ঢাকা, শনিবার,
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪,
২৬ মাঘ ১৪২০,
০৭ রবিউস সানী ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
মেডিক্যাল শিক্ষার মানে কোনো ছাড়
নয়
মো. মুজিবুর রহমান
নবগঠিত মহাজোট সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ
মন্ত্রণালয় বেশ শক্তভাবেই স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে বলে মনে
হচ্ছে। মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ওই মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি যে সব
পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলো এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে
এমবিবিএস কোর্সে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা না দেখানোর জন্য
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃঢ় অবস্থান লক্ষ্য করে আমরা চিকিৎসা-শিক্ষার মান নিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করছি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা
করলে দেখা যায়, গত বছরের শেষ দিকে এসে যে ১২টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের
অনুমোদন দেয়া হয়েছিল তা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানুয়ারি মাসের তৃতীয়
সপ্তাহে। শুধু তাই নয়, নতুন করে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি
আরোপেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায়। এমনকি
সরকারি অনুমোদন নিয়ে যে সব মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ চালু রয়েছে সেগুলো প্রচলিত
নীতিমালা যথাযথভাবে মেনে চিকিৎসা-শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে কি-না তাও তদন্ত করে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়া
হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয় হলেও সেগুলো
পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কিনা এমন দ্বিধাও রয়েছে অনেকের মনে। এবার কী হয়
সেটা দেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। অনেকের জানার আগ্রহ রয়েছে,
মাত্র কয়েক মাস
আগে দেয়া ১২টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন স্থগিতের সিদ্ধান্ত কেন নিতে
হলো নতুন সরকার গঠনের কয়েক দিনের মধ্যেই। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়,
বেসরকারি
মেডিক্যাল কলেজের মালিকরা চলতি শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির জন্য
মেধাস্কোর কমিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে। বাংলাদেশ বেসরকারি ডেন্টাল
কলেজ অ্যাসোসিয়েশন ভর্তির জন্য বর্তমানে প্রচলিত স্কোর ১২০ থেকে কমিয়ে ১০০ করার
দাবি উত্থাপন করেছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত
মেডিক্যাল শিক্ষা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন কেউ
কেউ বলছেন, ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় স্কোর বেশি হয়ে যাওয়ায় পর্যাপ্ত
সংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক মেডিক্যাল কলেজ নাকি বন্ধ হয়ে যাওয়ার
উপক্রম হয়েছে! তাদের মতে, মেধাস্কোর কমিয়ে দিলে শিক্ষার্থী পেতে তেমন কোনো সমস্যা
হবে না।
এখানে বলা দরকার, মেধাস্কোর কমিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থী
আকর্ষণের যে বিস্ময়কর প্রস্তাব রেখেছেন মালিকরা তা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে
না। আমরা মনে করি, চিকিৎসা-শিক্ষার সর্বোচ্চ মান বজায় রাখার স্বার্থেই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে
মেধাস্কোর নিয়ে কোনো ছাড় দেয়া সমীচীন নয়। কারণ এ শিক্ষার সঙ্গে শুধু সেবামূলক
বৈশিষ্ট্যই জড়িত রয়েছে তা নয়, বরং এর সঙ্গে অসুস্থ মানুষের বেঁচে থাকার বিষয়টিও জড়িত।
উচ্চমানের মেধাবী চিকিৎসক তৈরি করতে না
পারলে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হবে সন্দেহ নেই। এমনকি এ মূল্য জীবন দিয়েও দিতে হতে
পারে। কাজেই শেষ পর্যন্ত মেডিক্যাল শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে যদি মেধাস্কোর কমিয়ে
দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে সেটা আত্মঘাতী হবে বলে আমরা মনে করি। বরং মেধাবী
চিকিৎসক তৈরির জন্য শিক্ষার্থী বাছাই প্রক্রিয়া আরো কীভাবে উন্নত করা যায় সেটাই
এখন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা জরুরি। একই সঙ্গে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোয়
ভর্তির জন্য উচ্চহারে ফি আদায়ের প্রবণতা বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কারণ অনেকের
ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধু ভর্তির জন্য ১৫-২০ লাখ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয় না। ফলে
মেডিক্যাল শিক্ষায় পড়তে আগ্রহীরা এসব কলেজে ভর্তি হতে পারে না।
আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সবাই
জানেন, উন্নত
চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার রোগী বিদেশে গমন করেন। এর
মধ্যে বেশিরভাগ রোগী যান প্রতিবেশী দেশ ভারতে। থাইল্যান্ড,
সিঙ্গাপুর,
লন্ডন,
আমেরিকাতেও যান
অনেক রোগী। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে উন্নত ও ঝামেলামুক্ত চিকিৎসা-সেবা না পাওয়ার কারণেই রোগীরা বিদেশমুখী
হন। অনেক সময় চিকিৎসক এবং এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত
রয়েছেন তাদের কাছ থেকেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না। সরকারি হাসপাতালে গিয়েও
সাধারণ রোগীদের অনেক সময় পোহাতে হয় নানা ধরনের দুর্ভোগ। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগও ওঠে প্রায়ই। ফলে দেশে
চিকিৎসা করানো নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। এসব কারণে যাদের
সামর্থ্য রয়েছে তারা যান বিদেশে, আর সামর্থ্যহীন দরিদ্র শ্রেণির সাধারণ রোগীরা দেশেই
চিকিৎসা নেয়ার চেষ্টা করেন। এসব সমস্যার দিকেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দৃষ্টি দিতে
হবে। দেশের স্বার্থেই মানসম্মত ও মেধাবী চিকিৎসক তৈরির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং
চিকিৎসা সেবার গুণগত মানও বাড়াতে হবে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার প্রতি সাধারণ মানুষের
আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সব ধরনের চিকিৎসা কেন্দ্রে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যারা অনেক মেধা,
শ্রম ও অর্থ খরচ
করে চিকিৎসক হন তাদের জন্যও বাড়াতে হবে সুযোগ-সুবিধা। চিকিৎসা পেশাকে সমাজে মর্যাদাসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে
রাষ্ট্রীয়ভাবে।
লেখক :
সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment