ঢাকা, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৩, ১১ কার্তিক ১৪২০,
২০ জেলহজ্জ ১৪৩৪
(দৃষ্টিকোণ)
(দৃষ্টিকোণ)
শিক্ষাঙ্গন থাকুক রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে
মো.
মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশে
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গন আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠার উপক্রম
হয়েছে। এরই মধ্যে বড় রাজনৈতিক দলগুলো দেশের মানুষকে মোটামুটি এ রকম ধারণা দিয়েছে
যে, নির্বাচন নিয়ে নিজ নিজ দলের সিদ্ধান্ত অটুট রাখতে গিয়ে যা যা করা দরকার
প্রয়োজনে তা-ই করা হবে। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার
ব্যবস্থা নিয়ে নিজস্ব প্রস্তাব তুলে ধরেছে মানুষের সামনে। আমাদের মহান জাতীয়
সংসদেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখনও এ বিষয়ে কোনো সমঝোতার আভাস
পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষার সঙ্গে
জড়িত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসকদের উদ্বেগের শেষ নেই।
শিক্ষার্থীরা
উদ্বিগ্ন, তারা বছরের শেষ সময়ে এসে নির্বিঘ্নে বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে
পারবে কিনা তা নিয়ে। শিক্ষকরাও পরীক্ষা পরিচালনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। সবচেয়ে
বেশি উদ্বেগের মধ্যে আছেন অভিভাবকরা। তারা সন্তানের শিক্ষাজীবন নিয়ে সীমাহীন
উত্কণ্ঠার মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন। শিক্ষা প্রশাসকরাও কম উদ্বেগের মধ্যে নেই।
দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে স্কুল পর্যায় থেকে আরম্ভ করে
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপক বিঘ্নের মুখে পড়বে বলে এরই মধ্যে বিভিন্ন
মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে,
শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখতে। এমনকি পরীক্ষার সময়টিতে কোনো
ধরনের কর্মসূচি না দেয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু তারপরও
পরিস্থিতির ইতিবাচক উন্নয়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত
শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে কিনা তা-ও নিশ্চিত নয়।
আমাদের
স্কুল শিক্ষাবর্ষের সময়সীমা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দেশে শিক্ষাবর্ষ আরম্ভ
হয় জানুয়ারিতে এবং শেষ হয় ডিসেম্বর মাসে। চলতি বছরের শুরুতেই রাজনৈতিক কর্মসূচির
কারণে এসএসসি ও এইচএসসির মতো দুটি বড় পরীক্ষা বিঘ্নের মুখে পড়েছিল। তখন কয়েকটি
বিষয়ের পরীক্ষার সময়সূচি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল শিক্ষাবোর্ডগুলো। দেখা যায়,
বছরের প্রথম কয়েক মাস সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
পড়ালেখা বিঘ্নিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। ওই সময় বলতে গেলে শিক্ষার্থীরা একরকম অলসভাবে
দিন পার করেছে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা স্থিতিশীলতা বিরাজ
করছিল। ফলে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেয়েছিল। কিন্তু এখন আবার আগের মতো
রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষা
কার্যক্রম এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য
নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর নভেম্বরের ৪ তারিখ থেকে আরম্ভ হতে
যাচ্ছে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি)
পরীক্ষা। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা নভেম্বরের ২০ তারিখ। দেশের
সবচেয়ে বড় পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে পরিচিত পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ২০
নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে। জেএসসি ও জেডিসি
পরীক্ষায় প্রায় ২০ লাখ এবং প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় প্রায় ৩০ লাখ পরীক্ষার্থী
অংশগ্রহণ করার কথা। স্কুলগুলোর অষ্টম শ্রেণি ছাড়া অন্যান্য শ্রেণির বার্ষিক
পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার কথা রয়েছে ২১ নভেম্বর থেকে। এসব পরীক্ষা শেষ হওয়ার প্রায়
সঙ্গে সঙ্গেই প্রাথমিক স্তরের বার্ষিক পরীক্ষা আরম্ভ হবে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে
উচ্চশিক্ষা স্তরের পরীক্ষা সংক্রান্ত সময়সূচি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স কোর্সে ভর্তি পরীক্ষা আরম্ভ হবে নভেম্বরের ১ তারিখ। এরপর
পর্যায়ক্রমে একই মাসে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটভিত্তিক অবশিষ্ট ভর্তি পরীক্ষা
অনুষ্ঠিত হবে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হবে
নভেম্বর মাসেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স কোর্সে ভর্তি পরীক্ষা
ডিসেম্বর মাসে কিংবা তারও আগে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের
শিক্ষা ব্যবস্থার বেশিরভাগ পরীক্ষাই নভেম্বর ও ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ
জন্য এ দুটি মাসকে বলা হয়ে থাকে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মাস; স্কুলের ক্ষেত্রে বলা হয়
শিক্ষাবর্ষের সমাপনী মাস। কাজেই দেখা যায়, যদি নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রাজনৈতিক অঙ্গন
উত্তপ্ত থাকে এবং এর ফলে যদি দেশজুড়ে তীব্র অস্থিরতার সৃষ্টি হয় তাহলে এর নেতিবাচক
প্রভাব পড়বে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায়। বিপদের মুখে পড়বে প্রায় চার কোটি
শিক্ষার্থী। এসব দিক কি উদ্বেগজনক নয়? আমাদের আশঙ্কা, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক
পরিস্থিতির কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি
হবে, তেমনি পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায়ও স্থবিরতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ
অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে রাখতে হবে জাতীয় স্বার্থেই। আমরা
আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো এ দিকটি ভেবে দেখবে গভীর গুরুত্বের সঙ্গে।
উন্নত
দেশগুলোয় শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেসব
দেশে শিক্ষা কার্যক্রম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বাধাগ্রস্ত হয় না। অথচ আমাদের
শিক্ষা ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই। আমাদের পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তো প্রায় সারা বছরই বিরাজ করে রাজনৈতিক উত্তাপ। এ ধরনের
পরিস্থিতিতে শিক্ষার ধারাবাহিক উন্নয়ন ও গুণগত মান ধরে রাখা যে সম্ভব নয় তা
উপলব্ধি করতে হবে সবাইকে।
উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিরাপদ রাখার জন্য শিক্ষকসহ অন্যরা কতটুকু সচেতন থাকে তার একটি ছোট্ট উদাহরণ উল্লেখ করেই এ লেখা শেষ করব। নিউজিল্যান্ডের ওই কলেজে শব্দহীন ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে অ্যাসেসমেন্ট পরিচালনার ওপর যতটুকু গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তা দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। শুধু ওই একটি কলেজ নয়, আরও কয়েকটি স্কুল পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তাদের শিক্ষার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে পড়ালেখা করতে পারে সে ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষসহ রাষ্ট্রও অনেক যত্নশীল। অথচ আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে ও নির্ঝঞ্ঝাটে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হবে দূরের কথা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্লাসই করানো যায় না। এমনকি শিক্ষার্থীরা নিরাপদে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করবে এটাও অনেক সময় দুরূহ ও বিপদসংকুল হয়ে ওঠে সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে। এটাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নির্মম পরিহাসের ব্যাপার।
উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিরাপদ রাখার জন্য শিক্ষকসহ অন্যরা কতটুকু সচেতন থাকে তার একটি ছোট্ট উদাহরণ উল্লেখ করেই এ লেখা শেষ করব। নিউজিল্যান্ডের ওই কলেজে শব্দহীন ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে অ্যাসেসমেন্ট পরিচালনার ওপর যতটুকু গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তা দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। শুধু ওই একটি কলেজ নয়, আরও কয়েকটি স্কুল পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তাদের শিক্ষার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে পড়ালেখা করতে পারে সে ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষসহ রাষ্ট্রও অনেক যত্নশীল। অথচ আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে ও নির্ঝঞ্ঝাটে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হবে দূরের কথা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্লাসই করানো যায় না। এমনকি শিক্ষার্থীরা নিরাপদে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করবে এটাও অনেক সময় দুরূহ ও বিপদসংকুল হয়ে ওঠে সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে। এটাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নির্মম পরিহাসের ব্যাপার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment