Saturday, April 19, 2014

হল উদ্ধারে আন্দোলন





শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৪
(উপসম্পাদকীয়)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
হল উদ্ধারে আন্দোলন
মো. মুজিবুর রহমান | তারিখ: ১৯-০৪-২০১৪
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বেদখল হওয়া হলগুলো পুনরুদ্ধারের দাবিতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নানা ধরনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকে তারা হলের প্রধান গেট বন্ধ করে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক অবরোধ করেছে। এরপর অবস্থান কর্মসূচিও পালন করে তারা। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বেদখল হওয়া একটি হলের সামনে ব্যানার টাঙাতে যায়। কিন্তু সেখানে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে তারা অন্য একটি হলের সামনে ব্যানার টাঙিয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর ব্যবসায়ীরা ওই ব্যানার খুলে ফেলে এবং পুড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, হল পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জন করেছে। তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সমিতি। এখন অবশ্য শিক্ষক সমিতি পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হল উদ্ধার নিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীরা তাদের হল উদ্ধারের সঙ্গে আরো কয়েকটি দাবিও উত্থাপন করেছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছেবিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট নিরসনে নতুন হল এবং শিক্ষকদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ। উত্থাপিত দাবিগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হল সম্পর্কে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগেই স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছে। এরই মধ্যে কমিটি কাজও শুরু করে দিয়েছে। একই সঙ্গে আবাসিক সংকটের সুরাহা না করা পর্যন্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য পরিবহন সুবিধা চালুর সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের এক সভায়।
অন্যদিকে ১৬ মার্চ শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ পালন করেছে। তাদের দাবি মেনে না নেয়া হলে ১৯ মার্চ থেকে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয় ওই সমাবেশ থেকে। অবশ্য এরই মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুরোধে পূর্বঘোষিত ছাত্র ধর্মঘট ও অনশন কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে; তবে হল উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা অন্যান্য কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। শিক্ষক সমিতিও তাদের আন্দোলন স্থগিত করেছে বলে খবর বেরিয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হল নিজেদের দখলে নিতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালে কয়েকটি হল স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এগুলো উদ্ধারে তত্কালীন জগন্নাথ কলেজ অনেকবার চেষ্টা চালিয়েও কোনো ফল পায়নি। বরং এখন জানা যাচ্ছে, বেদখল হওয়া ১০টি হলের মধ্যে অনেক হলের নাকি বৈধ কাগজপত্রই নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে! বেদখল হওয়া হল উদ্ধারে একপর্যায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা দায়ের করলে এর রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকূলে এলেও হলগুলোর দখল বুঝে পায়নি কর্তৃপক্ষ। আদালতের রায় বাস্তবায়নে তত্কালীন সরকারের তরফ থেকেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে বেদখল হওয়া হলগুলো এখন পর্যন্ত বেদখলই রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নিজেদের দখলে নিতে আন্দোলন শুরু করেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকটে ভুগছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনাও শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। অনেকেই বলছেন, যেহেতু হলগুলো বেদখল হওয়ার বিষয়টি সরকারের নজরে রয়েছে এবং এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটিও গঠন করেছে, সেজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। শিক্ষার্থীদের আবাসনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। হল উদ্ধারের দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত, হলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করতে আইনসম্মত উপায়ে এগিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারে সরকারের সহায়তা জরুরি। আমরা বুঝতে অপারগ, দেশে কার্যকর সরকার ব্যবস্থা, উপযুক্ত আইন-আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও রয়েছে, তারপরও হলগুলো দখলমুক্ত করতে গিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হবে কেন? আন্দোলন ছাড়া কি হল উদ্ধারের অন্য কোনো পথ খোলা নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা কার্যক্রম বিঘ্নের মুখে ঠেলে দিয়ে হল উদ্ধারের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কতটুকু যৌক্তিক, সেটা ভেবে দেখতে হবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের। অভিভাবকরা অনেক আশা নিয়ে তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন পড়ালেখা করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাদের প্রায় সবারই নির্ভর করতে হয় অভিভাবকদের আয়ের ওপর। অভিভাবকরা এখনো অনেক কষ্ট স্বীকার করে সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে পড়ালেখা করানোর বিপুল ব্যয়ভার বহন করে চলেছেন। এ অবস্থায় আন্দোলনের কারণে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষের ব্যাপ্তি বেড়ে যায়, তাহলে অভিভাবকদের ওপর আর্থিক চাপ আরো বাড়বে। এমনকি সময়মতো ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় সেশনজটের কবলে পড়তে হবে শিক্ষার্থীদের। পড়ালেখা শেষ করার আগেই অনেকের সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স ফুরিয়ে যাবে। এটা কারো জন্যই ভালো নয়। এ অবস্থায় হল উদ্ধারের দাবি বহাল রেখে কীভাবে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়া যায়, তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত হোক দ্রুত, একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্নও না ঘটুক। এ ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ কাম্য।
আমরা জানি, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যাপক সংকট রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও এসব সমস্যার বাইরে নয়। বরং অন্য অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা কিছুটা হলেও বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ কয়েক বছর আগেও এটি সরকারি কলেজ ছিল। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে সরকারি কলেজ চলতে পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। কারণ সরকারি কলেজের যাবতীয় আর্থিক দায়দায়িত্ব সরকারের। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এমনটি নয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ভৌত সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, বাস্তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তা নেই। বরং দেখা যায়, স্বল্প পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজস্ব আয় বাড়াতে পারছে না। অপ্রিয় হলেও সত্য, পুরান ঢাকার যে এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে, সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে নেয়ার অনুকূলে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দরকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, উন্মুক্ত ক্যাম্পাস, আকর্ষণীয় শ্রেণীকক্ষ, আধুনিক গ্রন্থাগার, পাঠদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য মানসম্মত আবাসনের ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কী অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে, তা সবার জানা আছে। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার, উন্নত শিক্ষার স্বার্থে সেগুলো সরকারকেই করতে হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত হলেও আর্থিকভাবে অনেকাংশে সরকারের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং হল উদ্ধারের আন্দোলনের ফলে যাতে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়, তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ

No comments:

Post a Comment