ঢাকা, শনিবার , ডিসেম্বর
২২, ২০১২, পৌষ
৮, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
সাম্প্রতিক
পারিবারিক বন্ধনহীন সমাজব্যবস্থাই আসলে দায়ী
মো. মুজিবুর রহমান
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের
কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত স্যান্ডি হুক এলিমেন্টরি স্কুলে ২০ বছর বয়সী এক বন্দুকধারীর
গুলিতে ওই স্কুলের ২০ শিশুশিক্ষার্থীসহ ২৮ জন নির্মমভাবে নিহত হন। নিউটাউনের ওই
স্কুলে গুলি করে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অ্যাডাম লানজা নামক এক কিশোর
অতর্কিতে গুলি ভর্তি বন্দুক নিয়ে স্কুলে ঢুকে গুলি চালানো শুরু করেন। তার গুলিতে
২০ জন শিশুশিক্ষার্থী মারা যায়। তার হাত থেকে স্কুলের অধ্যক্ষও রেহাই পাননি। তবে
বেঁচে গেছে ওই স্কুলের বাংলাদেশী ছাত্র মামনুন। স্কুলে হামলার আগে ওই বন্দুকধারী
বাড়িতে তার মাকেও গুলি করে হত্যা করে।
বন্দুক নিয়ে হঠাৎ স্কুলে উপস্থিত হয়ে অনেক শিক্ষার্থী
হত্যার এ ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে রোমহর্ষক ও ভয়াবহ। এটি
দ্বিতীয় ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হূদয়ে প্রচণ্ড
নাড়া দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শোকে বিহ্বল হয়ে টেলিভিশনে
দেয়া ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের হূদয় ভেঙে গেছে। এসব শিশুর বাবা-মা, বোন, স্বজন
সবার জন্য আমার মন আজ ব্যথিত।’ ঘটনার পর সারা দেশে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুকধারীর
অতর্কিতে আক্রমণের ফলে বহু শিক্ষার্থীর মৃত্যুবরণ এই প্রথম নয়; এর আগে ১৯৬৬ সালে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে
নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৬ জনকে হত্যা করা হয়। অন্য একবার কলোরাডোর ভার্জিনিয়া
কলম্বাইন হাইস্কুলের দুই ছাত্র ১৫ জন ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে। মাত্র কয়েক বছর
আগে ২০০৭ সালে ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটিতে এক বন্দুকধারী আকস্মিকভাবে হামলা
চালিয়ে ৩২ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করে। শুধু এ বছরই আগ্নেয়াস্ত্রের হামলার অন্তত
১৬টি ঘটনা ঘটেছে। গত এপ্রিলে ওকল্যান্ডে একটি কলেজে বন্দুকধারীর গুলিতে মারা যান
সাতজন। সিয়াটলের এক কফির দোকানে মে মাসে গুলিতে মৃত্যুবরণ কারণে আরও পাঁচজন।
জুলাইয়ে একটি সিনেমা হলে গুলিতে মারা যান ১২ জন। ওই ঘটনায় আহত হন আরও ৫৮ জন। এরপর
আগস্টে উইসকনসিনে গুলিতে নিহত হন সাতজন। পরবর্তী মাসে মিনেসোটায় এক কর্মস্থলে
সাবেক কর্মীর গুলিতে নিহত হন পাঁচজন। এ রকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলো অত্যন্ত হূদয়বিদারক।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে
বন্দুকধারীদের ঘন ঘন হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সবার মনে
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কেন
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করে শিক্ষার্থীদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়?
হত্যাকারীদের অনেকেই কিশোর-তরুণ। কেন তারা ছাত্রছাত্রীদের ওপর
হামলা চালায়? যুক্তরাষ্ট্র তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? এসব ঘটনা কি শুধু
আগ্নেয়াস্ত্র আইনের শিথিলতার কারণে ঘটছে? নাকি এর পেছনে
রয়েছে পারিবারিক অস্থিরতা অথবা অতিমাত্রায় ভোগবিলাসী জীবনের নেতিবাচক প্রভাব?
কানেকটিকাটের স্কুলে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সমাজবিজ্ঞানীরা
হয়তো ঘটনার পেছনের মূল কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। একসময় হয়তো আমরাও জানতে
পারব এ হূদয়বিদারক ঘটনার পেছনে প্রকৃত কারণ কী। কিন্তু তার আগে এসব ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক
মহলে যেসব বিশ্লেষণ চলছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা দরকার
আমাদের সবার স্বার্থেই।
কানেকটিকাটের নিউটাউনের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টরি স্কুলে
এডাম লানজা কেন হামলা চালাল তা এখনো বিস্তারিত জানা না গেলেও, আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অবাধ
চলাফেরায় তেমন বিধিনিষেধ না থাকাকে একটি কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক অধিকাংশ বিশ্লেষক
মনে করছেন। সারা দুনিয়ায় আলোচিত এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্র আইন
পর্যালোচনার দাবি উঠেছে সে দেশেরই বিভিন্ন মহল থেকে। সে দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের
সহজলভ্যতা এবং তা বহনের অবাধ অধিকার থাকায় অনেকে প্রকাশ্যেই গুলি ভর্তি রাইফেল
নিয়ে চলাফেরা করে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। পারিবারিকভাবে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ও
গুলি অনেক সময় অপ্রাপ্ত বয়স্কদের হাতে চলে যায়। ফলে সাময়িক উত্তেজনাবশত অনেকেই
আগ্নেয়াস্ত্রের বিপজ্জনক ব্যবহার করে। বাস্তবে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে
যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই অসহায় বলে ধারণা করা যায়। কারণ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে
দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যত বিভক্ত হয়ে আছে। নিউইয়র্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ
স্পষ্টতই বলেছেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসলে এ বিষয়ে বলিষ্ঠ
অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। কানেকটিকাটের সাবেক সিনেটর ক্রিস ডড বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্র আইন আদৌ ভারসাম্যপূর্ণ কি না, সে প্রশ্ন তোলার এখনই সময়। এসব মন্তব্য পর্যালোচনা করে বলা যায়,
যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে যতই উদ্বেগ
থাকুক না কেন; যেখানে প্রতিদিন বহু মানুষের জীবন বিপন্ন
হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ দখল এবং
বহন কতটা নিরাপদ ও যুক্তিসঙ্গত তা বিবেচনা করতে হবে আমেরিকানদেরই।
কানেকটিকাটের স্কুলে নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে
আমেরিকান পরিবারের কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,
সেখানে বেশির ভাগ পরিবারই ভঙ্গুর। তাদের অধিকাংশের পারিবারিক
জীবন বলতে তেমন কিছুই নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব সামান্য কারণে বিচ্ছেদ হয়ে
যাওয়া যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। দেখা যায়, সে দেশে নারী-পুরুষ
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কিছুকাল পর পৃথকভাবে বসবাস করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক
পুরুষ স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে অন্য নারীর সঙ্গে সংসার শুরু করে। একইভাবে অনেক
নারীও স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর নতুন করে ঘর বাঁধে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের
পরিবারগুলোর মধ্যে খুব কমসংখ্যকই স্থায়িত্ব লাভ করে। এ অবস্থায় পরিবারে জন্ম নেয়া
শিশুরা যখন দেখে, তাদের পিতা-মাতার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে
যায় কিংবা পিতা বা মাতা অথবা দুজনই অন্য নারী-পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে,
তখন তারা খুব অসহায় হয়ে পড়ে; ভেঙে পড়ে
মানসিকভাবে। এ পরিস্থিতি শিশুদের মধ্যে প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি করে, যা আমেরিকার নাগরিকরা সহজে বুঝতে পারেন কি না— এমন সন্দেহ থেকে যায়। এডাম লানজার ক্ষেত্রে
দেখা যায়, সে অনেকটা মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দিন পার
করছিল বলে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বলছে। সে একটা ভঙ্গুর পরিবারের সদস্য হওয়ায় তার
পারিবারিক বন্ধন ছিল না; পরিবারে তার ছিল না সৌহার্দপূর্ণ
অবস্থান। তার পিতা-মাতার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ২০০৮ সালে। যদিও তার
স্কুলশিক্ষিকা মা তাকে পরম স্নেহমমতা ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করার চেষ্টা করেছেন। তবু
এডাম পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল। এডাম হয়তো কোনো কারণে তার মায়ের ওপরও বিরক্ত ছিল,
রেগে গিয়েছিল প্রচণ্ডভাবে। যে কারণে সে তার মাকেই হত্যা করেছে
আগে। তার আপন বড় ভাইয়ের সঙ্গে ২০১০ সাল থেকে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে সে একাকিত্বে
ভুগত সারাক্ষণ। সন্দেহ নেই, সে মানসিকভাবে অনেকটাই
বিধ্বস্ত ছিল। এসব কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা তার পক্ষে অস্বাভাবিক ও
অসম্ভব কিছু নয়।
অন্যদিকে দেখা যায়, আমেরিকান সমাজব্যবস্থা অনেকটাই ভোগবাদী বৈশিষ্ট্যসংবলিত। সেখানে রয়েছে
ধন-সম্পদের প্রাচুর্যতা, নানা ধরনের ভোগসামগ্রীর
সহজলভ্যতা, উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিলাসী জীবন
অতিবাহিত করার সুযোগ, পারিবারিক বন্ধনহীন তরুণ-তরুণীসহ সব
বয়সের মানুষের যথেচ্ছ অবাধ বিচরণ, বাধাহীন
ব্যক্তিস্বাধীনতার কারণে অনেক নাগরিকের নিয়মনীতিবহির্ভূতভাবে জীবন অতিবাহিত করার
প্রয়াস। এ ছাড়া জীবনসংগ্রামে নাগরিকদের ব্যস্ততার কারণে পরিবারের সদস্যদের প্রতি
পিতা-মাতা-অভিভাবকদের সময় কম দেয়ার প্রবণতা পরিবার থেকে শিশুদের অনেকখানি
বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এসব কারণে আমেরিকান শিশুরা ছোটবেলা থেকেই নিজের সম্পর্কে
যেকোনো সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে ফেলে। এ ছাড়া তাদের অধিকাংশই অল্প বয়সে অভিভাবকহীন
হয়ে পড়ার হারও কম নয়। ফলে অনেক শিশু সেখানে যা ইচ্ছা তা করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
বলতে দ্বিধা নেই, অধিকাংশ আমেরিকানের জীবনে বিরাজ করে পারিবারিক স্নেহমমতা ও ভালোবাসার
প্রচণ্ড শূন্যতা। তাদের অনেকেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে চরম
উচ্ছৃঙ্খলভাবে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়। তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এতটাই
স্বাধীনতা ভোগ করে যে, রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন ব্যতীত
নিজেদের ভোগবিলাসের জন্য যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। এমনকি তাদের অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতার
কাছে রাষ্ট্র কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আমেরিকান নাগরিকরা প্রযুক্তিনির্ভর
জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কারণে ব্যক্তির সুষম ও স্বাভাবিক বিকাশে পরিবারের
প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে চলে। অথচ আমেরিকানদের মনে রাখা দরকার, শিশুর সামাজিক বিকাশে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা অন্য কোনো কিছু দিয়েই
পূরণ হতে পারে না; সম্ভবও নয়। আমেরিকানদের উচিত তাদের
স্বার্থেই পারিবারিক বন্ধনকে একটি স্থায়ী রূপ দেয়ার চেষ্টা করা। আমেরিকানদের
নিশ্চয়ই জানা আছে, বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই
দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন রয়েছে। ফলে এসব দেশে অর্থের প্রাচুর্যতা না থাকতে পারে,
ভোগবিলাসের সরঞ্জাম এখানে কম থাকতে পারে; কিন্তু এখানকার পরিবারগুলোর মধ্যে রয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি সুখ ও শান্তি।
এখানে রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন, আছে নীতিনৈতিকতার অনুশীলন;
সামাজিক মূল্যবোধ এখানে এখনো অনেক উন্নত। এসব কারণে এখানকার
পরিবারগুলোও শান্তিপ্রিয়। কাজেই স্থায়ী পারিবারিক কাঠামো নিয়ে আমেরিকানদের ভাবতে
হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
লেখক: টিচার্স ট্রেনিং
কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment