ঢাকা, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০১৪, ২৫ চৈত্র ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
এ কেমন
নৃশংসতা!
মো.
মুজিবুর রহমান
কয়েক
দিন আগে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের হাতে
নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী শিক্ষার্থী সায়াদ। কেন এ
নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটল তার কিছু সম্ভাব্য কারণও পত্র-পত্রিকায় উঠে এসেছে। তবে এটা
কোনো ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ঘটেনি বলে এরই মধ্যে খবর
বেরিয়েছে। এ ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটল যখন বিগত বছরে দেশজুড়ে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক
পরিস্থিতির কারণে বিপর্যস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষা
কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ওই
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এখন উত্তাল হয়ে আছে।
দুঃখজনক
হলেও সত্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়াদ হত্যাকাণ্ডের প্রায় পর পরই রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হয়েছে আরেক মেধাবী ছাত্রহত্যা। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে
সংঘটিত পর পর দুটি হত্যাকাণ্ডে আমরা বিস্ময়ে হতবাক। এ কেমন নৃশংসতা! কেন মধ্যযুগীয়
বর্বরতা! যারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছেন তারা কী করে দেশের প্রচলিত আইন-আদালতকে
বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাহস পান সেটাই সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার!
আমরা
গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি, এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করার মাধ্যমে
বহু বছর ধরে ছাত্রনেতা নামধারীদের অনেকেই এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করছেন না।
নিজেদের পকেট ভারি করতে গিয়ে তারা প্রায়ই টেন্ডারবাজিসহ আরো নানা ধরনের
অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব ঘটনা পুরো ছাত্ররাজনীতির ইতিবাচক
ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে ব্যাপকভাবে। সন্দেহ নেই, সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড দুটি
ছাত্ররাজনীতিকে আবারো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়
ছাত্ররাজনীতি চালু থাকবে কি থাকবে না—এ নিয়ে এখন
পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা আরম্ভ হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের নেতিবাচক ভূমিকাই
এসব আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের
কারণে এখন এ আলোচনা আরো জোরদার হবে বলে মনে হচ্ছে।
শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে অস্থিতিশীল ছাত্ররাজনীতির প্রেক্ষাপটে অনেকেই বলছেন, হাতেগোনা কিছু
ছাত্রনেতা পড়ালেখা থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টায় লিপ্ত
থাকায় ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ছাত্রদের
প্রধান দায়িত্ব নিয়মিতভাবে পড়ালেখা করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়সূচি
মোতাবেক পরীক্ষাসহ অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা হলেও তারা নিয়মনীতি
মেনে সেটা করতে চান না। উদ্বেগের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, মুষ্টিমেয় ছাত্রনেতা রাজনৈতিক
দলগুলোর নাম ভাঙ্গিয়ে অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার
সময়সূচি পাল্টিয়ে দেয়ায় প্রভাব বিস্তার করেন। তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রায় সময়ই অসহায় হয়ে পড়তে দেখা যায়। এমনকি তাদের সংঘবদ্ধ
আক্রমণের মুখে পুরো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে হস্তক্ষেপ
করতে হয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে অধিষ্ঠিত অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে
ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার খবরও পাওয়া যায়। কোনো কোনো শিক্ষক নিজের
স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ছাত্রনেতাদের ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি অনেক
সময় ক্যাম্পাসে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার পর যারা অপরাধী তাদের রক্ষা করার জন্যও
অনেক শিক্ষক আড়ালে কাজ করেন। ফলে ছাত্রনেতারা নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য আরো
বেশি উৎসাহিত
হন। এর জন্য এককভাবে ছাত্রনেতারা এবং ছাত্ররাজনীতি দায়ী কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে।
একই সঙ্গে শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়েও ভাবতে হবে। কারণ প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই
ভেতরে ভেতরে অনেক শিক্ষক ক্লাসরুমে পড়ানোর বদলে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা
করে চলেন এবং সুযোগ বুঝে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেন। এটা যে সংশ্লিষ্ট
প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন জানে না তা নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের পক্ষ থেকে
কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে স্বার্থান্বেষী শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে
ছাত্রনেতাদের লেলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। তারা উস্কানি দিয়ে ছাত্রদের ক্ষিপ্ত করে
পুরো পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলেন।
বাংলাদেশ
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সায়াদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংক্ষেপে পর্যালোচনা
করলে দেখা যায়, এখানেও পরীক্ষাকে পিছিয়ে দেয়ার আলোচনা নিয়ে তার সঙ্গে তারই
সহপাঠীদের প্রথমে বাকবিতণ্ডা ঘটে এবং পরে তাকে কয়েকজন মিলে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে
ফেলে। আমরা যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। যে পরিস্থিতিতে সায়াদকে পিটিয়ে মেরে
ফেলা হয়েছে তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণ
করার চেষ্টা চলছে যে, মানুষ মেরে ফেলার মতো সহজ কাজ বাংলাদেশে আর নেই। প্রায়ই
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিশু থেকে আরম্ভ করে নানা বয়সী
মানুষ মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় আইন ও বিচার
ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই যে কোনো হত্যাকাণ্ডের
উপযুক্ত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে দ্রুত। আর এটা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড আর না ঘটে তার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলতে হবে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। প্রয়োজনে
ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎভূমিকা
নিয়েও ভাবতে হবে নতুন করে।
লেখক
: সহযোগী অধ্যাপক, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment