Friday, May 16, 2014

পাঠদানের সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক গভীর



মে ১৬, ২০১৪, শুক্রবার : জ্যৈষ্ঠ ২, ১৪২১
(উপসম্পাদকীয়)
পাঠদানের সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক গভীর
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ১৬ মে, ২০১৪
আমরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের কাজ করতে গিয়ে কি কোনো ভুল করি না? আমরা কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের কাজের মধ্যে কোনো ভুল নেই? এমনটি কেউ দাবি করবেন না বলেই আমার ধারণা। বরং বলা যায়, ভুল করার মধ্য দিয়েই প্রতিটি কাজ পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলে। এক কথায়, ভুল করতে করতেই আমরা অনেক নতুন কিছু শিখে থাকি। শিক্ষার্থীরাও পড়ালেখা করতে গিয়ে নানা রকম ভুল করে এবং বারবার চেষ্টা চালিয়ে ভুলগুলো সংশোধনের মাধ্যমে তারা শেখার কাজটি সম্পন্ন করে। ঠিক এ ধারণাটিই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের সামনে তুলে এনেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ই এল থর্নডাইক। তিনি যে পদ্ধতির কথা বলেছেন, সেটা শিখনে ভুল ও প্রচেষ্টা পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত।
থর্নডাইক প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন এবং বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন, কোনো কিছু করার জন্য প্রাণী বারবার চেষ্টা করে এবং প্রতিবারই কিছু না কিছু ভুল করে। পরবর্তীকালে ওই প্রাণী তার ভুলগুলো সংশোধন করে ধীরে ধীরে সঠিক আচরণ বা নির্ভুল প্রতিক্রিয়া করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এভাবেই বারবার চেষ্টা এবং ভুল সংশোধন করার মাধ্যমে শিখন সম্পন্ন হয়। এটা প্রমাণ করার জন্য থর্নডাইক বিড়াল নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষণ করেন এবং কয়েকটি সূত্র উদ্ভাবন করেন। এসব সূত্রকে শিখনের সূত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তার উদ্ভাবিত শিখনের প্রধান সূত্রগুলো হল- ১. প্রস্তুতির সূত্র, ২. অনুশীলনের সূত্র ও ৩. ফল লাভের সূত্র।
থর্নডাইকের মতে, শিখনের জন্য শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতির গুরুত্ব শুধু শিখনের ক্ষেত্রে নয়, বরং মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। সাঁতার শেখা কিংবা খেলার মাঠ থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার পর্যন্ত সর্বত্র ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক উপযুক্ততার গুরুত্ব অপরিসীম। এ গুরুত্বকে উপেক্ষা করে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়।
পড়ালেখার ক্ষেত্রে অনুশীলনের গুরুত্বও অপরিসীম। কোনো শিক্ষার্থী যদি তার পড়ার কোনো একটি বিষয়ের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু শেখার পর দীর্ঘদিন অনুশীলন না করে, তাহলে একসময় তা ধীরে ধীরে ভুলে যায়। এটা ঘটে ওই বিষয়বস্তুর সঙ্গে শিক্ষার্থীর পুনঃপুনঃ সংযোগ না হওয়ার কারণে। আবার যখন ওই শিক্ষার্থী আগের শেখা বিষয়বস্তু নতুন করে শিখতে আরম্ভ করে তখন পুরনো হলেও সেটা আয়ত্তে আনতে তার বেশ কিছু সময় লাগে। অথচ শিক্ষার্থী যদি মাঝে মধ্যেই ওই বিষয়বস্তু চর্চা করত, তাহলে পরবর্তীকালে পুনঃশেখায় (রি-লার্নিং) তার সময় কম লাগত। সে জন্য শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু বারবার অনুশীলন করলে তা শিক্ষার্থীর কাছে স্থায়ী হয়। অবশ্য থর্নডাইকের সূত্রের সমালোচকরা বলেন, শুধু অনুশীলনের ওপর স্থায়ী শিখন নির্ভর করে না। কারণ আগ্রহ, মনোযোগ, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদিও শিখন স্থায়ী করায় প্রভাব রাখে।
শিখনের সঙ্গে আনন্দের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে বই পড়তে শিক্ষার্থীর ভালো লাগে সেটা সে বারবার পড়তে চায়। আর যেটা ভালো লাগে না, তা কখনোই পড়তে চায় না বা একান্ত বাধ্য হয়ে কম পড়ে। এজন্য শিক্ষার্থীর ওপর কোনো বিষয় জোর করে চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অধিক কঠিন বলে মনে হয়। ফলে তারা এসব বিষয় পড়তে অনাগ্রহ বোধ করে। আবার যেসব বিষয় তারা সহজ বলে মনে করে সেগুলো বারবার পড়ে। গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজি ও গণিতে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এর বড় কারণ হল- তারা এ দুটি বিষয় ভালোভাবে বুঝতে পারে না। এমনকি তাদের কাছে এগুলো সহজভাবে তুলেও ধরা হয় না। কিন্তু যদি কঠিন বিষয়বস্তু উপযুক্ত উপকরণ সহযোগে তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক সামগ্রী ব্যবহার করে শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করা হতো, তাহলে অন্য বিষয়গুলোর মতো এসব বিষয়েও তারা আগ্রহী হয়ে উঠত। সুতরাং দেখা যায়, পড়ার বিষয়গুলো যদি আনন্দদায়ক হয় বা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারে তাহলে তাদের শিখন ত্বরান্বিত হয়।
থর্নডাইকের শিখনের সূত্রগুলো আলোচনা করলে দেখা যাবে, প্রথম সূত্রটি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহুলাংশে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। কারণ আলোচ্য সূত্রানুসারে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকলেই তাদের কাছে শিখন সহজ ও আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। অথচ আমাদের স্কুলগুলোয় এ দিকটির প্রতি কোনো গুরুত্বারোপ করা হয় না বললেই চলে। বরং দেখা যায়, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে একটানা ক্লাস করার কারণে দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত থাকছে। বহু শিক্ষার্থী দুপুরে খাওয়ার সুযোগ পায় না। খুব সকালে শিক্ষার্থীরা যখন স্কুলে আসে তখনও যে তারা ভালোভাবে খেয়ে আসতে পারে তা নয়। সুষম ও পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে তাদের প্রায় সবাই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। ফলে শ্রেণিকক্ষে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের পরিস্থিতি বেশি দেখা যায়। শুধু তাই নয়, স্কুলগুলোয় পাঠদানে কোনো বৈচিত্র্যময় শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশল অনুসরণ করতে দেখা যায় না। এমনকি পাঠদানকালে তাদের পূর্বপ্রস্তুতি ও মানসিক সামর্থ্যরে দিকেও কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না। এছাড়া আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক এখনও গতানুগতিক পদ্ধতিতে পাঠদান করেন। তাদের কাছে বক্তৃতা পদ্ধতি বেশি পরিচিত। এ কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সব সময় একঘেয়েমিতে ভোগে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে গুণগত শিক্ষার স্বার্থেই।
একই সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্যের দিকটি বিবেচনা করতে হবে, অন্যদিকে তাদের একঘেয়েমি দূর করার জন্য স্কুলের সময়সূচিতেও পরিবর্তন আনা জরুরি। এছাড়া পাঠদান আনন্দদায়ক করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক সামগ্রী ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে শ্রেণিকক্ষে যদি কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ইত্যাদি ব্যবহার করে পাঠদানের বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে তারা পাঠ গ্রহণে সক্রিয় হয়ে উঠবে, যা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। উন্নত দেশগুলোর স্কুলে তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক কলাকৌশল ব্যবহার করে পাঠদান করা হয় বহু আগে থেকেই। এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
প্রসঙ্গত সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের স্কুলে মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট ব্যবহারে সরকারের প্রচেষ্টার উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের সরকারিভাবে মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরি ও শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারে সক্ষম করে গড়ে তোলা এ প্রশিক্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রশিক্ষণ যতই দেয়া হোক না কেন, শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া যদি আনন্দদায়ক না হয় তাহলে সব আয়োজন ব্যর্থ হবে। কাজেই শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া আনন্দদায়ক করে তুলতে হলে শ্রেণিকক্ষে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সামগ্রী ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
থর্নডাইকের দ্বিতীয় সূত্রের ধারণা, আমাদের স্কুলগুলোর শ্রেণিকক্ষে যুগ যুগ ধরে প্রয়োগ হয়ে এলেও ততটা কার্যকরভাবে হচ্ছে না। এটা ঠিক যে, আমাদের তখনকার স্কুল শিক্ষকরা শিখনের বিষয়বস্তু বারবার লেখার জন্য বলতেন। এমনকি কোনো একটা বিষয় তারা ক্লাসরুমেই লেখাতেন। এটাকে থর্নডাইকের সূত্রানুসারে অনুশীলন বলা যায়। তবে শুধু অনুশীলন শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে না। অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, শুধু অনুশীলনের মাধ্যমে কার্যকর শিখন সম্ভব নয়। তাদের মতে, কার্যকর শিখনের জন্য অনুশীলনের পাশাপাশি পাঠের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও মনোযোগ থাকা দরকার। এক্ষেত্রে বলা যায়, শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পাঠে আগ্রহ ও মনোযোগ সৃষ্টির জন্য মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। থর্নডাইকের শিখনের সূত্রের সঙ্গে বর্তমান আইসিটিভিত্তিক ক্লাসরুমের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। শ্রেণিকক্ষে কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ব্যবহৃত ছবি, ভিডিও ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। এ উদ্দীপনার মাধ্যমেই পাঠের বিষয়বস্তুর প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া ঘটে বা এর সঙ্গে তাদের মানসিক সংযোগ সাধন হয়। এটা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই সম্ভব।
থর্নডাইকের তৃতীয় সূত্রটি আমাদের দেশে তেমন জোরালোভাবে প্রয়োগ করা হয় না। কারণ এখনও আমাদের বহু স্কুলে পড়া না পারলে বা অন্য কোনো কারণে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগেই নির্দেশ জারি করলেও এখনও বিভিন্ন স্কুলে তাদের নানা রকম শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে। কখনও কখনও তাদের ভর্ৎসনাও করা হয়। ভর্ৎসনা হল এক ধরনের মানসিক শাস্তি। এ ধরনের প্রবণতা শিক্ষার্থীদের শিখনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শাস্তি আরোপ করে পাঠ গ্রহণে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করা যায় না। কোনো কিছু শেখানোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য শাস্তি আরোপের পরিবর্তে পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। এ পুরস্কার যে কেবল দ্রব্যসামগ্রী হতে হবে তা নয়। বরং শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আকর্ষণীয় ভাষা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে পারেন। তাহলে এটা শিক্ষার্থীদের কাছে এক ধরনের ফল বা পুরস্কার হিসেবে কাজ করবে।
আমাদের স্কুলগুলোয় শিখনে ভুল ও প্রচেষ্টা পদ্ধতির কার্যকর ও সার্থক প্রয়োগ করতে হলে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণ অপরিহার্য। কারণ শ্রেণিকক্ষে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমেই বিষয়বস্তুর বহুমাত্রিক উপস্থাপন সম্ভব। পাঠের এমন অনেক বিষয়বস্তু রয়েছে যেগুলোর সঠিক ধারণা শিক্ষার্থীদের দিতে হলে বাস্তব উপকরণ ব্যবহার করা দরকার, অথচ অনেক সময় নানা কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে শিক্ষার্থীদের শিখনও আশানুরূপ হয় না। এ ধরনের পরিস্থিতির অবসান ঘটানো জরুরি। এটা করা যায় শ্রেণিকক্ষে থর্নডাইকের শিখনের সূত্র এবং তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বিত ব্যবহারের মাধ্যমে।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment