শনিবার মে ১০, ২০১৪ বৈশাখ ২৬, ১৪২১
(উপসম্পাদকীয়)
কেন এই
অসহিষ্ণু আচরণ?
মো. মুজিবুর রহমান
দেশের সর্বোচ্চ
বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে গেল দুটি নৃশংস
হত্যাকাণ্ড। একটি ঘটেছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে। এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সায়াদ ইবনে মোমতাজকে নির্মমভাবে পিটিয়েছেন তারই
সহপাঠীদের কয়েকজন মিলে। পরে তার মৃত্যু হয় স্থানীয় এক ক্লিনিকে। নিহত সায়াদ নিজে
এবং যারা তাকে পিটিয়েছেন তারা উভয়েই একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মী বলে গণমাধ্যমে খবর
এসেছে। তবে সায়াদ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারণ যাই থাকুক না কেন, এটা যে ওই রাজনৈতিক
সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ঘটেনি, তা মোটামুটি নিশ্চিত। এ হত্যাকাণ্ডের
বিচারের দাবিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে
তুলেছেন। তাদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ উত্তাল হয়ে আছে। এরই মধ্যে
সায়াদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তিন ছাত্রকে আজীবন এবং বাকি কয়েকজনকে
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে
সিন্ডিকেটের এক সভায়। কিন্তু খুনের মতো ঘটনার অভিযোগে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
কয়েক বছরের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন আন্দোলনরত
সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে
ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং একপর্যায়ে প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগিয়ে দেন। এর
পরদিন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মারক বিজয় ’৭১-এর পাদদেশে সমবেত হয়ে বহিষ্কৃত ছয় শিক্ষার্থীর বাকি চারজনকে
গ্রেফতার এবং নতুন কমিটি করে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে সব অপরাধীকে শাস্তির আওতায়
নিয়ে আসার দাবি জানিয়ে প্রশাসনকে আলটিমেটাম দেয় ।
এদিকে অভিযুক্তদের
বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাদের উপযুক্ত বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান
আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন শিক্ষকরাও। তারা কয়েকটি দাবি উত্থাপন করে প্রশাসনকে
আলটিমেটাম দিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকাগুলো বলছে। শিক্ষকদের উত্থাপিত দাবিগুলো হলো— ১. নতুন কমিটি গঠন করে যথাযথ তদন্ত, ২. দায়িত্বে অবহেলার জন্য
ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা, প্রক্টরিয়াল বডি ও আশরাফুল হক হলের প্রভোস্টকে অপসারণ, ৩. ঘটনার
পুনরাবৃত্তি রোধে টাস্কফোর্স গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং
৪. পুলিশি তদন্তের অগ্রগতি সবাইকে জানানো। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সায়াদ হত্যাকাণ্ড
নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এখন কার্যত অচল হয়ে আছে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ওই
বিশ্ববিদ্যালয় কত দিন অচল থাকবে, সেটা বলা মুশকিল। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি যাই
হোক না কেন, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় খুনখারাবির মতো নৃশংস ঘটনা চিরতরে
বন্ধ হবে কিনা; সেটাই হলো আসল প্রশ্ন।
অন্যদিকে দেখা যায়, সায়াদ হত্যাকাণ্ডের পরপরই আরেক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র রুস্তম আলী আকন্দ আবাসিক হলে নিজের কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ৪ এপ্রিল দুপুরে। তিনিও এক ছাত্র সংগঠনের নেতা ছিলেন বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে এ হত্যা মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রুস্তম হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েও বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে না।
অন্যদিকে দেখা যায়, সায়াদ হত্যাকাণ্ডের পরপরই আরেক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র রুস্তম আলী আকন্দ আবাসিক হলে নিজের কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ৪ এপ্রিল দুপুরে। তিনিও এক ছাত্র সংগঠনের নেতা ছিলেন বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে এ হত্যা মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রুস্তম হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েও বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে না।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডে দেশের সাধারণ মানুষ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা কিছুতেই ভেবে
পাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কী করে অসহনশীল হয়ে নিজেদের সহপাঠীকে হত্যা করার
মতো নৃশংস ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে পারেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সায়াদ হত্যাকাণ্ডে
জড়িয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে, তারাও একই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। সায়াদের সঙ্গে
নাকি তাদের কারো কারো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও ছিল। তারা সায়াদের কাছের বন্ধু হয়েও কী করে
তাকে পিটিয়ে মারলেন—
এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সায়াদ ও রুস্তমের অভিভাবকরা কি কোনোদিন ভেবেছিলেন, তাদের
আদরের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাশ হয়ে ফিরবে? প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে
আর কত সায়াদ ও রুস্তমদের নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হবে? এ ধরনের নৃশংসতার শেষ কোথায়?
দেশের দুটি পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে পর পর দুটি নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর উচ্চশিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠেছে। একই সঙ্গে
প্রশ্ন ওঠেছে ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎনিয়েও। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররাজনীতি
চালু থাকবে কি থাকবে না— এ নিয়ে
বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন, নিরাপদ শিক্ষা ব্যবস্থার
স্বার্থেই সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেয়া জরুরি। আবার কেউ
কেউ বলছেন, ছাত্ররাজনীতি চালু থাকলেও ক্ষতি নেই, যদি তা দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি
ভিত্তিক না হয়।
এখানে বলা দরকার,
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের মধ্যে প্রায়ই যেসব সংঘর্ষ ঘটতে দেখা যায়;
সেগুলো যে সবসময় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবে ঘটে, তা নয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে
এসব ঘটনার সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও থাকে না। বরং অনেক সময় খুব
তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবং পরে তাতে রাজনৈতিক
মেরুকরণ করার চেষ্টা নেয়া হয়। কখনো দেখা যায়, সামান্য কারণে শিক্ষার্থীদের একটি
অংশ অসহনশীল হয়ে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিপক্ষের ওপর। অনেক সময় তারা এতটাই
মারমুখী হয়ে ওঠেন যে, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য পুলিশকে অভিযান চালাতে হয়। এমন
একটি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে গত বছরের ২৪ নভেম্বর ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছিল রাজশাহী কলেজে।
ভর্তি পরীক্ষার আবেদনপত্র জমা দেয়ার সময় লাইনে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে ওই কলেজে
দুটি ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে ঘটে সশস্ত্র সংঘর্ষ। ওই সংঘর্ষে অনেক নেতাকর্মী
আহত হন। কলেজ ক্যাম্পাসে দীর্ঘ সময় ধরে চলে হামলা-পাল্টা হামলা। ফলে তখন প্রশাসনিক
ভবন এলাকা একরকম রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কলেজের প্রশাসনিক ভবনে
ভাংচুরও চালানো হয়। হোস্টেলেও হামলা চালিয়ে ভাংচুর এবং পরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা
ঘটানো হয়। তখনকার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে স্পষ্টতই দেখা গেছে,
বিবদমান ছাত্রদের অনেকের হাতে মারাত্মক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। তারা এসব অস্ত্র নিয়ে
প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করার উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছেন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি
নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ এগিয়ে আসে এবং ফাঁকা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। সন্দেহ নেই, এসব
ঘটনা অসহনশীল আচরণের বহিঃপ্রকাশ।
আলোচ্য পরিস্থিতিতে বলতে
দ্বিধা নেই, আমাদের অনেকের মধ্যে সহনশীল আচরণের বড় অভাব দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে
তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসহিষ্ণু আচরণের মাত্রা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আজকাল
তাদের বেশির ভাগ খুব সহজেই বিক্ষুব্ধ আচরণ করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। কেন তাদের
আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে সমাজবিজ্ঞানীদের। একই
সঙ্গে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার
জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি
টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment