বুধবার,
২১ আগস্ট, ২০১৩
(উপসম্পাদকীয়)
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দি
নাফিসের চিঠি থেকে
মো.
মুজিবুর রহমান | তারিখ: ২১-০৮-২০১৩
বাংলাদেশের ২২
বছর বয়সী তরুণ কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিন
ফেডারেল আদালত ৩০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ৯ আগস্ট। নাফিসের বিরুদ্ধে
অভিযোগ, তিনি বোমা মেরে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ভবন উড়িয়ে দিতে
চেয়েছিলেন। ওই ভবন উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার অভিযোগে তাকে ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর
গ্রেফতার করা হয় নিউইয়র্কে। শিক্ষার্থী ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর গোয়েন্দাদের
পাতা ফাঁদে ধরা পড়েন নাফিস। বিস্ফোরক (প্রকৃতপক্ষে বিস্ফোরকগুলো ছিল নকল। এগুলো
আমেরিকার এফবিআইয়ের ছদ্মবেশী এজেন্টরা ফাঁদের অংশ হিসেবে নাফিসকে সরবরাহ করেছিল)
দিয়ে ওই ভবন উড়িয়ে দেয়ার চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ
প্রায় ১০ মাস বিচার প্রক্রিয়া চলার পর তাকে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত কারাদণ্ডের আদেশ
দিয়েছেন। এখন নাফিস আইনি প্রক্রিয়ায় দণ্ড মওকুফ কিংবা হ্রাস করাতে পারবেন কিনা,
সেটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে রইল।
এখানে
আমরা নাফিসের লেখা চিঠির কিছু অংশ নিয়ে আলোচনা করব। আদালতের রায় ঘোষণার আগে গত ৩১
জুলাই নাফিস ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্কের চিফ ডিস্ট্রিক্ট জজ ক্যারল বাগলি
অ্যামনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি চিঠি লেখেন; যদিও নাফিসের চিঠিটি আমলে
নেননি আদালত। এ চিঠিতে তিনি না বুঝে কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে
জড়িয়ে ফেলেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। চিঠির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,
আমার সত্যিকারের কোনো বন্ধু ছিল না। মা-বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না। নিঃসঙ্গভাবে
বেড়ে উঠি আমি। একটা কিছু হতে আমি জীবনভর চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই
হতে পারিনি। এটি আমার নিজের ও আমার পরিবারের জন্য পুরোপুরি হতাশার। বাবা-মায়ের
কাছে আমি লোকসানি প্রকল্প বৈ কিছু ছিলাম না। আমার জন্য তাদের সব চেষ্টা বিফলে
গেছে। কোনো সাফল্য না পাওয়ায় আমার জীবনটা পুরোপুরি বরবাদ হয়ে গিয়েছিল।
এ
চিঠির বক্তব্যের অংশবিশেষ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ছোটবেলা থেকে একাকিত্ব
নাফিসকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছিল। তিনি কোনো ভালো বন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ
পাননি। তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও কেটেছে অনেকটা বন্ধুহীনভাবে। নিঃসঙ্গভাবে বেড়ে
ওঠার কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কার্যত একাকিত্ব নাফিসকে সঠিক
পথ দেখাতে পারেনি। তার ব্যক্তিত্বের বিকাশও সঠিকভাবে হয়নি। অন্যদিকে নাফিস নিজেই
স্বীকার করেছেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তার কিছু উগ্রপন্থী বন্ধু তাকে
বিপথগামী হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সুতরাং স্পষ্ট যে, তরুণ-তরুণীদের নিঃসঙ্গ জীবন
তাদের চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত করে তুলে। একসময় তাদের করে তুলে বিপথগামী। তবে এটা যে
শুধু তরুণ-তরুণীদের বেলায়ই সত্য তা নয়, বরং এটা সব বয়সী মানুষের ক্ষেত্রেও
সমানভাবে সত্য বলে আমার ধারণা। যেকোনো বয়সের মানুষ যদি দীর্ঘদিন ধরে একাকিত্বে
ভোগে, তাহলে এই নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব জীবনকে বিষাদগ্রস্ত করে তুলে এবং একসময়
হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। কাজেই মানুষের জীবনে ভালো বন্ধুর
সংস্পর্শে আসা যেমন প্রয়োজন রয়েছে, ঠিক তেমনি বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বনও জরুরি।
সব পিতা-মাতার উচিত সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তবে অতি আদরে
সন্তান যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, সে দিকেও প্রখরভাবে খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মাকেই।
সন্তানের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি সেগুলো শোধরানোর জন্য তাকে সঠিক পরামর্শ
দিতে হবে।
বয়ঃসন্ধিকালের
শিশু-কিশোররা বয়সগত কারণেই সহজে বিপথগামী হয়ে পড়তে পারে। এ সময়টায় সন্তানের খুব
কাছাকাছি থাকা বাবা-মায়ের জন্য জরুরি। কারণ বয়ঃসন্ধিকালে অনেক ধরনের শারীরিক
পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য তাদের সঠিক পরামর্শ
দেয়া দরকার। বাস্তবে দেখা যায়, কোনো কোনো অভিভাবক সন্তানের শারীরিক ও মানসিক
পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যাকে উপেক্ষা করেন। আবার অনেক অভিভাবক জানেনই না যে,
বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের শারীরিক পরিবর্তনের ফলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এ সুযোগে ওই বয়সীরা নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা
করে। আর বন্ধুরাও না জেনে-বুঝে খারাপ বা ভুল পরামর্শ দিয়ে থাকে। এভাবে একসময়
কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্য ভুল পথে পা
বাড়ায়। কখনো কখনো বয়সের কারণে তাদের মাঝে রোমাঞ্চের সৃষ্টি হয়। ফলে তারা বিভিন্নভাবে
নিজেদের ‘হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এ কারণেও তাদের বিপথগামী হওয়ার
সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আমাদের জন্য আক্ষেপের বিষয়, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিরসনের জন্য পরামর্শ দেয়া কিংবা
সেগুলো সমাধানে তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলার কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি তাদের জন্য
সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিংয়েরও সুযোগ নেই। শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ
আচরণ করতে চান না। ফলে তারা না পরিবার, না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোথাও কোনো সুপরামর্শ
পায় না। এ কারণে তাদের সমস্যাগুলো সমস্যা হিসেবেই থেকে যায়।
বর্তমান
প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের জীবনাচার পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তাদের অনেকেই আধুনিক
প্রযুক্তির প্রতি অত্যধিক আসক্তির কারণে নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ
ধরনের তরুণ-তরুণী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং আড্ডা দেয়ার পরিবর্তে
মেতে থাকে সেলফোন ও কম্পিউটার নিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা রাত জেগে কম্পিউটারে
গেম খেলে কিংবা সেলফোনে বন্ধুদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় আলাপচারিতায় মগ্ন থাকে।
বাংলাদেশের সেলফোন কোম্পানিগুলোও গভীর রাতে কম খরচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার
সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য কী ক্ষতি করছে, সেটা বিশ্লেষণ
করে দেখতে হবে। যেসব তরুণ-তরুণী অবারিতভাবে কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও সেলফোন ব্যবহার
করার সুযোগ পায়, তাদের কাছে পিতা-মাতার চেয়ে ইলেকট্রনিকসামগ্রী বেশি গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠে। পরিবারের সদস্যরাও কর্মব্যস্ততার কারণে কেউ কাউকে সময় দিতে পারেন না।
বাবা-মাও নানা কারণে নিজের সন্তানের সঙ্গে বেশি সময় অতিবাহিত করতে পারেন না। আবার
অনেক বাবা-মা ইচ্ছা করেই সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করেন। তখন সন্তানও আর তাদের
কথাবার্তা শুনতে চায় না। বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় একসময় ধীরে ধীরে
সন্তানদের বিপথগামী হওয়র সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো তরুণ-তরুণী একাকিত্বের কারণে
প্রাথমিক অবস্থায় ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং একসময় মাদকদ্রব্য সেবন আরম্ভ করে। আর
মাদক ব্যবসায়ীরা এ ধরনের মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারা নানা ধরনের প্রলোভনের
ফাঁদ তৈরি করে তরুণ-তরুণীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। এরা বয়সের কারণে কোনো
বাছ-বিচার না করেই মাদক ব্যবসায়ীর পাতা ফাঁদে পা দেয়। আবার কোনো সন্তান যদি
পারিবারিকভাবে অশান্তিতে ভোগে এবং নিজের পরিবারকে আপন বলে ভাবতে না পারে, তাহলে সে
বহির্মুখী হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তারা বাইরে বন্ধুর খোঁজ পাওয়ার জন্য উন্মাতাল হয়ে
পড়ে। একসময় ভালো হোক, মন্দ হোক কোনো না কোনো বন্ধু জুটিয়ে নেয়। যদি বন্ধুটি ভালো
হয় তাহলে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্তু বন্ধুটি খারাপ স্বভাবের হলেই সৃষ্টি হয়
যত সমস্যা।
এ
ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পরিবারের প্রধান হিসেবে বাবা-মাকে দিনশেষে যতই
কর্মক্লান্তি থাকুক না কেন, সন্তানকে কিছুটা হলেও সময় দেয়া দরকার। অন্তত রাতের
বেলায় হলেও তাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো এবং চুটিয়ে আড্ডা দেয়া উচিত। সারা দিন ঘটে
যাওয়া বিভিন্ন মজার বিষয় তাদের সঙ্গে শেয়ার করা যেতে পারে। স্কুল, কলেজ কিংবা
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানদের কাছ থেকেও শোনার চেষ্টা করা যায় তাদের ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতার কথা। তাদের উত্সাহ দেয়া যেতে পারে, সারাটা দিন কীভাবে কেটেছে, তারা কী
কী করেছে, সেগুলো অসংকোচে বলার জন্য। তাহলে কথার ফাঁকে ফাঁকে একসময় বোঝা যাবে
সন্তান কার কার সঙ্গে মিশছে কিংবা কীভাবে সময় কাটাচ্ছে। অভিভাবকরা যদি খুব কাছে
থেকে সন্তানের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে নিজেরাই বুঝতে পারবেন তাদের
গতি-প্রকৃতি। সন্তানরা বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার কার
সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে এসবের খোঁজখবর রাখা দরকার নিয়মিত। বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে
হবে, তারা যে ঘরে ঘুমায় সেখানে যেন দীর্ঘক্ষণ দরজা বন্ধ করে একা একা সময় না কাটায়।
মোট কথা, খুব সন্তর্পণে সন্তানের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তবে তাদের সন্দেহ
করা ঠিক হবে না। এসব করা হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আর কারো সন্তান নাফিসের মতো
বিপজ্জনক পথে পা বাড়ানোর সুযোগ পাবে না।
লেখক:
সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment