Tuesday, January 15, 2013

শিক্ষকদের সঙ্গে এমন আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত



জানুয়ারি ১৫, ২০১৩, মঙ্গলবার : পৌষ , ১৪১৯
(বাতায়ন)
শিক্ষকদের সঙ্গে এমন আচরণ অনাকাঙ্ক্ষি

মোঃ মু জি বু মা
বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের এমপিওবিহীন শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি বেতনভুক্তির দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন গত বছর অক্টোবরে একই দাবিতে ঢাকায় কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়েছিল তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষকদের বৈঠক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল বলে শিক্ষক নেতারা জানিয়েছেন পরবর্তীকালে শিক্ষা সচিবের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার খবরও রয়েছে এমনকি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হলেও শিক্ষকদের দাবির ব্যাপারে কোন সুরাহা হয়নি বলেও তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন শিক্ষকদের অভিযোগ, বিগত কয়েক মাসেও তাদের দাবি নিয়ে কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় এবং উত্থাপিত দাবি পূরণের কোন পথ খুঁজে না পাওয়ায় নিরূপায় হয়ে তারা ঢাকায় অর্থ মন্ত্রণালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন
শিক্ষকদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা সংক্ষেপে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঢাকায় মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল ঘোষণা অনুযায়ী সারাদেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শিক্ষক বুধবার সরকারের দুটি মন্ত্রণালয় ঘেরাও করতে গেলে সরকারি সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং মন্ত্রণালয়মুখী সড়কে শক্তভাবে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে কিন্তু শিক্ষকরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটে; দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শিক্ষক পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার খবর পরদিন দেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে কোন কোন পত্রিকায় সংঘর্ষের ছবিও ছাপা হয়েছে সংঘর্ষে আহত হয়ে বহু শিক্ষককে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার খবরও রয়েছে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, শিক্ষকরা সচিবালয়ের নম্বর গেটের দিকে অগ্রসর হয়ে পুলিশের দেয়া ব্যারিকেড ভেঙে সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ তরল গ্যাস নিক্ষেপ করে সময় শিক্ষকরাও পুলিশ ্যাবকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের আরও সংঘর্ষ চলে এবং শেষ পর্যন্ত শিক্ষকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান এরপর শিক্ষকরা বৃহস্পতিবার থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দেন অনশন কর্মসূচি পালন করতে গেলে শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের ফের সংঘর্ষ বাধে এবং একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে করে ১১ জানুয়ারি যুগান্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার নন-এমপিও শিক্ষকদের ওপর মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত গরম পানি ছিটিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ এরপরও শিক্ষকরা ছত্রভঙ্গ না হলে নিক্ষেপ করা হয় টিয়ার শেল নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের কয়েকশ সদস্য শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে অনশনে বসতে গেলে ফের পুলিশ তাদের বাধা দেয় এরপর দুপুরে তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের š§ুক্ত মঞ্চে জড়ো হয়ে কর্মসূচি শুরু করেন (সমকাল, ১২.০১.১৩)
শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের সভাপতি বলেছেন, ১২ থেকে ১৩ বছর ধরে তারা বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন অবস্থায় দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা ঢাকা ছেড়ে যাবেন না বলেও জানিয়েছেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের দাবি কতটুকু পূরণ হবে কিংবা পূরণের লক্ষ্যে কোন আলোচনার সূত্রপাত হবে কিনা তা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে কিন্তু আপাতত পরিস্থিতি উন্নতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং তা ক্রমে সংঘাতের দিকে যাচ্ছে অবস্থা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ শিক্ষকরা সমাজের সম্মানিত লোক এবং মানুষ গড়ার কারিগর তাদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া সংঘর্ষ সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা শিক্ষার্থীদের মনে কী প্রভাব ফেলবে, সেটি ভেবে দেখতে হবে সবাইকে
কয়েক বছর ধরে শিক্ষাবর্ষের প্রথমদিনেই সরকারের পক্ষ থেকে স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে এর আগে কখনোই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে এত বিপুলসংখ্যক পাঠ্যবই তুলে দেয়া হয়নি আগে নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে দেখা যেত তখন অনেক সময় বই চলে যেত কালোবাজারে শিক্ষাবর্ষের কয়েক মাস চলে যাওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা উচ্চমূল্য দিয়ে বাজার থেকে বই কিনতে বাধ্য হতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূল বইয়ের সঙ্গে নোট-গাইডবইও কিনতে হতো এখন পরিস্থিতির অবসান হয়েছে শিক্ষার্থীরা প্রথমদিনে স্কুলে গিয়ে নতুন বই পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত আত্মহারা হয়েছে বই হাতে শিক্ষার্থীদের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায় কিন্তু এমপিওবিহীন স্কুলে শিক্ষার্থীদের আনন্দের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে বিষাদ তাদের ক্লাসে ব্যাঘাত ঘটছে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে যেসব স্কুলের শিক্ষক দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আন্দোলনরত রয়েছেন, শুধু তাদের স্কুলেই যে পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটছে তা নয়, বরং অন্যান্য স্কুলেও এমনকি অনেক সরকারি স্কুলেও পাঠদানে একরকম ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে
১১ জানুয়ারি যুগান্তরের ভেতরের পাতায় শিক্ষকদের ধর্মঘটের বিষয়ে ছোট এক খবরের শিরোনাম ছিল- বরিশালে তিন সহস্রাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট শুরু খবরে বলা হয়েছে, শিক্ষা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে বরিশাল বিভাগের তিন সহস্রাধিক বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট এসব প্রতিষ্ঠানের ক্লাস অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে এক ধরনের অলস সময় কাটাচ্ছে আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর শুরু হবে এসএসসি পরীক্ষা পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের ওপর চলমান ধর্মঘট বিরূপ প্রভাব ফেলবে, এতে কোন সন্দেহ নেই ধরনের পরিস্থিতি কি সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষার জন্য উদ্বেগজনক নয়?
এরপরও এমপিওবিহীন শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কিছু কথা বলা দরকার আমাদের শিক্ষকরা নানাভাবে অবহেলার শিকার একদিকে শিক্ষকরা অনেকখানি অমর্যাদাকর অবস্থায় স্কুলে পড়ালেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন; অন্যদিকে তাদের বেতন-ভাতা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল তারা যে বাড়িভাড়া চিকিৎসা ভাতা পান, তা ল্লে করার মতো নয় কী সরকারি, কী বেসরকারি- কোন স্কুলেই শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা দেয়া যাচ্ছে না তবে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের চাকরির নিশ্চয়তা রয়েছে এবং তাদের চাকরি পেনশনযোগ্য হওয়ায় এসব স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থান বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের তুলনায় অনেক ভালো সম্প্রতি সরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের মর্যাদাও একধাপ উন্নীত করা হয়েছে এমনকি যেসব বেসরকারি স্কুল এমপিওভুক্ত হয়ে আছে, সেসব স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থানও এমপিওবিহীন স্কুলের শিক্ষকদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো কিন্তু সমস্যা রয়েছে এমপিওবিহীন স্কুলের শিক্ষকদের বেলায় এক তথ্যে দেখা যায়, সারাদেশে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রায় সাত হাজার এমপিওবিহীন স্কুল রয়েছে এসব স্কুলে কর্মরত রয়েছেন এক লাখেরও বেশি শিক্ষক এমপিওবিহীন স্কুলগুলোকে পাঠদানের জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে তিন বছর থেকে এক যুগেরও বেশি সময় আগে প্রশ্ন হল, যেখানে সরকার স্কুলকে পাঠদানের জন্য স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জোগান দেবে কে? প্রশ্নের সুরাহা হওয়া জরুরি কারণ সরকার যখন শিক্ষকদের কাছ থেকে সেবা নেবে, তখন তাদের বেতন-ভাতার বিষয়টিও সরকারকেই ভেবে দেখতে হবে আমরা মনে করি, শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন নিরসনে যত বেশি সময়ক্ষেপণ হবে, সমস্যা তত বেশি জটিল আকার ধারণ করবে; স্কুলে পড়ালেখায় ঘটবে বিঘ্ন একই সঙ্গে আন্দোলনের ফলে যাতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, দিকটিও শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে অভিভাবক হিসেবে আমরা আশা করব, দাবি-দাওয়া আদায় করতে গিয়ে যত আন্দোলনই করা হোক, কোমলমতি শিশুদের পড়ালেখায় কোন বিঘ্ন ঘটানো হবে না
দেশে যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে যে, যে কোন স্থানে কয়েকজন মিলে অথবা কখনও বিত্তশালী একজন হলেও তিনি নিজ এলাকায় স্কুল স্থাপন করেন সন্দেহ নেই, স্কুল স্থাপনের উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু স্থাপনের পর কোনরূপ সরকারি সহায়তা ছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জোগান দেয়া যাবে কিনা, আগেই তা ভেবে দেখা দরকার কারণ স্কুল স্থাপিত হয়ে গেলে সেখানে ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয় এবং পরবর্তী প্রচেষ্টায় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শুধু পাঠদানের অনুমতি নেয়া হয় স্কুলগুলো যখন পাঠদানের অনুমতি পেয়ে যায়, তখন এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষক-কর্মচারীরা আশায় বুক বাঁধেন, কোন না কোন সময় এমপিওভুক্ত হওয়া যাবে পরবর্তীকালে সরকারি বেতনভুক্তির আওতায় আসতে না পারলে দেখা দেয় ভিন্ন পরিস্থিতি পরিস্থিতিই একসময় সৃষ্টি করে আন্দোলনের, দেখা দেয় সংঘাত যে আন্দোলনটি এখন চলমান রয়েছে, সেটি ধরনেরই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বলে মনে করি কাজেই আমরা বলব, যেখানেই নতুন স্কুল স্থাপন করার প্রক্রিয়া আরম্ভ করা হবে, সেখানে আগেই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিষয়ে সরকারের সম্মতি নিয়ে তবেই যেন তা স্থাপন করা হয় সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া যেন কোথাও স্কুল স্থাপন করা না যায় একই সঙ্গে যত্রতত্র স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার যথাযথ মান ধরে রাখা যাচ্ছে কি-না, সে দিকটিও ভাবতে হবে কারণ অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে যত্রতত্র স্কুল স্থাপিত হওয়ার পর সরকারি স্বীকৃতি এমপিওভুক্তির জন্য ব্যাপক তদবির চাপ প্রয়োগ করা হয় এভাবে আমরা পড়ালেখার গুণগত মান ধরে রাখতে পারব কিনা, সেটিও ভেবে দেখতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে
শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের সময় প্রাথমিক স্তরের জন্য সরকারের একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপের ল্লে করে লেখা শেষ করব অনেকের কাছে বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল নিয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ এবং বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের দিনক্ষণের বিষয়টা অনেকটা কাকতালীয় বলে মনে হতে পারে কারণ দুটি ঘটনা একই দিনে রাজধানীতে ঘটেছে যেদিন ঢাকায় এমপিওবিহীন বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের দাবি নিয়ে সমবেত হলেন, ঠিক সেদিনই সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছে ঘোষণায় প্রাথমিক স্কুলের এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারি হয়েছে বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের এমপিওবিহীন শিক্ষকদের দাবির ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, এটিই এখন দেখার বিষয়
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment