Friday, February 14, 2014

সুযোগ দিন মেধার ভিত্তিতে



শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
(উপ-সম্পাদকীয়)
মেডিকেল শিক্ষা
সুযোগ দিন মেধার ভিত্তিতে
মোঃ মুজিবুর রহমান
২০১৩ সালের শেষ দিকে ১২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এখন সেসব মেডিকেল কলেজের অনুমোদন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। শুধু তা-ই নয়, নতুন করে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদনে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্তও নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দেশের বিপুলসংখ্যক বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ সরকারের নীতিমালা মেনে যথাযথভাবে মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা, তা-ও তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। চিকিৎসাবিদ্যার গুণগত মান নিশ্চিত করার স্বার্থেই যে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং গৃহীত সিদ্ধান্ত মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত কতটুকু সফল হতে পারবে,সেটাই দেখার বিষয়।
আলোচ্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অনুমোদন স্থগিতের পেছনের কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য মেধাস্কোর কমিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে এসব কলেজের মালিকরা। একটি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া যে কোনো শিক্ষার্থীকেই বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। আর বাংলাদেশ বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় স্কোর ১২০ থেকে কমিয়ে ১০০ করার দাবিও জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য, ভর্তির স্কোর বেশি হওয়ায় মেডিকেল কলেজগুলোয় কাঙ্ক্ষিত হারে ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক মেডিকেল কলেজ নাকি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কলেজগুলোর মালিকপক্ষের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৪০ শতাংশ আসন খালি রয়ে গেছে। এসব আসন পূরণ করার জন্যই তারা ভর্তির স্কোর কমানোর দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ পরিচালনায় জড়িতদের কেউ কেউ বলেছেন, মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ভর্তি স্কোর না কমালে শিক্ষার্থী সংকটে ভুগবে কলেজগুলো!
উচ্চহারে ভর্তি ফি বহাল রেখে মেধাস্কোর কমিয়ে দেয়ার যে দাবি উত্থাপন করেছে মেডিকেল কলেজগুলোর মালিকপক্ষ, তা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের বিস্ময়কর দাবি বাস্তবায়ন হলে মেডিকেল শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং কী ধরনের চিকিৎসক তৈরি হবে, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রশ্ন জড়িত রয়েছে যে শিক্ষার সঙ্গে, সেখানে যেকোনো অজুহাতে গুণগত মানের ব্যাপারে কোনো ছাড় দিলে নিঃসন্দেহে তা হবে আত্মঘাতী। কাজেই মেডিকেল শিক্ষার মান ধরে রাখার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের দৃঢ় ভূমিকা কাম্য।
এমনিতেই আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত মানের চিকিৎসা সেবা পেতে ব্যর্থ হন। ভুল চিকিৎসার শিকার হওয়ার অভিযোগও নতুন নয়। আবার প্রয়োজন না হলেও অনেক চিকিৎসক শুধু অর্থের মোহে পড়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে থাকেন বলেও প্রায়ই খবর বের হয় গণমাধ্যমে। বিনিময়ে তারা সংশ্লিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে নাকি কমিশনও পান। বেশির ভাগ চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখার সময় রোগীকে খুব কম সময় দেন। এছাড়া চিকিৎসা সেবা নিয়ে আরো নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালেও রোগীরা কম দুর্ভোগের শিকার হন না। আমরা এ ধরনের অভিযোগের অবসান চাই। এটা দূর করার দায়িত্ব একদিকে যেমন চিকিৎসকদের ওপর বর্তায়, অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও রাখতে হবে কার্যকর ভূমিকা চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করার স্বার্থে নিতে হবে যথাযথ উদ্যোগ। একই সঙ্গে সমাজের সাধারণ মানুষেরও এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
অনেকেই বলছেন, যারা সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারে না, তাদের জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ থাকলেও উচ্চহারে ভর্তি ফি নির্ধারণ করার কারণেই নির্দিষ্ট আসনগুলো পূরণ করার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবে দেখা যায়, শুধু বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নয়, বরং অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে ভর্তি ফি আদায় করছে। আর উচ্চশিক্ষা দানকারী সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা চাহিদার তুলনায় কম থাকায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী অনন্যোপায় হয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ সুযোগে অধিক অর্থলাভের আশায় বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক উচ্চহারে ফি নির্ধারণ করেন বলে প্রায়ই কথা ওঠে। অথচ ভর্তি ও অন্যান্য ফি কমিয়ে তারা শিক্ষার্থী আকর্ষণ করবেন এমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না সচরাচর। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই প্রায় একই রকম প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কাজেই সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও পেশাগত শিক্ষা পরিচালনাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোন খাতে কী পরিমাণ ফি আদায় করতে পারবে, তা সরকারের তরফ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যেও সমন্বয় থাকা জরুরি।
চিকিৎসাবিদ্যাসংশ্লিষ্ট এক তথ্যে দেখা যায়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় আসনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ছয় হাজার। এসব কলেজে গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে আদায় করা হয় শুধু ভর্তির নামে। এছাড়া আরো নানা সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় তো রয়েছেই। অন্যদিকে বেসরকারি ডেন্টাল কলেজগুলোয় আসনসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এসব কলেজেও উচ্চহারে ভর্তি ফি আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোনো ডেন্টাল কলেজে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আদায় করা হয় শুধু ভর্তির সময়ই। অথচ বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ পরিচালনার জন্য সরকার নির্ধারিত যেসব শর্ত রয়েছে, সেগুলো পূরণ না করে বা ক্ষেত্রবিশেষে উপেক্ষা করে প্রায় সব কলেজই তাদের প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাবিদ্যা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। পরিতাপের বিষয়, চিকিৎসাবিদ্যার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানসম্মত ও মেধাবী চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে কিনা, সেদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকে না বললেই চলে। এসব কারণে শুধু টাকা থাকলেই চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ অবারিত হয়ে উঠছে দিন দিন। এ ধরনের প্রবণতা রোধ করা দরকার মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার স্বার্থেই।
লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
http://www.bonikbarta.com/sub-editorial/2014/02/14/32025

No comments:

Post a Comment