই
অগ্রাধিকার দেয়া হোক না কেন, শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শুধু রাজনীতির মাধ্যমে সামগ্রিক
উন্নয়ন সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিয়ে শতভাগ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ
থাকলেও শিক্ষাকে পর্যুদস্ত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। রাজনৈতিকভাবে
উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষার অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব কাজে লাগানোর চেষ্টা থাকতে হবে।
অথচ এখন দেখা যায়, শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত খাত হিসেবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
রাজনীতির যে অবস্থা তাতে যে কারও মনে হতে পারে, এর প্রভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা পঙ্গু
হতে আর বেশি দেরি নেই।
গুণগত
রাজনীতির অভাবে দেশ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এক রকম বিদায় নিতে যাচ্ছে বললে বাড়িয়ে
বলা হয় না। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা থেকে আরম্ভ করে যে কোনো
পর্যায়ের যে কোনো পরীক্ষার সময় এলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া যেন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে
দাঁড়িয়েছে। যে দেশে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে, সে দেশে
শিক্ষার গুণগত মান, ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কী অবস্থা, তা কাউকে বুঝিয়ে
বলার দরকার পড়ে না। ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষায় পাস করে যারা শিক্ষক হবেন,
তারা আমাদের জাতিকে কী শিক্ষা উপহার দেবেন সেটা কি আরও স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন
রয়েছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা থেকে আরম্ভ করে শিশুদের প্রাথমিক
সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে এবার। এর বাইরে আরও
অনেক পরীক্ষা রয়েছে, যেগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারেও অভিযোগ রয়েছে অনেক।
এখানে শুধু আক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন রাখব, আমরা কোন ধরনের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি-
সেটা কি এখনও ভেবে দেখার সময় হয়নি? কোথায় আমাদের নৈতিকতা? কোথায় মূল্যবোধ? কোথায়
সততা? কোথায় ন্যায়নীতি? যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ না হয়, যদি গুণগত শিক্ষার
মাধ্যমে নৈতিক ভিত্তি দৃঢ় না হয়, যদি আমাদের মূল্যবোধের উন্নয়ন না ঘটে, তাহলে
কিভাবে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব? এখন যেমন দেশে বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের
শাখা খোলার তৎপরতা শুরু হয়েছে, তেমনি হয়তো এমন একদিন আসবে যখন আমাদের
ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে হলে দেশেই বিদেশী শিক্ষক সরবরাহের প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে!
দেশের
রাজনীতির যে পরিস্থিতি তাতে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের উদ্বেগ বাড়ছে।
বছরের শেষ সময়ে এসে এখনও স্কুলগুলোর অনেক পরীক্ষা বাকি রয়েছে। স্কুল পর্যায়ের
পাবলিক পরীক্ষাও শেষ হয়নি। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা আরম্ভই হতে পারেনি। ডিসেম্বরের
প্রথম সপ্তাহের মধ্যে যাবতীয় পরীক্ষা শেষ করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো
পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ
পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে কয়েকদিন আগে। অনেক স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য
প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করা হয়ে গেছে। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনভাবে পরীক্ষার সময়সূচি
তৈরি করেছিল যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পরীক্ষা শেষ করা যায়। এখন হঠাৎ করে
অবরোধের মতো কর্মসূচি আসায় দেশজুড়ে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষা
কার্যক্রম পড়ে গেল এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে। এ অবস্থায় স্কুলগুলো নির্ধারিত
সময়ে পরীক্ষা শেষ করতে পারবে কি-না সেটা এখন আর নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ
ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কিভাবে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে যাবে, সেটা
প্রশ্ন হয়েই রইল আমাদের কাছে।
আমরা
কিছুতেই ভেবে পাই না, শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে, কোটি কোটি শিক্ষার্থীর
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিয়ে জাতি কোন দিকে যাত্রা করছে? বিশ্বে এমন
কোনো দেশের খোঁজ কি কেউ দিতে পারবেন, যে দেশে শিক্ষাকে অবহেলা করে শুধু রাজনীতির
মাধ্যমে উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে?
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং
কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment