Saturday, February 9, 2013

ক্ষতিকর ভিডিও গেমের বিপণন কি বন্ধ হবে?



 

ঢাকা, শনিবার, ফেব্রুয়ারি , ২০১৩, মাঘ ২৭, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
 ক্ষতিকর ভিডিও গেমের বিপণন কি বন্ধ হবে?


মো. মুজিবুর রহমান
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই উত্তেজনাপূর্ণ রোমাঞ্চকর বিষয়ের প্রতি শিশুদের প্রবল মনস্তাত্ত্বিক আকর্ষণকে পুঁজি করে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী উৎপাদন বিপণন করা হয়। এটা করা হয় কোনো রকম শিশুবান্ধব আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করেই। এমনকি এক্ষেত্রে ৎপাদিত পণ্যসামগ্রী শিশুদের জন্য ক্ষতিকর কিনা, তাও বিচার-বিবেচনা করা হয় না। বহু কোম্পানি খেলনা পিস্তল, বন্দুকসহ শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় নানা রকমের সামগ্রী পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশেও অনেক প্রতিষ্ঠান মুখরোচক বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন এবং বিক্রি করছে অবাধে। মুখরোচক খাবারের মধ্যে রয়েছে চকলেট, আচার, লজেন্স, জুস, আইসক্রিম প্রভৃতি। উৎপাদিত এসব খাদ্যসামগ্রীর প্রায় সবই শিশু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। খেলনা পিস্তল বন্দুকও শিশুর মনের ওপর অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পিস্তল হাতে নিয়ে শিশুরা খেলায় মেতে থাকলেও এসবের মধ্যে সৃজনশীল আচরণ আয়ত্ত করার তেমন সুযোগ থাকে না। একটি উড়ন্ত খেলনা হেলিকপ্টার কিংবা চলন্ত মোটরগাড়ি এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ শিশুর সৃজনশীল চিন্তা বিকাশে যতটুকু ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, একটি খেলনা পিস্তল কিংবা বন্দুক তার মনে ততটুকু আক্রমণাত্মক সাংঘর্ষিক চরিত্রের জন্ম দেয় বলে অনেক শিশুমনস্তত্ত্ববিদ মনে করেন। খেলনা হিসেবে পিস্তল বন্দুকের ব্যবহার শিশুকে সহিংস আচরণে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে। বাস্তবে শিশুরা খেলনা পিস্তল বন্দুক নিয়ে খেলাধুলা করলেও বড় হয়ে পিস্তল চালানোর স্বপ্ন তাদের মনের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। কারণে অনেক শিশুই পরবর্তী জীবনে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতি প্রবলভাবে আকর্ষণ বোধ করে। অথচ শিশুদের চিন্তা, দৃষ্টি মনস্তাত্ত্বিক শক্তির ক্ষতি করতে পারে, এমন কোনো পণ্য উৎপাদন, বিপণন বিক্রি নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। শিল্পোন্নত দেশগুলোই এসব খেলনা-জাতীয় সামগ্রী বেশি উত্পাদন বাজারজাত করে। শিশুদের জন্য ক্ষতিকর দিকটি উপেক্ষা করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে এসব করা হয়। শিশুদের সহজে আকর্ষণ করা যায়, এমন সব সামগ্রী উৎপাদন বিপণনের প্রচেষ্টা সর্বত্র লক্ষ করা যায়
শিশুদের জন্য ক্ষতিকর খেলার সামগ্রীগুলোর মধ্যে একটি হলো ভিডিও গেম। তবে সব ভিডিও গেমই যে ক্ষতিকারক, তা নয়। অনেক গেম রয়েছে, যেগুলো শিশুদের চিন্তাশক্তির বিকাশে ভূমিকা রাখে। কোনো কোনো গেমের মাধ্যমে বর্ণমালা শিক্ষা থেকে গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ রয়েছে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, সারা দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই শিশুদের খেলাধুলা করার নানা রকমের সরঞ্জাম থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তারা এখন কম্পিউটার গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে মারাত্মকভাবে। যেসব শিশু, কিশোর তরুণ-তরুণীর ব্যক্তিগত কম্পিউটার, কিংবা ল্যাপটপ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, তাদের অধিকাংশই ভিডিও গেম খেলে সময় পার করছে। নিয়ে শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদের বিরক্তিকর সম্পর্কের সৃষ্টি হয় অনেক সময়। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে ভিডিও গেমের প্রতি শিশুদের প্রবল আকর্ষণ অভিভাবকদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলছে। অভিভাবকরা কিছুতেই তাদের সন্তানদের ভিডিও গেম খেলা থেকে বিরত রাখতে পারছেন না। শিশুরা এমন এক বয়সে কম্পিউটার গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে, যখন তাদের শারীরিক মানসিক বিকাশের জন্য মাঠে খেলাধুলা করা জরুরি
দেখা যায়, শহরে বসবাসকারী অনেক পরিবার শিশুদের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ করে দিতে ব্যর্থ হয়ে কম্পিউটারে তাদের মাত্রাতিরিক্ত গেম খেলা মেনে নিতে বাধ্য হন। অথচ শিশুদের নিয়ে যদি বাইরে বের হওয়া যেত, তাদের খেলাধুলা করার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকত আনন্দঘন পরিবেশে সময় কাটানো যেত, তাহলে একদিকে যেমন তাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটত, অন্যদিকে তারা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও মুক্ত থাকতে পারত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গ্রাম-বাংলার দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের শিশুরা এখন আর আগের মতো মাঠে খেলাধুলা করার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ গ্রামেও এখন উন্মুক্ত মাঠের অভাব দেখা দিয়েছে। গ্রামে আগে যেখানে বছরের অনেকটা সময় বিস্তীর্ণ জমি খালি পড়ে থাকত, এখন সেখানে একাধিকবার ফসল ৎপন্ন করা হয়। শহরে তো খেলার মাঠই নেই। রাজধানীর পরিস্থিতি আরো খারাপ। ঢাকায় শিশুদের খেলাধুলা করার জন্য তেমন মাঠই নেই। আকাশছোঁয়া দালানে বসবাসরত শিশুরা এখন ড্রয়িংরুম বেডরুমে খেলাধুলা করার চেষ্টা করে। এভাবে তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক বিকাশ হয় না কখনই। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও খেলার মাঠ নেই। বহু স্কুল-কলেজ গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভবনে ভাড়াভিত্তিক। এমনকি অধিকাংশ কিন্ডার গার্টেন স্কুলও পরিচালিত হচ্ছে সীমিত পরিসরে ভাড়া বাসায়। ফলে শহরের অনেক শিশু বাইরে খেলাধুলা করার সুযোগ না পেয়ে বাসায় বসে ভিডিও গেম খেলে সময় পার করছে। তারা দুই কানে হেডফোন লাগিয়ে উচ্চশব্দে ভিডিও গেম খেলছে দীর্ঘক্ষণ। এভাবে ভিডিও গেম তাদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে; এটা শিশুরা বুঝতে পারে না, এমনকি বড়রাও তা বুঝতে পারেন বলে মনে হয় না। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চশব্দে ভিডিও গেম খেলার কারণে তাদের চারিত্রিক আচার-আচরণে ঘটছে উদ্বেগজনক পরিবর্তন, নষ্ট হচ্ছে তাদের স্মৃতিশক্তি, পড়ালেখায় মনোযোগ কমছে, চিন্তাচেতনায় দেখা দিচ্ছে উত্তেজনা, মেজাজ হয়ে পড়ছে খিটখিটে। আজকাল কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীদের অনেকেই নিজস্ব সেলফোনও ব্যবহার করছে গেম খেলার কাজে। এভাবে একদিকে তারা মূল্যবান সময়ের অপব্যবহার করছে, অন্যদিকে তাদের চিন্তাজগতে ঘটছে ভিন্ন রকম পরিবর্তন। এটি এমনভাবে হচ্ছে, যা আমরা সহজে বুঝতে পারছি না। শিশুরা এত বেশি ভিডিও গেম খেলছে যে, এখন প্রশ্ন উঠেছে, ভিডিও গেম তাদের সহিংস করে তুলছে কিনা। প্রশ্নটি আরো বেশি জোরালো হয়েছে গত বছর ডিসেম্বরে আমেরিকার কানেকটিকাটে নিউটাউন এলাকার স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে ২০ বছর বয়সী যুবক অ্যাডাম ল্যানজা কর্তৃক গুলিভর্তি বন্দুক নিয়ে স্কুলে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ২০ শিশু শিক্ষার্থীসহ মোট ২৭ জনকে হত্যা করার পর। নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে অ্যাডাম ল্যানজা নিজেও আত্মহত্যা করে। দুঃখজনক মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে অ্যাডাম ল্যানজার ওপর মাত্রাতিরিক্ত ভিডিও গেম খেলার প্রভাব রয়েছে বলে পরবর্তীকালে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। একসময় এটি পুরো আমেরিকায় ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিডিও গেম শিশুদের সহিংস করে তুলছে কিনা, এমন প্রশ্নও এখন তুলছেন অনেক মনস্তত্ত্ববিদ
স্যান্ডি হুক স্কুলে হত্যাকাণ্ডের পর অ্যাডাম ল্যানজার ব্যক্তিগত জীবনযাপন পদ্ধতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সে ভিডিও গেমে মারাত্মকভাবে আসক্ত ছিল। যেসব ভিডিও গেম বেশি সহিংস, অর্থাৎ যেসব গেমে পিস্তল, বন্দুক, হেলিকপ্টার, বিমান নিয়ে দুর্ধর্ষ যুদ্ধ মারামারি করার দৃশ্য রয়েছে, সেগুলোই তাকে আকর্ষণ করত বেশি। এখন মনস্তত্ত্ববিদরা এসব সহিংস ভিডিও গেম নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এসব সহিংস গেম এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। যেসব ভিডিও গেম মুভি বেশি সহিংস দৃশ্যসংবলিত, সেগুলো নষ্ট করার দাবিও উত্থাপিত হয়েছে সে দেশে। যদিও আমেরিকান শিশুদের সহিংস আচরণের আরো অনেক কারণ রয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক বলছেন এবং নিয়ে এখনো গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। কারো কারো মতে, সে দেশে শিশুদের সহিংস হওয়ার পেছনে পারিবারিকভাবে নিঃসঙ্গতা একাকিত্ব, মা-বাবার অনুপস্থিতি, পরিবারের সদস্যদের অতিমাত্রায় কর্মব্যস্ততার ফলে শিশুদের বেশি সময় দিতে না পারা, আমেরিকান নাগরিকদের অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতিও কম দায়ী নয়
শিশুদের সহিংস আচরণের পেছনে যত কারণ থাকুক না কেন, কম্পিউটার গেম যে তাদের চিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, তাতে সন্দেহ নেই। যেসব শিশু শুরুতে অল্প সময় ধরে ভিডিও গেম খেলত, একসময় তারা দীর্ঘ সময় এটি খেলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। একে আসক্তি বলা চলে। এতে তাদের পারিবারিক সামাজিক গুণাবলি অর্জন এবং পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের দেশে কম্পিউটার গেম শিশুদের ওপর কী প্রভাব ফেলে, আমরা তা খুঁজে দেখার চেষ্টাও করি না
উন্নত দেশে শিশুদের ভিডিও গেম খেলার যেমন অবাধ সুযোগ স্বাধীনতা রয়েছে, ঠিক তেমনি সেসব দেশে ভিডিও গেম শিশুদের কীভাবে ক্ষতি করে এবং তাদের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করে, তা নিয়েও ব্যাপক গবেষণা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। এখানে দেখা যায়, অভিভাবকরা শুধু বাজার থেকে শিশুর চাহিদামতো ভিডিও গেম কিনে দায়িত্ব শেষ করেন। শুধু তা- নয়, কখনো কখনো কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীরা নিজেরাই এসব ক্ষতিকর গেম কিনে আনে। ধরনের প্রবণতা শিশুসহ আমাদের কারো জন্যই ভালো নয়। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশে কি ক্ষতিকর ভিডিও গেমের আমদানি বিপণন নিষিদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়ছে?
লেখক: সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment