Friday, November 29, 2013

অনিশ্চিত গন্তব্যে জাতির ভবিষ্যৎ



 
নভেম্বর ২৯, ২০১৩, শুক্রবার : অগ্রহায়ণ ১৫, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
অনিশ্চিত গন্তব্যে জাতির ভবিষ্যৎ
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর, ২০১৩
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। ধারণা করি, রাজনীতিকরাও রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। সাধারণ মানুষও রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে খেটে খাওয়া মানুষদের যেন দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কৃষক-শ্রমিক থেকে আরম্ভ করে শিক্ষক, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের অধিকাংশই চরম দুর্ভাবনার মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন। স্কুল শিক্ষার্থীরাও এখন আমাদের অস্থিতিশীল রাজনীতির নির্মম শিকার হচ্ছে। বছরের শেষ সময়ে এসে তারা নিরাপদে পরীক্ষাও দিতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা তো একরকম অসহায় হয়ে আছেন সহিংস রাজনীতির কাছে। উপর্যুপরি হরতাল ও অবরোধের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিভাবে এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির হাত থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পাবে সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে।
গত ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। এর কিছুক্ষণ পরই দেশজুড়ে টানা অবরোধ কর্মসূচিরও ঘোষণা দেয়া হয় প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে। অবরোধ চলাকালে বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনায় বেশ কিছু লোক প্রাণ হারিয়েছে। এতে মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে সন্দেহ নেই। সবার মনে প্রশ্ন, কী হতে যাচ্ছে দেশে? শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে কি-না এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই। সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি অপরিহার্য বিষয়। স্বীকৃত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। গণতন্ত্রকে সুসংহত ও শক্তিশালী করতে হলেও দরকার নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। নির্বাচন এমন এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার ব্যত্যয় ঘটলে দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়; সর্বত্র দেখা দেয় বিশৃংখল পরিস্থিতি। শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রায়ই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। এ দেশে নির্বাচনের সময় এলেই দেশজুড়ে দেখা দেয় অস্থিরতা। আরম্ভ হয় নানামুখী ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। হামলা-পাল্টাহামলা, জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর, হরতাল-অবরোধ দিয়ে দেশকে নিয়ে যাওয়া হয় এক রকম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এমনকি নির্বাচনের আগে ও পরেও ধ্বংসাÍক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকতে দেখা যায়। রাজনীতি নিয়ে বছরজুড়ে নানা ধরনের নেতিবাচক কর্মসূচি তো থাকেই। এ ধরনের প্রবণতা জাতীয় উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
আমাদের নির্বাচন নিয়ে শুধু দেশজুড়ে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এখন। কয়েকদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টের আলোচনাতেও বিষয়টি উঠে এসেছে। ইইউর পার্লামেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। এ আহ্বান কতটুকু সফল হবে সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তার আগে অস্থির রাজনীতি শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা ভেবে দেখা দরকার আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই। কারণ রাজনীতিকে যতই অগ্রাধিকার দেয়া হোক না কেন, শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শুধু রাজনীতির মাধ্যমে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিয়ে শতভাগ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও শিক্ষাকে পর্যুদস্ত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। রাজনৈতিকভাবে উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষার অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব কাজে লাগানোর চেষ্টা থাকতে হবে। অথচ এখন দেখা যায়, শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত খাত হিসেবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। রাজনীতির যে অবস্থা তাতে যে কারও মনে হতে পারে, এর প্রভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা পঙ্গু হতে আর বেশি দেরি নেই।
গুণগত রাজনীতির অভাবে দেশ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এক রকম বিদায় নিতে যাচ্ছে বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা থেকে আরম্ভ করে যে কোনো পর্যায়ের যে কোনো পরীক্ষার সময় এলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া যেন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে দেশে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে, সে দেশে শিক্ষার গুণগত মান, ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কী অবস্থা, তা কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষায় পাস করে যারা শিক্ষক হবেন, তারা আমাদের জাতিকে কী শিক্ষা উপহার দেবেন সেটা কি আরও স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন রয়েছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা থেকে আরম্ভ করে শিশুদের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে এবার। এর বাইরে আরও অনেক পরীক্ষা রয়েছে, যেগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারেও অভিযোগ রয়েছে অনেক। এখানে শুধু আক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন রাখব, আমরা কোন ধরনের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি- সেটা কি এখনও ভেবে দেখার সময় হয়নি? কোথায় আমাদের নৈতিকতা? কোথায় মূল্যবোধ? কোথায় সততা? কোথায় ন্যায়নীতি? যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ না হয়, যদি গুণগত শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক ভিত্তি দৃঢ় না হয়, যদি আমাদের মূল্যবোধের উন্নয়ন না ঘটে, তাহলে কিভাবে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব? এখন যেমন দেশে বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার তৎপরতা শুরু হয়েছে, তেমনি হয়তো এমন একদিন আসবে যখন আমাদের ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে হলে দেশেই বিদেশী শিক্ষক সরবরাহের প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে!
দেশের রাজনীতির যে পরিস্থিতি তাতে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের উদ্বেগ বাড়ছে। বছরের শেষ সময়ে এসে এখনও স্কুলগুলোর অনেক পরীক্ষা বাকি রয়েছে। স্কুল পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষাও শেষ হয়নি। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা আরম্ভই হতে পারেনি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে যাবতীয় পরীক্ষা শেষ করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে কয়েকদিন আগে। অনেক স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করা হয়ে গেছে। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনভাবে পরীক্ষার সময়সূচি তৈরি করেছিল যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পরীক্ষা শেষ করা যায়। এখন হঠাৎ করে অবরোধের মতো কর্মসূচি আসায় দেশজুড়ে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষা কার্যক্রম পড়ে গেল এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে। এ অবস্থায় স্কুলগুলো নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শেষ করতে পারবে কি-না সেটা এখন আর নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কিভাবে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে যাবে, সেটা প্রশ্ন হয়েই রইল আমাদের কাছে।
আমরা কিছুতেই ভেবে পাই না, শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে, কোটি কোটি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিয়ে জাতি কোন দিকে যাত্রা করছে? বিশ্বে এমন কোনো দেশের খোঁজ কি কেউ দিতে পারবেন, যে দেশে শিক্ষাকে অবহেলা করে শুধু রাজনীতির মাধ্যমে উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে?
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

Thursday, November 28, 2013

গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার যৌক্তিকতা



ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০১৩, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪২০, ২৩ মহররম ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার যৌক্তিকতা
মো. মুজিবুর রহমান
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে নির্ধারিত ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ হলো, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ সহজে নিরসন হচ্ছে না। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা যে ধরনের সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে সেটা লাঘব করার উদ্দেশ্যেই এ দুটো বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে গুচ্ছ পদ্ধতিতে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে যাচ্ছিল। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় দুটি একই দিনে একই সময়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানে একমত হয়েছিল। এ ধরনের পরীক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, যেসব শিক্ষার্থী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো একটিতে ভর্তি হতে আগ্রহী তাদের আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না। এমনকি তাদের কাউকেই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই উপস্থিত হওয়ার দরকার হবে না। তাদের যেকোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই হবে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সুবিধা, শিক্ষার্থীরা যেকোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই গুচ্ছের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে বলে গণ্য হবে। এর ফলে পরীক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটাছুটি করার দরকার হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করার মধ্য দিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ধারণাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল।
গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছুদিন ধরে খোদ সিলেটের বিভিন্ন মহল দাবি উত্থাপন করে আসছিল। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের একটা অংশও এ পদ্ধতির বিরোধিতা করছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে একদল শিক্ষার্থীর মানববন্ধনের খবরও আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। গত সোমবার সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকও করেন। কিন্তু ওই বৈঠকে দৃশ্যত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। এদিকে বিভিন্ন সংগঠন একই প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে পরীক্ষার দিন সিলেটে হরতাল ডাকার ঘোষণা দেয়ায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা আহ্বান করে ৩০ নভেম্বর নির্ধারিত ভর্তি পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘোষণার ফলে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হলো।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়ে সমস্যা ও সংকট নতুন নয়। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের তুলনায় আসন সংখ্যা কম থাকায় ভর্তি পরীক্ষা এলেই এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়। বাস্তব পরিস্থিতিতে কোনো শিক্ষার্থীই ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করলেও নিজের পছন্দমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে কিনা এর নিশ্চয়তা না থাকায় সবাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চায়। আগ্রহী শিক্ষার্থীরা যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন করার যোগ্য তাদের প্রায় সবাই সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আবেদনপত্র জমা দিয়ে থাকে এবং চেষ্টা করে যাতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়। এটা করতে গিয়ে তাদের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যেতে হয়। এর ফলে একদিকে তাদের যেমন যাতায়াতের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়, অন্যদিকে অভিভাবকদের টাকাপয়সাও খরচ হয় প্রচুর। অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে তাদের পক্ষে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। কাজেই ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের আবেদন করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যদি একই দিনে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় তাহলে তাদের পক্ষে কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেই অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। ফলে যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও শুধু পদ্ধতিগত কারণে অনেকের পক্ষে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। এ পরিস্থিতিতে তারা তখন ভাগ্যনির্ভর হয়ে পড়ে। এভাবেই পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার স্বপ্ন চিরতরে ধুলিসাৎ হয়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতি নিরসন করার উদ্দেশ্যেই একই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে গুচ্ছ গঠন করে একই দিনে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের ধারণা আসে। দৃঢ়ভাবে আশা করা হয়েছিল, সিলেট এবং যশোরে অবস্থিত দুটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করবে এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে দরকার হলে পরবর্তীকালে একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু পরীক্ষামূলক এ উদ্যোগটি শুরুতেই বাধাপ্রাপ্ত হলো।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com

Thursday, November 21, 2013

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন



ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০১৩, ০৭ অগ্রহায়ণ ১৪২০, ১৬ মহররম ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন
মো. মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশে শিক্ষা বিকাশের প্রচেষ্টা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে আরম্ভ করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার অধিকাংশই পরিচালিত হয়ে আসছে বেসরকারি উদ্যোগে। শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যক্তি বা সংস্থার উদ্যোগ যে এ দেশে একেবারে নতুন তা নয়। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই বেসরকারিভাবে শিক্ষা বিকাশের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের প্রচেষ্টা শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নত দেশেও দেখা যায়। কিন্তু সে সব দেশে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হয় না। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি থেকে যায় উপেক্ষিত। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্নের শেষ নেই।
কিছুকাল আগেও বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হতো সেগুলো প্রকৃত অর্থেই ছিল মানসম্মত প্রতিষ্ঠান। তখন শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার মানসিকতা প্রতিষ্ঠাতাদের কারোর মধ্যেই ছিল না। আগে স্থানীয় বিদ্যা অনুরাগী এবং বিত্তবান শ্রেণির ব্যক্তিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে আসতেন উদারভাবে। তারা তাদের এলাকার শিশুদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের ধন্য বলে মনে করতেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে নিজস্ব জমিদান করতেন, নগদ টাকা-পয়সাও দিতেন প্রতিষ্ঠানের তহবিলে। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। এখন আর আগের মতো নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষা বিকাশের প্রচেষ্টা খুব একটা দেখা যায় না। এখন যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছেন তাদের অধিকাংশেরই থাকে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার মানসিকতা। এ ধরনের মানসিকতা প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়। স্কুল পর্যায়ে দেখা যায়, যে সব ব্যক্তি নিজের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেছেন অথচ কোথাও কোনো কর্ম জুটিয়ে নিতে পারেননি তাদের কয়েকজন মিলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেন এবং নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেন। এভাবে প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে সরকারের শিক্ষা বিভাগের কোনো অনুমোদন না থাকলেও তারা বিনাবাধায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে যান। বাস্তবে দেখা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারি অনুমোদন থাকে না সে সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা ওই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এ ধরনের শিক্ষার্থীদের অন্য কোনো কাছাকাছি অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দেয়। এটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা হলেও তা চলছে কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা জানিয়েছে, সারা দেশে প্রায় ৭০ হাজার কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধন ছাড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। খোদ রাজধানী ঢাকাতেই চলছে নিবন্ধনহীন প্রায় ২২ হাজার প্রতিষ্ঠান। এটা আমাদের কাছে সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার, একই সঙ্গে চরম উদ্বেগেরও। শহরাঞ্চলে অনেক প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম পর্যায়ে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশের ট্রেড লাইসেন্সও নেই। অনুমোদনহীন এসব প্রতিষ্ঠান কিভাবে শিশুদের শিক্ষা দেয়ার অধিকার পেল এবং কী পদ্ধতিতে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটাও দেখার কেউ নেই বলেই মনে হয়।
গত বছরের শুরুর দিকে ওই মন্ত্রণালয় থেকে কিন্ডারগার্টেনগুলো নিবন্ধনের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সেটার কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত কেবল কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ দেশে বিপুল সংখ্যক কিন্ডারগার্টেন থাকলেও গত জুলাই পর্যন্ত মাত্র ২ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান সরকারি নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে আবেদন করেছে বলে একটি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে গত ২০ অক্টোবর। কিন্ডারগার্টেনগুলো নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য বাস্তব পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক। প্রায় বছর দেড়েক আগে সরকার নিবন্ধনের জন্য নীতিমালা জারি করার পর এতো দীর্ঘ সময়েও কিন্ডারগার্টেনগুলো নিবন্ধন করেনি, এমনকি নিবন্ধন করতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আগ্রহও দেখা যায়নি। এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার।
কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের দিয়ে শিশুদের পাঠদান করানো। শিশুদের পড়াতে হলে শিক্ষকদের অবশ্যই পেডাগজি বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। বাস্তবে অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেনে পাঠদানকারী শিক্ষকদের এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। সরকারিভাবে এসব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার কোনো ব্যবস্থাও দেশে চালু নেই। দেশের প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলো (পিটিআই) সরকারি প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় তারা প্রশিক্ষণ ছাড়াই কোমলমতি শিশুদের পড়িয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে সরকারেরও কোনো উদ্যোগ ও উদ্বেগ দেখা যায় না। আমরা এখানে প্রস্তাব রাখব, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের শিশু মনস্তত্ত্ব ও শিখন তত্ত্বের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হবে খুব দ্রুত। এ উদ্দেশ্যে শিশু মনস্তত্ত্ব ও শিখন তত্ত্বে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকদের সহায়তায় প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল প্রণয়ন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা কঠিন কিছু নয়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com