ঢাকা, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০১৪, ৬ বৈশাখ ১৪২১, ১৮ জমাদিউস সানী ১৪৩৫
(দৃষ্টিকোণ)
চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতা
মো.
মুজিবুর রহমান
সরকারি-বেসরকারি
হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রায়ই চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধভাবে
চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের হামলার মাধ্যমে কখনো চিকিৎসকদের
মারধর করাসহ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়।
ফলে নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়ে চিকিৎসকরা চিকিৎসাসেবা
বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এ কারণে চিকিৎসাধীন বহু রোগীর জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। এ
ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে নতুন না হলেও বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায়
কোনো রোগীর মৃত্যু হলে অনেক সময় তার আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা চিকিৎসকদের ওপর নির্বিচারে
হামলা চালানোর ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে। এটা অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ। আমরা বেশ বুঝতে পারি, চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোনো রোগীর মৃত্যু হলে তার আত্মীয়-স্বজনরা
মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু ভুল চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে
একযোগে চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালানো, হাসপাতাল ও
ক্লিনিকে ভাঙচুর করা মেনে নেয়া যায় না। এ ধরনের হামলার মাধ্যমে চিকিৎসকদের
নিরাপত্তাহীন পরিবেশের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়, যার ফলে সেখানে
পুরো চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হয়; বিপন্ন হয়ে ওঠে অন্য
রোগীদের জীবন।
সম্প্রতি
ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন রোগীর মৃত্যুর কারণে মৃত
ব্যক্তির স্বজন পরিচয়ে ৬০-৭০ জনের একটি গ্রুপ চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালিয়েছেন।
নারী চিকিৎসকও এ হামলার হাত থেকে রেহাই পাননি। তারা হাসপাতালও ভাঙচুর করেন বলে
গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এ কারণে চিকিৎসকরা হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে কর্মবিরতি
ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে কার্যত বারডেমে
ব্যাহত হয়েছে চিকিৎসাসেবা। শুধু তাই নয়, বহু দূর-দূরান্ত থেকে আগত অনেক জটিল রোগী সংকটের মুখে পড়েন। এ অবস্থায়
দুদিন পর চিকিৎসকরা সরকারি উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে চিকিৎসাসেবায়
যোগ দিয়েছেন।
চিকিৎসকদের
ওপর হামলার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর মৃত্যু হলে প্রথমেই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভুল
চিকিৎসার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগ উত্থাপন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওপর
হামলার ঘটনা ঘটে। ফলে চিকিৎসকরা সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এভাবে রোগীদের উপযুক্ত
চিকিৎসাসেবা দেয়া যায় না। অথচ ভুল চিকিৎসার অভিযোগ দেশের প্রচলিত আদালতেই উত্থাপন
করা যায়। তারও আগে মৃত রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা ইচ্ছা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিংবা
স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে লিখিত
অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। সেখানে কোনো প্রতিকার না পেলে তবেই তারা ন্যায়
বিচারের দাবিতে আদালতে যেতে পারেন। অবশ্য প্রথম অবস্থায়ও তাদের আদালতে যেতে কোনো
বাধা নেই। কিন্তু হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কোনো রোগীর মৃত্যু হলে সেখানে কর্তব্যরত
চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের অনিরাপদ করে তোলা এবং অন্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা
গ্রহণে বিঘ্ন ঘটানো কতটা সমীচীন সেটা ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। যে রোগীর
মৃত্যু ঘটে তার স্বজনদের মানসিক অবস্থার বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু
তাই বলে চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালানো সমর্থনযোগ্য নয়। বরং এ ক্ষেত্রে ধৈর্য্যধারণ
অতি জরুরি।
অন্যদিকে
দেখা যায়, চিকিৎসকদের
বিরুদ্ধে রোগীর চিকিৎসায় অবহেলার গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয় প্রায়ই। এ ধরনের সব
অভিযোগই ভিত্তিহীন নয়। চিকিৎসকদের অবশ্যই রোগীর সেবায় সাধ্যমতো ত্যাগ স্বীকার করতে
হবে। আমরা দেখছি, অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে অর্থের
বিনিময়ে রোগী দেখায় ক্লান্তি অনুভব করেন না। অথচ সরকারি হাসপাতালে তারা প্রায়ই
সময় কম দেন। অনেক সময় হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসকদের খুঁজে পাওয়া যায় না।
ফলে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চিকিৎসকদের আরো বেশি দায়িত্ববোধের
পরিচয় দিয়েই এ ধরনের অভিযোগের অবসান ঘটাতে হবে। তবে সরকারি হাসপাতালে প্রত্যেক
রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা চালু থাকা দরকার
তা সরকার পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত করতে পারছে না—এটা সত্য। প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে গেলেই দেখা যায়,
কোনো ওয়ার্ডে যতজন রোগী থাকার কথা বাস্তবে আছেন আরো অনেক
বেশি। কখনো কখনো রোগীকে ওয়ার্ডের মেঝেয় শুয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। আবার মেঝেয়
স্থান না পেয়ে ওয়ার্ডের বারান্দায় নিজের বিছানা পেতে শুয়ে থাকতে হচ্ছে অনেককে। রোগীদের
নিজ ব্যয়ে ওষুধপত্র কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। এ ধরনের অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থার
মধ্যে চিকিৎসকদের পক্ষে ঠিকমতো চিকিৎসাও দেয়া যায় না। আবার সরকারি হাসপাতালে আগত
রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় চিকিৎসকরা সবাইকে একসঙ্গে চিকিৎসা দিতে পারেন না। ফলে
তাদের জীবন সংকটের মুখে পড়ে। কখনো কখনো বিলম্বে চিকিৎসা শুরুর কারণে অনেকের
মৃত্যুও ঘটে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য কে দায়ী সেটা তদন্তের মাধ্যমে
বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ যে কিছুটা
অনুধাবন করা যায় না তা নয়। কাজেই দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে রোগীর তুলনায় প্রয়োজনীয়
চিকিৎসাসেবা সরকার যেমন নিশ্চিত করতে পারছে না, তেমনি সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্য
দিয়ে চিকিৎসকদেরও বেশি কিছু করার থাকে না। এ কারণে নিম্নবিত্তের মানুষরা চিকিৎসাসেবা
থেকে বঞ্চিত হন। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করে এ ধরনের
পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও তাদের দায়িত্ব পালনে আরো বেশি
সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ওপর হামলা
চালানোয় বিরত থাকতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
লেখক
: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.comhttp://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDRfMTlfMTRfMV81XzFfMTI0MjAx