ঢাকা, রোববার, জানুয়ারি
১৩, ২০১৩, পৌষ
৩০, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
যুক্তরাষ্ট্র
স্কুলে
পুলিশ মোতায়েন কী স্বার্থে?
মো. মুজিবুর রহমান
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই বন্দুকধারীদের গুলিতে নির্বিচারে মানুষ খুনের খবর পাওয়া যায়।
এটা ঘটে একপ্রকার স্বাভাবিকভাবেই; যদিও মানুষ হত্যাকে
কখনই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বলা যায় না। সে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীর খুনের
মতো ঘটনা ঘটে থাকে প্রায়ই। দেখা যায়, যে কেউ গুলিভর্তি
বন্দুক নিয়ে স্কুলে হাজির হয়ে আচমকা গুলি চালাতে শুরু করে। ফলে শিক্ষার্থীসহ আরো
অনেকেই মারা যায়। এমনই এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো—
কানেকটিকাটের নিউটাউন এলাকার স্যান্ডি হুক এলিমেন্টরি স্কুলে
অ্যাডাম ল্যানজা নামক ২০ বছর বয়সী এক তরুণের বন্দুকের গুলিতে ২০ শিশু শিক্ষার্থীসহ
২৭ জন নিহত হওয়ার দুঃখজনক ঘটনা। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর এ ঘটনা ঘটার পর সে দেশে
আগ্নেয়াস্ত্র আইন আরো কঠোর করার প্রচণ্ড চাপে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
শুধু কানেকটিকাটের ঘটনা নয়, বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
গুলিভর্তি বন্দুক নিয়ে হামলার বহু ঘটনা রয়েছে সেখানে। বন্দুকধারীর গুলিতে সাধারণ মানুষ
নিহত হওয়ার খবরও কম নেই। ১৯৮২ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের ওপর
গুলিবর্ষণের অন্তত ৬২টি ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় সেমি-অটোমেটিক রাইফেলই বেশি
ব্যবহার করা হয় বলে খবর রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, সেখানে আগ্নেয়াস্ত্রের
অবাধ ব্যবহার কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের
নাগরিকদের কাছে প্রচুর অস্ত্র রয়েছে বলে প্রায়ই শোনা যায়। এক হিসাবে দেখানো হয়েছে,
২০০৯ সালে দেশটির নাগরিকদের হাতে প্রায় ৩১ কোটি আগ্নেয়াস্ত্র
ছিল। অর্থাৎ গড়ে প্রায় প্রত্যেক নাগরিকের হাতে একটি করে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এমনকি
কোনো কোনো পরিবারে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকারও খবর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র
আইন অনুযায়ীই সে দেশের নাগরিকরা অবাধে আগ্নেয়াস্ত্র দখলে রাখতে এবং তা বহনের
অধিকার রাখেন বলেই হয়তো অধিকাংশের হাতে অস্ত্র থাকে। ফলে সে দেশে প্রায়ই
আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে বহু লোক মারা যান। এ রকম হামলার একটি ঘটনা হলো কানেকটিকাটের
স্কুলে নির্মম হত্যাকাণ্ড। এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা
রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, সে দিকটিই আমেরিকানদের
ভাবিয়ে তুলছে বলে মনে হয়।
ধারণা
করি, স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য
যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং সে দেশের নাগরিকরা নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। তা
সত্ত্বেও বাস্তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুকধারীদের আক্রমণের শিকার হয়ে শিক্ষার্থী
মৃত্যুর ঘটনা বন্ধ হবে কি না— এমন প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে
যেভাবে প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুকধারীর হামলা চলে,
তার পরিপ্রেক্ষিতে এখন নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
এসব পদক্ষেপের ব্যাপারে স্পষ্টতই দুই ধরনের প্রস্তাব উঠে এসেছে। এর একটি হলো,
যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র আইন আরো কঠোর করা। যেভাবে আমেরিকানরা অবাধে
আগ্নেয়াস্ত্র নিজের দখলে রাখেন এবং সেটা নিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারেন,
তা যথেষ্ট উদ্বেগের। দেখা যাচ্ছে, আগ্নেয়াস্ত্র
রাখার সুযোগের অপব্যবহার হয়ে থাকে প্রায়ই। কাজেই অস্ত্র আইন কঠোর করার মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র
নিয়ন্ত্রণের জোর দাবি উত্থাপিত হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। স্কুলশিক্ষকদের হাতে
আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে। ইউটাসহ
কয়েকটি রাজ্যে স্কুলশিক্ষকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে। এ
উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের অস্ত্র চালনার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। তবে
শিক্ষকদের হাতে অস্ত্র দিলেও তারা নাকি এগুলো শ্রেণীকক্ষে লুকিয়ে রাখবেন। এ
রাজ্যের বহু শিক্ষক অস্ত্র চালনার ওপর প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন
করেছেন কর্তৃপক্ষের কাছে। ইউটা শুটিং স্পোর্টস কাউন্সিল (ইউএসএসসি) আগ্নেয়াস্ত্র
চালনার ওপর প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী শিক্ষকদের কাছ থেকে এরই মধ্যে ফিও তুলেছে বলে
গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
স্কুলে
বন্দুকধারী কর্তৃক হামলা চালিয়ে শিক্ষার্থী হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের
জন্য বুলেটপ্রুফ স্কুলব্যাগ ও পোশাকের বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। যুক্তরাষ্ট্রে
বুলেটপ্রুফ স্কুলব্যাগ ও পোশাকের বিক্রি বেড়েছে— এমন একটি সংবাদ ৫ জানুয়ারি প্রকাশ করেছে দৈনিক বণিক বার্তা। এ
সংবাদে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে শিশু শিক্ষার্থীদের
নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে অভিভাবকরা বুলেটপ্রুফ স্কুলব্যাগের প্রতি আগ্রহী হয়ে
উঠছেন। এমনকি তারা নিরাপদ পোশাকের কথাও ভাবছেন। সে দেশে স্কুলপড়ুয়াদের নিরাপত্তার
বিষয়টি কতটুকু নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা বোঝা যায়
অভিভাবকদের বুলেটপ্রুফ স্কুলব্যাগ ও পোশাকের প্রতি ঝুঁকে পড়ার হার দেখেই। এ পরিস্থিতিতে
প্রশ্ন থেকে যায়, উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র কি নিজ দেশের
স্কুলশিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে?
অন্যদিকে
যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলে শিশুদের নিরাপত্তাহীনতাকে পুঁজি করে সে দেশের অস্ত্রবিষয়ক
সংগঠন ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) বন্দুকধারীর হামলার ঘটনা বন্ধে
স্কুলগুলোয় সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েনের পরামর্শ দিয়েছে। সপ্তাহ দুই আগে ওই
প্রতিষ্ঠানের ভাইস-প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তারা স্কুলগুলোর
নিরাপত্তা
টিমকে প্রশিক্ষণ দিতে এবং নিরাপত্তা উন্নয়নে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহযোগিতা করতে
প্রস্তুত রয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি মিডিয়ারও কঠোর সমালোচনা করেন। তার মতে,
মিডিয়াই মানুষের মধ্যে এমন ধারণা প্রচার করছে যে—
আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়নই স্কুলে বর্বর হামলা
বন্ধ করতে পারে। কানেকটিকাটের স্কুলে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিরীহ শিশুদের হত্যার
পর বিভিন্ন মহল থেকে অস্ত্র বিক্রির বিরুদ্ধে যখন জনমত গঠন হয় এবং অস্ত্র আইন আরো
কঠোর করার দাবি উঠে, ঠিক তখনই এনআরএ এর বিপক্ষে অবস্থান
নিয়ে স্কুলে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েনের পরামর্শ দেয়। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এনআরএর প্রস্তাব অনুযায়ী সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করলেই কি শিক্ষার্থীদের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব? অনেক বিশ্লেষক এমন প্রশ্নও
তুলছেন, স্কুলে পুলিশ মোতায়েন করা হলে তা যুক্তরাষ্ট্রে
অস্ত্র ব্যবসাকে আরো প্রসারিত করবে না তো?
বাস্তব
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে
স্কুলের শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা এখন এক হাতে কলম এবং অন্য হাতে বন্দুক নিয়ে পাঠদানের
কাজ করবেন। এ পরিস্থিতি থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের মুক্ত রাখা যায় কীভাবে, তা নিয়ে আমেরিকানদের ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। কারণ এনআরএর প্রস্তাব
অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোয় যদি সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়, তাহলে তা শিশু শিক্ষার্থীদের মনে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং কোমলমতি
শিক্ষার্থীদের পক্ষে নিরুদ্বিগ্ন থেকে শ্রেণীকার্যক্রমে মনোনিবেশ করা আদৌ সম্ভব
হবে কি না—
শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের স্বার্থেই এটি এক গুরুত্বপূর্ণ
প্রশ্ন।
লেখক:
সহযোগী অধ্যাপক, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment