Friday, January 4, 2013

নরপশুদের রুখতে হবে



জানুয়ারি ০৪, ২০১৩, শুক্রবার : পৌষ ২১, ১৪১৯

(উপ-সম্পাদকীয়)

নরপশুদের রুখতে হবে

মোঃ মু জি বু র র হ মা ন

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হওয়া ২৩ বছর বয়সী মেডিকেলের যে ছাত্রীটি কয়েকদিন আগে পুলিশকে দেয়া জবানবন্দিতে বলেছিলেন, লড়াই না করে কোনভাবেই থামব না, সেই ছাত্রীটির জীবন-প্রদীপ অবশেষে নিভে গেছে; মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তিনি। ১৬ ডিসেম্বর রাতে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছিল বাসচালকসহ ছয়জন। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের শিকার হওয়া ওই মেয়েটি ও সঙ্গে থাকা তার ছেলেবন্ধুকে রড দিয়ে বেদম পিটিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় বাস থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। ভারতে চিকিৎসারত থাকাবস্থায় মেয়েটির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ভারত সরকার। মেয়েটির চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার ভারত সরকার বহন করলেও শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে বাঁচানো গেল না। পরিবার-পরিজন ও চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতেই সিঙ্গাপুরের ওই হাসপাতালে শনিবার ভোরে মারা গেছেন মেয়েটি। মানুষরূপী মানুষ (নাকি অমানুষ?) কতটা বর্বর ও অসভ্য হলে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে, এটা তার এক জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে রইল।

চলন্ত বাসে মেডিকেল ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হওয়ার পর এ নৃশংস ঘটনার বিচারের দাবিতে পুরো ভারত এখনও উত্তাল। বিভিন্ন মহল এ ঘটনার বিচারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। দিল্লিতে জারি করা হয়েছিল ১৪৪ ধারা। নিরাপত্তার কারণে বন্ধ করে দেয়া হয় অনেকগুলো মেট্রোস্টেশন। মনমোহন সিং সরকার এ ঘটনা নিয়ে কার্যত যথেষ্ট চাপের মুখে রয়েছে। তবে ছাত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা বা পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক মহল বিষয়টির ওপর নজর রেখে চলেছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, ভারত কি নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে?

বিশাল ভারতে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত চার দশকে অন্য যে কোন বড় অপরাধের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা। প্রকাশিত তথ্য মতে, বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষণকারীর কোন শাস্তি না হওয়ায় বা তুলনামূলকভাবে শাস্তি কম হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ বেড়ে চলেছে। ফলে ভারতে ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা রোধে যে বিদ্যমান আইন রয়েছে তা দুর্বল কিনা এমন প্রশ্নও অনেকে এখন তুলছেন। এছাড়া অপরাধীর বিচার না হওয়ার যে অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, সেটিও ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকেই। এসব প্রশ্নের মুখে ভারত সরকারকে এখন নতুন করে ভাবতে হবে কিভাবে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো নৃশংস ঘটনা রোধে কার্যকর পন্থা বের করা যায়।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৮৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ হারে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ১৯৭১ সালে ২ হাজার ৪৮৭টি ধর্ষণের ঘটনার বিপরীতে ২০১১ সালে ঘটেছে ২৪ হাজার ২০৬টি ধর্ষণের ঘটনা। অথচ ১৯৫৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছয় দশকে হত্যার মতো অপরাধ বেড়েছে ২৫০ শতাংশ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ ব্যাপারে দিল্লির কুখ্যাতি সারা ভারতে ছড়িয়ে রয়েছে। তবে ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ধর্ষণের ঘটনা কম ঘটছে না। গত বছর মধ্যপ্রদেশে ৩ হাজার ৪০৬টি, পশ্চিমবঙ্গে ২ হাজার ৩৬৩টি, উত্তর প্রদেশে ২ হাজার ৪২টি, রাজস্থানে ১ হাজার ৮০০টি, মহারাষ্ট্রে ১ হাজার ৭০১টি, আসামে ১ হাজার ৭০০টি ও অন্ধ্রপ্রদেশে ১ হাজার ৪৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে তথ্য রয়েছে।

এদিকে নয়াদিল্লিতে মেডিকেল ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যখন বিক্ষুব্ধ জনতা আন্দোলন-প্রতিবাদ অব্যাহত রেখে চলেছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের টাঙ্গাইলেও ঘটল একই ঘটনা। নরপশুরা এক স্কুলছাত্রীকে মধুপুরের এক নির্জন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। বিপর্যস্ত মেয়েটি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভারত-বাংলাদেশে এসব ঘটনা একদিকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে, অন্যদিকে নারীর নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। এখানে বলা দরকার, গণমাধ্যমে ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধের যেসব খবর প্রকাশিত হয়, বাস্তবে তার চেয়ে আরও বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। কারণ সব খবর যেমন গণমাধ্যমে উঠে আসে না, তেমনি সামাজিকভাবে মর্যাদাহানিকর বলে অনেকেই ধর্ষণসহ যৌন নিপীড়নের অনেক ঘটনা প্রকাশ করেন না। অনেক নির্যাতিতা হেয়-প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে এবং অপমানের দুঃখ-কষ্ট ও গ্লানি সইতে না পেরে বেছে নেন আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পথ। আবার এমন অনেক ঘটনা থেকে যায়, যেগুলো অপরাধীদের প্রচণ্ড হুমকির মুখে ভুক্তভোগীরা চেপে যেতে বাধ্য হন। এসব পরিস্থিতি একটি দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকেই প্রকাশ করে।

ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনা যে শুধু ভারত ও বাংলাদেশেই ঘটছে, তা নয়। অন্যান্য দেশেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। ধর্ষণের ঘটনা যেখানেই ঘটুক না কেন, এটি জঘন্য অপরাধ। এ অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে; রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের গতি ব্যাহত হবে। ধর্ষণের ঘটনা যে দেশেই ঘটুক, সংশ্লিষ্ট সরকার যদি এর পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর উপায় বের করতে না পারে, তাহলে তা ওই দেশের পরিবার ও সমাজের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য চরম হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এক সময় এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে।

যে কোন ঘটনার পেছনেই থাকে কিছু না কিছু কার্যকারণ। তেমনি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পেছনেও নানা ধরনের কারণ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে কিশোরী ও তরুণীদের উত্ত্যক্ত করার মধ্য দিয়ে একজন অপরাধী মূলত ধর্ষণের মতো চরম জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ সমবয়সী তরুণীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠায় পরবর্তীকালে ধর্ষণে লিপ্ত হয়। অন্যদিকে ধূমপানের প্রভাব, মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি, অশিক্ষার প্রভাব, শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়া, উচ্ছৃংখল জীবন কাটানো, বখাটেপনা, রাষ্ট্রে ধর্ষণ ও নিপীড়ন রোধে বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা ইত্যাদি কারণেও সমাজে ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। এছাড়া ব্যক্তিজীবনে অশ্লীল সিনেমা ও অপসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব তো রয়েছেই; যেগুলো মানুষকে অনেক সময় করে তোলে বিকৃত স্বভাবের। ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নীতিনৈতিকতাবহির্ভূত জীবনাচারে অভ্যস্ত হওয়া, কিশোর-তরুণদের ওপর পরিবারের নিয়ন্ত্রণহীনতাও অনেককে বিপথগামী করে তোলে সহজে। সমাজ থেকে ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধ দূর করতে হলে এসব দিক নিয়ে সব দেশকেই ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশে একপর্যায়ে কিশোরী, তরুণী ও নারীদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। স্কুলগামী অনেক ছাত্রীকেও নিপীড়নের শিকার হতে দেখা যেত। নিরাপদ ছিলেন না কর্মক্ষেত্রে অনেক নারীও। তখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- যৌন নিপীড়ন রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গঠন ইত্যাদি। এতে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা কিছুটা কমেছে বলে মনে হয়। তবে ধর্ষণের ঘটনা রোধ করা যায়নি। কাজেই আমরা আশা করব, সরকার দেশে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে দ্রুত।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক


mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment