Saturday, April 19, 2014

চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতা



ঢাকা, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০১৪, ৬ বৈশাখ ১৪২১, ১৮ জমাদিউস সানী ১৪৩৫
(দৃষ্টিকোণ)
চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতা
মো. মুজিবুর রহমান
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রায়ই চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধভাবে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের হামলার মাধ্যমে কখনো চিকিৎসকদের মারধর করাসহ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়। ফলে নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়ে চিকিৎসকরা চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এ কারণে চিকিৎসাধীন বহু রোগীর জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে নতুন না হলেও বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোনো রোগীর মৃত্যু হলে অনেক সময় তার আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা চিকিৎসকদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালানোর ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে। এটা অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশআমরা বেশ বুঝতে পারি, চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোনো রোগীর মৃত্যু হলে তার আত্মীয়-স্বজনরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু ভুল চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে একযোগে চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালানো, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভাঙচুর করা মেনে নেয়া যায় না। এ ধরনের হামলার মাধ্যমে চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীন পরিবেশের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়, যার ফলে সেখানে পুরো চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হয়; বিপন্ন হয়ে ওঠে অন্য রোগীদের জীবন।
সম্প্রতি ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন রোগীর মৃত্যুর কারণে মৃত ব্যক্তির স্বজন পরিচয়ে ৬০-৭০ জনের একটি গ্রুপ চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। নারী চিকিৎসকও এ হামলার হাত থেকে রেহাই পাননি। তারা হাসপাতালও ভাঙচুর করেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এ কারণে চিকিৎসকরা হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে কর্মবিরতি ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে কার্যত বারডেমে ব্যাহত হয়েছে চিকিৎসাসেবা। শুধু তাই নয়, বহু দূর-দূরান্ত থেকে আগত অনেক জটিল রোগী সংকটের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় দুদিন পর চিকিৎসকরা সরকারি উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে চিকিৎসাসেবায় যোগ দিয়েছেন।
চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর মৃত্যু হলে প্রথমেই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগ উত্থাপন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ফলে চিকিৎসকরা সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এভাবে রোগীদের উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা দেয়া যায় না। অথচ ভুল চিকিৎসার অভিযোগ দেশের প্রচলিত আদালতেই উত্থাপন করা যায়। তারও আগে মৃত রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা ইচ্ছা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। সেখানে কোনো প্রতিকার না পেলে তবেই তারা ন্যায় বিচারের দাবিতে আদালতে যেতে পারেন। অবশ্য প্রথম অবস্থায়ও তাদের আদালতে যেতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কোনো রোগীর মৃত্যু হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের অনিরাপদ করে তোলা এবং অন্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা গ্রহণে বিঘ্ন ঘটানো কতটা সমীচীন সেটা ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। যে রোগীর মৃত্যু ঘটে তার স্বজনদের মানসিক অবস্থার বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু তাই বলে চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালানো সমর্থনযোগ্য নয়। বরং এ ক্ষেত্রে ধৈর্য্যধারণ অতি জরুরি।
অন্যদিকে দেখা যায়, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে রোগীর চিকিৎসায় অবহেলার গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয় প্রায়ই। এ ধরনের সব অভিযোগই ভিত্তিহীন নয়। চিকিৎসকদের অবশ্যই রোগীর সেবায় সাধ্যমতো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমরা দেখছি, অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে অর্থের বিনিময়ে রোগী দেখায় ক্লান্তি অনুভব করেন না। অথচ সরকারি হাসপাতালে তারা প্রায়ই সময় কম দেন। অনেক সময় হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসকদের খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চিকিৎসকদের আরো বেশি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েই এ ধরনের অভিযোগের অবসান ঘটাতে হবে। তবে সরকারি হাসপাতালে প্রত্যেক রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা চালু থাকা দরকার তা সরকার পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত করতে পারছে নাএটা সত্য। প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে গেলেই দেখা যায়, কোনো ওয়ার্ডে যতজন রোগী থাকার কথা বাস্তবে আছেন আরো অনেক বেশি। কখনো কখনো রোগীকে ওয়ার্ডের মেঝেয় শুয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। আবার মেঝেয় স্থান না পেয়ে ওয়ার্ডের বারান্দায় নিজের বিছানা পেতে শুয়ে থাকতে হচ্ছে অনেককে। রোগীদের নিজ ব্যয়ে ওষুধপত্র কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। এ ধরনের অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থার মধ্যে চিকিৎসকদের পক্ষে ঠিকমতো চিকিৎসাও দেয়া যায় না। আবার সরকারি হাসপাতালে আগত রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় চিকিৎসকরা সবাইকে একসঙ্গে চিকিৎসা দিতে পারেন না। ফলে তাদের জীবন সংকটের মুখে পড়ে। কখনো কখনো বিলম্বে চিকিৎসা শুরুর কারণে অনেকের মৃত্যুও ঘটে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য কে দায়ী সেটা তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ যে কিছুটা অনুধাবন করা যায় না তা নয়। কাজেই দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে রোগীর তুলনায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা সরকার যেমন নিশ্চিত করতে পারছে না, তেমনি সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে চিকিৎসকদেরও বেশি কিছু করার থাকে না। এ কারণে নিম্নবিত্তের মানুষরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করে এ ধরনের পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও তাদের দায়িত্ব পালনে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালানোয় বিরত থাকতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDRfMTlfMTRfMV81XzFfMTI0MjAx

হল উদ্ধারে আন্দোলন





শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৪
(উপসম্পাদকীয়)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
হল উদ্ধারে আন্দোলন
মো. মুজিবুর রহমান | তারিখ: ১৯-০৪-২০১৪
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের বেদখল হওয়া হলগুলো পুনরুদ্ধারের দাবিতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নানা ধরনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকে তারা হলের প্রধান গেট বন্ধ করে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক অবরোধ করেছে। এরপর অবস্থান কর্মসূচিও পালন করে তারা। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বেদখল হওয়া একটি হলের সামনে ব্যানার টাঙাতে যায়। কিন্তু সেখানে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে তারা অন্য একটি হলের সামনে ব্যানার টাঙিয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর ব্যবসায়ীরা ওই ব্যানার খুলে ফেলে এবং পুড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, হল পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জন করেছে। তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সমিতি। এখন অবশ্য শিক্ষক সমিতি পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হল উদ্ধার নিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীরা তাদের হল উদ্ধারের সঙ্গে আরো কয়েকটি দাবিও উত্থাপন করেছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছেবিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট নিরসনে নতুন হল এবং শিক্ষকদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ। উত্থাপিত দাবিগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হল সম্পর্কে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগেই স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছে। এরই মধ্যে কমিটি কাজও শুরু করে দিয়েছে। একই সঙ্গে আবাসিক সংকটের সুরাহা না করা পর্যন্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য পরিবহন সুবিধা চালুর সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের এক সভায়।
অন্যদিকে ১৬ মার্চ শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ পালন করেছে। তাদের দাবি মেনে না নেয়া হলে ১৯ মার্চ থেকে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয় ওই সমাবেশ থেকে। অবশ্য এরই মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুরোধে পূর্বঘোষিত ছাত্র ধর্মঘট ও অনশন কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে; তবে হল উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা অন্যান্য কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। শিক্ষক সমিতিও তাদের আন্দোলন স্থগিত করেছে বলে খবর বেরিয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হল নিজেদের দখলে নিতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালে কয়েকটি হল স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এগুলো উদ্ধারে তত্কালীন জগন্নাথ কলেজ অনেকবার চেষ্টা চালিয়েও কোনো ফল পায়নি। বরং এখন জানা যাচ্ছে, বেদখল হওয়া ১০টি হলের মধ্যে অনেক হলের নাকি বৈধ কাগজপত্রই নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে! বেদখল হওয়া হল উদ্ধারে একপর্যায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা দায়ের করলে এর রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকূলে এলেও হলগুলোর দখল বুঝে পায়নি কর্তৃপক্ষ। আদালতের রায় বাস্তবায়নে তত্কালীন সরকারের তরফ থেকেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে বেদখল হওয়া হলগুলো এখন পর্যন্ত বেদখলই রয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নিজেদের দখলে নিতে আন্দোলন শুরু করেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকটে ভুগছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনাও শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। অনেকেই বলছেন, যেহেতু হলগুলো বেদখল হওয়ার বিষয়টি সরকারের নজরে রয়েছে এবং এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটিও গঠন করেছে, সেজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। শিক্ষার্থীদের আবাসনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। হল উদ্ধারের দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত, হলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করতে আইনসম্মত উপায়ে এগিয়ে যাওয়া। এ ব্যাপারে সরকারের সহায়তা জরুরি। আমরা বুঝতে অপারগ, দেশে কার্যকর সরকার ব্যবস্থা, উপযুক্ত আইন-আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও রয়েছে, তারপরও হলগুলো দখলমুক্ত করতে গিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হবে কেন? আন্দোলন ছাড়া কি হল উদ্ধারের অন্য কোনো পথ খোলা নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা কার্যক্রম বিঘ্নের মুখে ঠেলে দিয়ে হল উদ্ধারের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কতটুকু যৌক্তিক, সেটা ভেবে দেখতে হবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের। অভিভাবকরা অনেক আশা নিয়ে তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন পড়ালেখা করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাদের প্রায় সবারই নির্ভর করতে হয় অভিভাবকদের আয়ের ওপর। অভিভাবকরা এখনো অনেক কষ্ট স্বীকার করে সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে পড়ালেখা করানোর বিপুল ব্যয়ভার বহন করে চলেছেন। এ অবস্থায় আন্দোলনের কারণে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষের ব্যাপ্তি বেড়ে যায়, তাহলে অভিভাবকদের ওপর আর্থিক চাপ আরো বাড়বে। এমনকি সময়মতো ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় সেশনজটের কবলে পড়তে হবে শিক্ষার্থীদের। পড়ালেখা শেষ করার আগেই অনেকের সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স ফুরিয়ে যাবে। এটা কারো জন্যই ভালো নয়। এ অবস্থায় হল উদ্ধারের দাবি বহাল রেখে কীভাবে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়া যায়, তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত হোক দ্রুত, একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্নও না ঘটুক। এ ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ কাম্য।
আমরা জানি, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যাপক সংকট রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও এসব সমস্যার বাইরে নয়। বরং অন্য অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা কিছুটা হলেও বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ কয়েক বছর আগেও এটি সরকারি কলেজ ছিল। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে সরকারি কলেজ চলতে পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। কারণ সরকারি কলেজের যাবতীয় আর্থিক দায়দায়িত্ব সরকারের। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এমনটি নয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ভৌত সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, বাস্তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তা নেই। বরং দেখা যায়, স্বল্প পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজস্ব আয় বাড়াতে পারছে না। অপ্রিয় হলেও সত্য, পুরান ঢাকার যে এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে, সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে নেয়ার অনুকূলে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দরকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, উন্মুক্ত ক্যাম্পাস, আকর্ষণীয় শ্রেণীকক্ষ, আধুনিক গ্রন্থাগার, পাঠদানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য মানসম্মত আবাসনের ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কী অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে, তা সবার জানা আছে। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার, উন্নত শিক্ষার স্বার্থে সেগুলো সরকারকেই করতে হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত হলেও আর্থিকভাবে অনেকাংশে সরকারের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং হল উদ্ধারের আন্দোলনের ফলে যাতে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়, তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ

Tuesday, April 8, 2014

এ কেমন নৃশংসতা!



ঢাকা, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০১৪, ২৫ চৈত্র ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
এ কেমন নৃশংসতা!
মো. মুজিবুর রহমান
কয়েক দিন আগে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী শিক্ষার্থী সায়াদ। কেন এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটল তার কিছু সম্ভাব্য কারণও পত্র-পত্রিকায় উঠে এসেছে। তবে এটা কোনো ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ঘটেনি বলে এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে। এ ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটল যখন বিগত বছরে দেশজুড়ে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিপর্যস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এখন উত্তাল হয়ে আছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়াদ হত্যাকাণ্ডের প্রায় পর পরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হয়েছে আরেক মেধাবী ছাত্রহত্যা। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে সংঘটিত পর পর দুটি হত্যাকাণ্ডে আমরা বিস্ময়ে হতবাক। এ কেমন নৃশংসতা! কেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা! যারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছেন তারা কী করে দেশের প্রচলিত আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাহস পান সেটাই সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার!
আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি, এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করার মাধ্যমে বহু বছর ধরে ছাত্রনেতা নামধারীদের অনেকেই এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করছেন না। নিজেদের পকেট ভারি করতে গিয়ে তারা প্রায়ই টেন্ডারবাজিসহ আরো নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব ঘটনা পুরো ছাত্ররাজনীতির ইতিবাচক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে ব্যাপকভাবে। সন্দেহ নেই, সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড দুটি ছাত্ররাজনীতিকে আবারো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্ররাজনীতি চালু থাকবে কি থাকবে নাএ নিয়ে এখন পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা আরম্ভ হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের নেতিবাচক ভূমিকাই এসব আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের কারণে এখন এ আলোচনা আরো জোরদার হবে বলে মনে হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিতিশীল ছাত্ররাজনীতির প্রেক্ষাপটে অনেকেই বলছেন, হাতেগোনা কিছু ছাত্রনেতা পড়ালেখা থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকায় ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ছাত্রদের প্রধান দায়িত্ব নিয়মিতভাবে পড়ালেখা করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়সূচি মোতাবেক পরীক্ষাসহ অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা হলেও তারা নিয়মনীতি মেনে সেটা করতে চান না। উদ্বেগের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, মুষ্টিমেয় ছাত্রনেতা রাজনৈতিক দলগুলোর নাম ভাঙ্গিয়ে অনেক সময় নিজেদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সময়সূচি পাল্টিয়ে দেয়ায় প্রভাব বিস্তার করেন। তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রায় সময়ই অসহায় হয়ে পড়তে দেখা যায়। এমনকি তাদের সংঘবদ্ধ আক্রমণের মুখে পুরো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে অধিষ্ঠিত অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার খবরও পাওয়া যায়। কোনো কোনো শিক্ষক নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ছাত্রনেতাদের ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি অনেক সময় ক্যাম্পাসে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার পর যারা অপরাধী তাদের রক্ষা করার জন্যও অনেক শিক্ষক আড়ালে কাজ করেন। ফলে ছাত্রনেতারা নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য আরো বেশি উৎসাহিত হন। এর জন্য এককভাবে ছাত্রনেতারা এবং ছাত্ররাজনীতি দায়ী কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়েও ভাবতে হবে। কারণ প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ভেতরে ভেতরে অনেক শিক্ষক ক্লাসরুমে পড়ানোর বদলে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন এবং সুযোগ বুঝে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেন। এটা যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন জানে না তা নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে স্বার্থান্বেষী শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছাত্রনেতাদের লেলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। তারা উস্কানি দিয়ে ছাত্রদের ক্ষিপ্ত করে পুরো পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সায়াদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংক্ষেপে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানেও পরীক্ষাকে পিছিয়ে দেয়ার আলোচনা নিয়ে তার সঙ্গে তারই সহপাঠীদের প্রথমে বাকবিতণ্ডা ঘটে এবং পরে তাকে কয়েকজন মিলে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলে। আমরা যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। যে পরিস্থিতিতে সায়াদকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে, মানুষ মেরে ফেলার মতো সহজ কাজ বাংলাদেশে আর নেই। প্রায়ই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিশু থেকে আরম্ভ করে নানা বয়সী মানুষ মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই যে কোনো হত্যাকাণ্ডের উপযুক্ত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে দ্রুত। আর এটা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড আর না ঘটে তার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলতে হবে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। প্রয়োজনে ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যভূমিকা নিয়েও ভাবতে হবে নতুন করে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com