ঢাকা,
বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ৮ ফাল্গুন ১৪২০, ১৯ রবিউস সানী ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
ভাবতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে
মো.
মুজিবুর রহমান
বিগত
কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে মহাজোট সরকার অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। এসব সাফল্যের
মধ্যে রয়েছে, স্কুলে গমনোপযোগী শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রথম শ্রেণি থেকে নবম
শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে কোটি কোটি বই বিতরণ, শিক্ষা বছরের
প্রথমদিন পাঠ্যপুস্তক উৎসব উদযাপন, মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য
বৃত্তির সংখ্যা বাড়ানো, নির্ধারিত সময়ে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ এবং যথাসময়ে ফলাফল
প্রকাশ ইত্যাদি। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন, শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন,
শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি, বহু শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বাংলা ও ইংরেজি
ভার্সনের সব পাঠ্যবইয়ের ই-বুক উন্নয়ন করে তা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক
বোর্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড করা, দেশের শ্রেষ্ঠ স্কুলের শ্রেণিকক্ষের পাঠদান
বাংলাদেশ টেলিভিশনে সপ্তাহে তিনদিন সম্প্রচারের ব্যব্যস্থা করা সরকারের সাফল্যের
অন্যতম দিক।
এসব
ছাড়াও শ্রেণিকক্ষে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল কনটেন্ট উপস্থাপনের জন্য
হাজার হাজার স্কুলে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে মাধ্যমিক
স্কুলগুলোর কয়েক লাখ শিক্ষককে পেশাগত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন চলছে শিক্ষকদের
জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কম্পিউটার,
ইন্টারনেট ও মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে কিভাবে পাঠদানের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের
কাছে সহজ ও আকর্ষণীয় করে তোলা যায় তা শিক্ষকদের শেখানো হচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে
এতকিছু করার পরও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা নিয়ে সংকট যেন কাটছে না। এখানে কয়েকটি দিক
নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
মাধ্যমিক
শিক্ষা স্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২
প্রণয়ন সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল। এ নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রকাশে আমরা
আশা করেছিলাম, দ্রুতই কোচিং ব্যবস্থা বন্ধ হবে। অথচ তা হয়নি। ফলে এর যথাযথ
বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো অনেক সংশয় রয়েছে। দীর্ঘদিন আগে এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও
তা এখনো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এসব কোচিং সেন্টারের সঙ্গে
স্কুলে কর্মরত অনেক শিক্ষকের জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। তবে এর চেয়েও উদ্বেগজনক
ব্যাপার হলো, স্কুলের শিক্ষক ছাড়া কোচিং সেন্টারগুলোয় যারা পড়ান তাদের
অধিকাংশেরই আধুনিক পাঠদান পদ্ধতি ও কলাকৌশল এবং পেডাগজি সম্পর্কে কোনো
প্রশিক্ষণ নেই। ফলে কোচিং সেন্টারে গমনকারী শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করার প্রবণতা
থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। দেখা যায়, সরকার স্কুল শিক্ষকদের মাঝে মাঝে
বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। স্কুল শিক্ষকদের দিয়ে শিশুদের পড়ানো এবং কোচিং
সেন্টারে জড়িত প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তিদের দিয়ে পড়ানোর মধ্যে অনেক পদ্ধতিগত
পার্থক্য বিদ্যমান। এ পার্থক্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে শিক্ষার গুণগত মানের। এর ফলে
মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় পরীক্ষায় পাসের হার
বাড়লেও গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন ঠিকই থেকে যায়। কার্যত এটা দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির
অন্যতম অন্তরায় বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কাজেই বাস্তব পরিস্থিতিতে কোচিং
সেন্টারগুলো নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
এখানে
গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় শিক্ষক সংকট, প্রয়োজনীয়
শিক্ষা উপকরণের অভাব, বহু স্কুলের অবকাঠামোগত দুর্বলতা, স্কুলগুলোয় আধুনিক বিজ্ঞানাগার
না থাকা ইত্যাদি দিকগুলো মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান বিঘ্নিত করছে ব্যাপকভাবে।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ৩২৩টি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের
মধ্যে ২১৩টি স্কুলেই প্রধান শিক্ষক নেই এবং ৪৪৬টি সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদের
মধ্যে খালি আছে ১৩৭টি। আবার যে সব শিক্ষক প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত রয়েছেন, তাদের
অনেকেই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে সন্দেহ নেই, প্রকৃত শূন্য পদের
সংখ্যা আরো বেশি হবে। একই তথ্যে জানা গেছে, স্কুলগুলোয় সহকারী শিক্ষকের পদ খালি
আছে এক হাজার ৫৩২টি। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব শূন্য পদ দ্রুত পূরণের পদক্ষেপ
গ্রহণ করছে বলে খবরও রয়েছে। কিন্তু আমরা ভেবে পাই না, মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় এতো
বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য রেখে শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া
কিভাবে সম্ভব? স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ না থাকলে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে
শেখার সুযোগ পাবে না। বিজ্ঞানাগার না থাকলে শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
গঠিত হবে না। আর লাইব্রেরি না থাকলে বই পড়ায় তাদের আগ্রহ বাড়বে কিভাবে? মাধ্যমিক
শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের স্বার্থেই এসব দিক ভেবে দেখতে হবে। একই সঙ্গে
স্কুলগুলোর পাঠদান কার্যক্রম সুপারভিশন ও মনিটরিং করার ব্যবস্থাও নিতে হবে
জরুরিভিত্তিতে।
লেখক
: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment