ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর
২০১৩, ০৭ অগ্রহায়ণ ১৪২০, ১৬ মহররম ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন
মো.
মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশে
শিক্ষা বিকাশের প্রচেষ্টা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে
আরম্ভ করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার অধিকাংশই পরিচালিত হয়ে
আসছে বেসরকারি উদ্যোগে। শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যক্তি বা সংস্থার
উদ্যোগ যে এ দেশে একেবারে নতুন তা নয়। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই
বেসরকারিভাবে শিক্ষা বিকাশের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের প্রচেষ্টা শুধু
বাংলাদেশে নয়, উন্নত দেশেও দেখা যায়। কিন্তু সে সব দেশে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে
কোনো ছাড় দেয়া হয় না। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি থেকে যায়
উপেক্ষিত। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্নের শেষ নেই।
কিছুকাল
আগেও বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হতো সেগুলো
প্রকৃত অর্থেই ছিল মানসম্মত প্রতিষ্ঠান। তখন শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার মানসিকতা
প্রতিষ্ঠাতাদের কারোর মধ্যেই ছিল না। আগে স্থানীয় বিদ্যা অনুরাগী এবং বিত্তবান
শ্রেণির ব্যক্তিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে আসতেন উদারভাবে। তারা তাদের
এলাকার শিশুদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের ধন্য বলে মনে
করতেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে নিজস্ব জমিদান করতেন, নগদ টাকা-পয়সাও দিতেন
প্রতিষ্ঠানের তহবিলে। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। এখন আর আগের মতো নিঃস্বার্থভাবে
শিক্ষা বিকাশের প্রচেষ্টা খুব একটা দেখা যায় না। এখন যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
স্থাপন করছেন তাদের অধিকাংশেরই থাকে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার মানসিকতা। এ ধরনের
মানসিকতা প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়।
স্কুল পর্যায়ে দেখা যায়, যে সব ব্যক্তি নিজের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেছেন অথচ
কোথাও কোনো কর্ম জুটিয়ে নিতে পারেননি তাদের কয়েকজন মিলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেন এবং নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেন।
এভাবে প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে সরকারের শিক্ষা বিভাগের কোনো অনুমোদন না
থাকলেও তারা বিনাবাধায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে যান। বাস্তবে দেখা যায়, যেসব
প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারি অনুমোদন থাকে না সে সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত
শিক্ষার্থীরা ওই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না।
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এ ধরনের শিক্ষার্থীদের অন্য কোনো কাছাকাছি অনুমোদিত
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দেয়। এটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক
ধরনের প্রতারণা হলেও তা চলছে কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারে।
প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা জানিয়েছে, সারা
দেশে প্রায় ৭০ হাজার কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধন ছাড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। খোদ
রাজধানী ঢাকাতেই চলছে নিবন্ধনহীন প্রায় ২২ হাজার প্রতিষ্ঠান। এটা আমাদের কাছে
সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার, একই সঙ্গে চরম উদ্বেগেরও। শহরাঞ্চলে অনেক প্রতিষ্ঠান
স্থানীয়ভাবে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম
চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম পর্যায়ে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশের ট্রেড লাইসেন্সও
নেই। অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠান কিভাবে শিশুদের শিক্ষা দেয়ার অধিকার পেল এবং কী
পদ্ধতিতে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটাও দেখার কেউ নেই বলেই মনে হয়।
গত
বছরের শুরুর দিকে ওই মন্ত্রণালয় থেকে কিন্ডারগার্টেনগুলো নিবন্ধনের জন্য একটি
নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সেটার কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত কেবল কাগজপত্রের
মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ দেশে বিপুল সংখ্যক
কিন্ডারগার্টেন থাকলেও গত জুলাই পর্যন্ত মাত্র ২ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান সরকারি
নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে আবেদন করেছে বলে একটি পত্রিকায় খবর
বেরিয়েছে গত ২০ অক্টোবর। কিন্ডারগার্টেনগুলো নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য
বাস্তব পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। প্রায় বছর দেড়েক আগে সরকার নিবন্ধনের জন্য
নীতিমালা জারি করার পর এতো দীর্ঘ সময়েও কিন্ডারগার্টেনগুলো নিবন্ধন করেনি, এমনকি
নিবন্ধন করতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আগ্রহও দেখা যায়নি। এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার।
কিন্ডারগার্টেনে
শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের দিয়ে
শিশুদের পাঠদান করানো। শিশুদের পড়াতে হলে শিক্ষকদের অবশ্যই পেডাগজি বিষয়ে
প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। বাস্তবে অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেনে পাঠদানকারী শিক্ষকদের এ
ধরনের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। সরকারিভাবে এসব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার কোনো
ব্যবস্থাও দেশে চালু নেই। দেশের প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলো (পিটিআই)
সরকারি প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনে
কর্মরত শিক্ষকদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় তারা প্রশিক্ষণ ছাড়াই
কোমলমতি শিশুদের পড়িয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে সরকারেরও কোনো উদ্যোগ ও উদ্বেগ
দেখা যায় না। আমরা এখানে প্রস্তাব রাখব, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের শিশু
মনস্তত্ত্ব ও শিখন তত্ত্বের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হবে খুব দ্রুত। এ
উদ্দেশ্যে শিশু মনস্তত্ত্ব ও শিখন তত্ত্বে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকদের সহায়তায় প্রশিক্ষণ
ম্যানুয়াল প্রণয়ন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা কঠিন কিছু
নয়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment