Monday, August 5, 2013

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা প্রসঙ্গে



জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা প্রসঙ্গে
সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০১৩
(উপসম্পাদকীয়)
মো. মুজিবুর রহমান | তারিখ: ০৫-০৮-২০১৩
যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে পাসকৃত একটি আইনের মাধ্যমে এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেগুলো দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ পর কতটুকু পূরণ হয়েছে সেটা এখন বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় বিশেষভাবে আশা করা হয়েছিল দেশের উচ্চশিক্ষায় সেশনজট নিরসন করে শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্ন শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় সেশনজট নিরসন করা দূূরের কথা বিভিন্ন কোর্সে পূর্বের চেয়ে সেশনজট বেড়েছে আরও বেশি। আমরা এখন দেখছি, প্রতিষ্ঠালগ্নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যেসব প্রত্যাশা আমাদের সামনে ছিল সেগুলো যথাযথভাবে পূরণ করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়টিবরং দেখা যায়, সেশনজটের চাপে পড়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন প্রলম্বিত হয়েছে। বেড়ে গেছে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ। আর অভিভাবকদের খরচ বেড়ে গেছে এবং সন্তানের শিক্ষাজীবন নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তাও বাড়ছে সমান তালে। এখন বছরের অনার্স কোর্স শেষ করতে -বছর এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স শেষ করতে ২ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। সব মিলিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৫ বছরের শিক্ষাজীবন শেষ করতে ৭-৮ বছর, কখনও কখনও আরও অনেক বেশি সময় লাগে। এসব নিয়ে প্রায়ই পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। কিন্তু কিছুতেই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটে না।
এক বছর মেয়াদি প্রফেশনাল কোর্সগুলোও নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারছে না এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। এক বছরের বিএড কোর্স শেষ করতে এক বছরের বেশি সময় লাগছে। অথচ পরীক্ষাসহ এ কোর্সটি এক বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। আগে বিএড ও এমএড কোর্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হওয়ার সময় দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া নির্ধারিত দিনে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরম্ভ হতো এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কোর্সের কার্যক্রম শেষ হতো। তখন শিক্ষাবর্ষের শেষ দিনে প্রশিক্ষণার্থীদের কোর্স সম্পন্নের প্রত্যয়নপত্র দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোর্সের সমাপ্তি ঘোষণা করা হতো। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এখন কোর্স আরম্ভ করতেই এক মাসের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। বিভিন্ন কোর্সের পরীক্ষাও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। ফলাফল প্রকাশেও লেগে যাচ্ছে অনেক বেশি সময়। এসব সমস্যা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে সেটাই এখন আসল প্রশ্ন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের দীর্ঘসূত্রতার কারণে কীভাবে সেশনজটের সৃষ্টি হয় তা একটি দৃষ্টান্ত দিলেই পাঠকদের কাছে স্পষ্ট হবে।
এখন চলছে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে এমএড কোর্সে প্রশিক্ষণার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া। পাঠকদের বলে রাখা ভালো, চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী এমএড কোর্সটির প্রশিক্ষণ আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল ১ জুলাই, ২০১৩ এবং পরীক্ষাসহ কোর্সের যাবতীয় কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা ৩০ জুন ২০১৪চলতি শিক্ষাবর্ষে এমএড কোর্সে ভর্তির সময়সূচি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভর্তিচ্ছুক প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র গ্রহণশেষে ভর্তির জন্য যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা ২৩ জুলাই প্রকাশের কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটি সময়মতো করতে পারেনি। এমনকি এক সপ্তাহেও ভর্তিচ্ছুকদের যোগ্য তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ফলে পূর্বনির্ধারিত ২৪ জুলাই থেকে ভর্তি আরম্ভ হয়নি। এ কারণে বিনা নোটিসে ভর্তির তারিখ পিছিয়ে গেছে আপনাআপনিভাবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যখন ভর্তির জন্য যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ততক্ষণে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে ভর্তির জন্য আবেদনকারী প্রার্থীরা প্রতিদিনই সংশ্লিষ্ট কলেজে খোঁজখবর নিয়েছেন, ঘোরাফেরা করেছেন। এর ফলে তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে, আর্থিক ব্যয় তো আছেই। এটা যে শুধু এ বছরই ঘটেছে তা নয়। বরং প্রশিক্ষণ কোর্স নিয়ে প্রায় প্রতিবছরই এ ধরনের জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন না করে পারা যায় না। আমাদের শিক্ষার্থীরা কীভাবে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তি পাবে সেটা ভেবে দেখতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন কোর্স পরিচালনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতার প্রশ্নটিও বিবেচনা করতে হবে।
পাঠকদের জানিয়ে রাখি, দেশে ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মধ্যে মাত্র ৭টি কলেজে এমএড কোর্সে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। নির্দিষ্ট ৭টি কলেজে নির্ধারিত মোট ৮০৫টি আসনের বিপরীতে এ বছর ভর্তির জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করেছে মাত্র ৩৯১ জন প্রার্থী। এই ৩৯১ জন প্রার্থীকে বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি এক সপ্তাহেরও বেশি সময় লেগে যায় তাহলে কি বলা যাবে বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারছে? দেখা যায়, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কোর্স নিয়ে নানামুখী অবহেলার কারণে অনেকেই প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে প্রতিবছর অর্ধেকেরও বেশি আসন খালি থেকে যায়। এ কারণে সরকারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়।
প্রাজ্ঞ পাঠকরা জানেন, যে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ অন্য সাধারণ পড়ালেখার মতো নয়। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে ধাপে ধাপে এগুতে হয়। এখানে রয়েছে প্রশিক্ষণের নির্দিষ্ট সময়সূচি, রয়েছে ধারাবাহিকভাবে পদ্ধতি ও কলাকৌশল অনুসরণ করে প্রশিক্ষণ দেয়ার নিয়ম। এ সময়সূচি ও নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটলে প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কোর্সটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হলেও এবং এ কোর্স শেষে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ডিগ্রি প্রদান করা হলেও এটি এখন বলতে গেলে অন্য সাধারণ কোর্সের পড়ালেখার মতো এগিয়ে চলেছে ঢিমেতালে। প্রশিক্ষণের যেসব নিয়মনীতি রয়েছে সেগুলো অনেকাংশে থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। ফলে শিক্ষক প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাস্তবে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র ৭টি কলেজে নির্দিষ্ট সময়ে কোর্সটি আরম্ভ করতে পারছে না। এ বছর এমএড কোর্সের প্রশিক্ষণ শুরুর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ আগস্ট। আমাদের মনে প্রশ্ন, একবছর মেয়াদের শিক্ষাবছর থেকে যদি ক্লাস আরম্ভ করতে দেড় মাসের বেশি সময় পার হয়ে যায় তাহলে আর শিক্ষাবর্ষের বাকি থাকে কী? অবশিষ্ট সময়ে নির্ধারিত কারিকুলাম সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না সেটা কি কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে?
বিএড ও এমএড কোর্সে প্রশিক্ষণ নিতে আসা প্রার্থীদের মধ্যে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরাও থাকেন। এ ধরনের প্রার্থীদের সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এক বছর মেয়াদের প্রেষণ আদেশ দিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোয় পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু কোর্সটি যখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আরম্ভ হতে পারে না এবং এক বছরের মধ্যে শেষ হয় না তখন ওইসব প্রার্থীদের বেলায় দেখা দেয় চাকুরিসংক্রান্ত নানা ধরনের জটিলতা। এমনকি তাদের কর্মস্থলে যোগদান নিয়ে পোহাতে হয় অনেক ঝামেলা। আবার অনেক সরকারি প্রার্থী শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিন অর্থাত্ ১ জুলাই কোর্সে যোগদানের জন্য সরকারি আদেশ নিয়ে কর্মস্থল থেকে বিমুক্ত হয়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজে এসে দেখেন কোর্সটি কার্যত আরম্ভই হয়নি। এ কারণে তাদের আরও বেশি জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এর সবকিছুই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাসময়ে কোর্স আরম্ভ না করার কারণে ঘটে। এ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেয়ার উপায় কী?
লেখক: সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com 

No comments:

Post a Comment