Friday, August 16, 2013

এইচএসসির ফল ও শিক্ষার মান



আগস্ট ১৬, ২০১৩, শুক্রবার : ভাদ্র ১, ১৪২০
(উপ-সম্পাদকীয়)
এইচএসসির ফল ও শিক্ষার মান
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট, ২০১৩
২০১৩ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়েছে ৩ আগস্ট। এবারের পরীক্ষাটি নানা দিক থেকে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এর একটি কারণ, পরীক্ষা আরম্ভ হতে না হতেই রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে হরতালের কবলে পড়েছিল অনেকবার। হরতালের কারণে অনেক পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরীক্ষার্থীরা চরম বিপদসংকুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এবং সীমাহীন দুশ্চিন্তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। পরীক্ষা চলাকালে উপর্যুপরি হরতালের ফলে পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, পরীক্ষার্থীদের পক্ষে পরীক্ষার পরিবর্তিত সময়সূচির হিসাব রাখা ছিল অনেক কঠিন ব্যাপার। বলতে দ্বিধা নেই, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা কোনো উন্নত দেশে কল্পনাও করা যায় না। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এমন ঘটনা ঘটতে শোনা যায় না। পরীক্ষার্থীরা সব পরীক্ষা নির্বিঘ্নে দিতে পারবে কিনা এমন দুশ্চিন্তা যদি সব সময় তাদের মাথায় থাকে তাহলে তারা পরীক্ষায় ভালো ফল করবে কিভাবে?
উন্নত দেশে শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্র। পরীক্ষার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে পারে সে ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা যায়। এখানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নিরাপদ রাখা এবং নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপারে যেন কিছুই করা যাচ্ছে না। এবারের এইচএসসি পরীক্ষা দেখে স্পষ্টতই বলা যায়, আমাদের কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিমুক্ত থেকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগই করে দেয়া যায়নি। বরং দেখা গেছে, শিক্ষা বোর্ডগুলো হরতালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছে বারবার। অবশ্য পরীক্ষা পিছিয়ে না দিয়ে বোর্ডগুলোর পক্ষে বিকল্প কিছু করাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু বারবার পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়ার ফলে পরীক্ষার্থীরা যে মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে সেটা কি কারও ভেবে দেখার প্রয়োজন নেই? আমরা চাই, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির অবসান হোক চিরতরে।
পরীক্ষার ফল পেতে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের আরও এক দফা উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয়েছে। আমরা স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিলাম, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে খুব দ্রুত ফলাফল হাতে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পরীক্ষার ফল পেতে অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। বেলা ১১টার আগেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফল তুলে দেয়া হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে বেলা ২টার আগে সেটা প্রকাশ করা হয়নি। মোবাইল কোম্পানিগুলো মেসেজ অপশনের মাধ্যমে ফল পাওয়ার যে আশ্বাস দিয়েছিল সেটাও বেলা ২টার আগে পাওয়া যায়নি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফল তুলে দিয়ে তারও কয়েক ঘণ্টা পর ফল প্রকাশের যে রীতি চালু করা হয়েছে সেটা কি সংশ্লিষ্টদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলছে না? আমরা মনে করি, যে মুহূর্তে সব বোর্ডের পক্ষ থেকে ফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হবে ঠিক সেই মুহূর্তেই সেটা যাতে ইন্টারনেটসহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ ফল যদি প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছে যায় তখন সেটা আর দীর্ঘ সময় আটকে রাখার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বরং এটা খুব ভালো হতো যদি প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফল তুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হতো। অথবা এমনটিও হতে পারত, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বোর্ডের ওয়েবসাইটে ফল উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমরা আশা করতেই পারি, প্রধানমন্ত্রী কম্পিউটারের একটি বোতামে চাপ দেবেন আর সঙ্গে সঙ্গে ফল ছড়িয়ে পড়বে ইন্টারনেটে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, পরীক্ষার ফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়ার পর গণমাধ্যমে ফলাফলের একটা সামগ্রিক চিত্র প্রকাশিত হলেও পরীক্ষার্থীরা নিজের ফল জানতে পারে না। এটা কি পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে নির্মম রসিকতা নয়? আবার এমনটিও দেখা গেছে, ফল প্রকাশের চূড়ান্ত সময়সীমা বেলা ২টায় নির্ধারণ করা হলেও অনেকেই ভিন্ন উপায়ে অনেক আগেই ফল সংগ্রহ করে ফেলে। আর যারা ফল সংগ্রহ করতে না পারে তারা প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক চাপে ভোগে। এক্ষেত্রে যেটা ঘটে তার একটি হল, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশ উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফলাফলের গেজেট খুলে ফেলে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়ম কঠোরভাবে পালন করতে গিয়ে বেলা ২টার আগে গেজেট খোলে না। কেউ কেউ শিক্ষা বোর্ড থেকে গোপনে অনেক আগেই ফল জেনে যায় বলেও কথা রটে। ফলে সর্বত্র সৃষ্টি হয় এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতির। আমরা মনে করি, এ ধরনের পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরি। আমরা চাই, যে মুহূর্তে ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হবে ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন তা ইন্টারনেটে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়।
এবার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। দেশে বহু সরকারি কলেজ থাকার পরও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে সেরা বিশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে বেসরকারি কলেজগুলো। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো মানের পড়ালেখা হয়। এ বছর দেখা যায়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড প্রকাশিত সেরা বিশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ঢাকা কলেজ রয়েছে দশম স্থানে। এর ওপরের দিকে স্থান করে নেয়া সবই (ক্যাডেট কলেজগুলো বাদ দিয়ে) বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এমনকি সেরা বিশের মধ্যেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি। প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, সরকার বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেও কেন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফল ভালো করতে পারেনি? আসলে অধিকাংশ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ভালোভাবে পড়ালেখা হয় না তার একটি বড় প্রমাণ হল এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফল। প্রশ্ন ওঠে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুষে দেশের জনগণের কী লাভ?
প্রতিবারই এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠান পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেনি সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলে এমপিও স্থগিত করার কথাও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেলায় কী ব্যবস্থা নেয়া যায় সে ব্যাপারে কোনো কিছ্ই স্পষ্ট করে বলা হয় না। রাজধানীর বুকে অনেক সরকারি কলেজ থাকার পরও কেন সেগুলো সেরা বিশের মধ্যে স্থান করে নিতে পারেনি তার কারণ অনুসন্ধান করা কি এখন জরুরি নয়? আমরা মনে করি, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলেও যদি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারে তবে সেগুলোর বিরুদ্ধেও সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের স্বার্থেই এসব বিষয় ভেবে দেখতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment