Saturday, November 2, 2013

পোশাকশিল্পের সংকট উত্তরণ জরুরি



শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৩
(উপসম্পাদকীয়)
পোশাকশিল্পের সংকট উত্তরণ জরুরি
মো. মুজিবুর রহমান | তারিখ: ০২-১১-২০১৩
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি গার্মেন্ট খাত হলেও এটি এখন চরম সংকটে রয়েছে। বিভিন্ন পোশাক কারখানায় একের পর এক দুর্ঘটনা, উন্নত কর্মপরিবেশের অভাব, শ্রমিকদের নিম্নহারে মজুরি প্রদান, ঘন ঘন শ্রমিক অসন্তোষ, নানা ইস্যুতে কারখানা ভাংচুর, শ্রমিকের নিরাপত্তা রক্ষায় মালিকপক্ষের অবহেলা ইত্যাদি কারণে পুরো পোশাকশিল্প এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খাতটিকে পর্যায়ক্রমে দুর্বল ও স্থবির করে তুলেছে। এ বছরের শুরু থেকে হরতালের মতো কর্মসূচিতে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। পর্যাপ্ত গ্যাস ও প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের অভাবেও পণ্য উত্পাদন বিঘ্নিত হয়েছে বলে দাবি করছে বিজিএমইএ। বিদেশী ক্রেতারাও এ দেশে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন শুধু অনিরাপদ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে পোশাকশিল্পের ৩৫-৪০ শতাংশ অর্ডার অন্য দেশে চলে গেছে। গত বছর ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর দেশে ও বিদেশে খাতটি আরো ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে এগারো শর বেশি শ্রমিক নিহত ও বহু লোক আহত হওয়ার ঘটনা পোশাকশিল্পকে আরো অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ শিল্পে সংঘটিত এসব ঘটনা-দুর্ঘটনা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলছে ক্রমাগতভাবে।
পোশাকশিল্পে বিদ্যমান সংকটজনক অবস্থা পর্যালোচনার একপর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের অগ্রাধিকার প্রবেশাধিকার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে। বাংলাদেশ যেসব দেশে পণ্য রফতানি করে, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে রয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশ ২০১১-১২ অর্থবছরে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য, যা মোট রফতানির ২১ শতাংশ। আর জিএসপি সুবিধার আওতায় গত বছর রফতানি হয়েছে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের তামাক, খেলাধুলার সরঞ্জাম, চিনামাটির তৈরি তৈজসপত্র, পাটজাত দ্রব্য ও প্লাস্টিকসামগ্রীসহ অন্যান্য পণ্য। এসব পণ্য রফতানি করে শুল্ক ছাড় পাওয়া গেছে প্রায় ২০ লাখ ডলার। আমাদের পোশাকশিল্প আমেরিকার জিএসপি সুবিধাভুক্ত না হলেও মূলত রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যক্ষেত্রে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। জিএসপি সুবিধা স্থগিতের ফলে এ খাতে যুক্ত প্রায় ১০ হাজার উদ্যোক্তা এবং ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক বিপর্যয়ে পড়তে পারে। তা সত্ত্বেও আমাদের জন্য একটি আশার খবরও রয়েছে। ২১ অক্টোবর দৈনিক বণিক বার্তা খবর দিয়েছে, তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশী পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাশিয়া। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট ট্রেড কমিশন গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। এখন বাংলাদেশের উচিত হবে রাশিয়ার বিশাল বাজার ধরতে ভাষাগত সমস্যা দূর করে বাণিজ্যবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন। একই সঙ্গে ব্যাংকিং বাধা অপসারণ, শুল্ক সমস্যা নিরসন এবং অন্যান্য বাধা দূর করার মাধ্যমে বড় অর্থনীতির দেশ রাশিয়ার বাজারে প্রবেশের জোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের নতুন বাজার সৃষ্টি হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানি প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। সেখানে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জিএসপি সুবিধা পেলেও তৈরি পোশাক ছিল এর বাইরে। অথচ পোশাক খাতে ইউরোপে বাংলাদেশ শতভাগ জিএসপি সুবিধা পেয়ে আসছে। ফলে ওবামা প্রশাসন কর্তৃক জিএসপি সুবিধা স্থগিত করায় আপাত দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি বাণিজ্যে পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব ইউরোপের বাজারে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি বিদেশের অনেক বাজার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের গার্মেন্টপণ্যের ৬০ শতাংশ ইউরোপে রফতানি হয়। আর কানাডায় জিএসপির আওতায় পণ্য রফতানির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৮৫ কোটি ডলার আসে পোশাকশিল্প থেকে। আমেরিকার এ সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডাসহ অন্যান্য দেশ জিএসপি সুবিধা স্থগিত বা বাতিল করলে বাংলাদেশের রফতানি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। এ পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতি এবং পোশাকশিল্পের জন্য  উদ্বেগের।
বাংলাদেশের দুঃসময়ে পোশাক রফতানিকারক অন্যান্য দেশ বাজার ধরতে এখন জোর লবিং অব্যাহত রেখেছে। এক্ষেত্রে চীন ও ভারত অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানিকারক অন্যতম শীর্ষ দেশ ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াও কম চেষ্টা করছে না। গত ২০ জুন দৈনিক বণিক বার্তা ইঙ্গিত দিয়েছে, পোশাক খাতের আন্তর্জাতিক বাজারে নেতৃত্ব নিতে বড় পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ভারত। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতিসহ বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত।
পোশাকশিল্পে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার পেছনে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের বিপরীতমুখী চিন্তাভাবনার প্রভাব কোনো অংশে কম দায়ী নয়। এখানে এক পক্ষের রয়েছে কেবল ব্যবসা করার মানসিকতা। অন্য পক্ষের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়াস। সংকট সৃষ্টির পেছনে অদৃশ্য আরো কারণও বিদ্যমান। তবে উল্লেখযোগ্য একটি কারণ হলো, গার্মেন্ট শিল্পের বহু মালিকের উচ্চহারে মুনাফা অর্জনের চরিত্র এবং কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় অবহেলা প্রদর্শন। শ্রমিকদের দিন-রাত খাটিয়ে যে পরিমাণ বেতন-ভাতা দেয়া হয়, তা দিয়ে ভালোভাবে কোনো মানুষই সংসার পরিচালনা করতে পারবে না। এমনকি এ অর্থ দিয়ে জীবনযাত্রার ন্যূনতম মানও ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাদের বাসস্থানের অবস্থাও করুণ। ফলে শ্রমিকরা অসন্তুষ্ট হয়ে আন্দোলনের পথ বেছে নেন। তারা তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত দাবিদাওয়া আদায়ে আলোচনার পথে না গিয়ে প্রায়ই কারখানায় আক্রমণ চালান, ভাংচুর করেন নির্বিচারে। সংঘবদ্ধ হয়ে রাস্তা অবরোধসহ সাধারণ নাগরিকদের গাড়িও ভাংচুর করেন। অথচ ধংসাত্মক আন্দোলন করে যেমন কোনো সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যায় না। আক্রমণ ও ভাংচুরের মাধ্যমে শুধু জনগণের সম্পদেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রাণহানিরও শঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় শ্রমিক সংগঠনগুলোর মনে রাখতে হবে, যুক্তিসঙ্গত দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং আলোচনার বিকল্প নেই।
কথায় কথায় ভাংচুরের যে ধারা দেশে চালু হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে ঘোর অন্ধকার। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ভাংচুরের ঘটনা যে কেবল গার্মেন্ট কারখানাই ঘটছে, তা নয়; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি অফিস, রেলস্টেশন, দোকানপাট ও অন্যান্য স্থানে হামলা, ভাংচুর ও অবরোধের ঘটনাও প্রায় ঘটছে। এমনকি চিকিত্সাসেবা দেয়ার ক্ষেত্র সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকও বাদ যাচ্ছে না হামলার হাত থেকে। অসহিষ্ণু আচরণ এবং আক্রমণ ও হামলার মানসিকতা ক্রমাগতভাবে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে পেছনের দিকে। দাবি কিংবা অধিকার আদায়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ অনুসরণের দৃষ্টান্ত খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না দেশে।
মনে রাখতে হবে, পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা আগ্রহী হয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন; লাখ লাখ মানুষের জন্য কর্মের সুযোগ করে দিয়েছেন। কাজেই এ উদ্যোগ ও বিনিয়োগ যদি শুধু আন্দোলনের কারণে ধংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়, তাহলে এ ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসা ধরা ছাড়া উদ্যোক্তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। ফলে অস্তিত্বসংকটে পড়বে পোশাকশিল্প। এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই গার্মেন্ট খাতের অস্তিত্ব রক্ষায় শ্রমিকদের আরো সহনশীল আচরণ করতে হবে। অন্যদিকে মালিকদেরও শ্রমিকদের বেতনভাতা যৌক্তিকভাবে বাড়ানোসহ তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রমিকদের সন্তানরাও যাতে অভিভাবকের কর্মস্থলের কাছেই স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। দরকার হলে কিস্তিতে অর্থ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে শ্রমিকদের জন্য কারখানার আশপাশে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। শ্রমিকরা ভালো থাকলে কারখানা ভালো থাকবে— এটা মনে রাখতে হবে মালিকপক্ষকে। শ্রমিকদেরও মনে রাখতে হবে, কারখানা চালু থাকলে কর্ম অব্যাহত থাকবে। ফল হিসেবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment