Monday, February 11, 2013

বাড়িভাড়া আইনের প্রয়োগ করবে কে?



ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৩, সোমবার : মাঘ ২৯, ১৪১৯
বাড়িভাড়া আইনের প্রয়োগ করবে কে?

মোঃ মু জি বু মা
বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়ির মালিকরা যেভাবে নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়িভাড়া বাড়িয়ে চলেছেন, তাতে মনে হয় না দেশে বাড়িভাড়া সম্পর্কিত কোন আইন-কানুন রয়েছে কারণ এখন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, বাড়িভাড়া খাতে চরম অরাজক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে একদিকে অধিকাংশ বাড়ির মালিক প্রতিবছর আইনবহির্ভূতভাবে বাড়িভাড়া বাড়ানোর মাধ্যমে প্রচণ্ড আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে ভাড়াটিয়াদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলছেন, অন্যদিকে বিনা রসিদে উচ্চহারে বাড়িভাড়া আদায় করলেও তারা কর ফাঁকি দিয়ে আসছেন বছরের পর বছর বাড়ির মালিকদের কর ফাঁকি রোধে সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ নিতেও দেখা যায় না দেখা যায় না, বাড়িভাড়া আইন প্রয়োগের কোন উদ্যোগও ফলে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খোদ ঢাকা থেকে আরম্ভ করে সারাদেশে অবস্থিত ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়ির ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে গত কয়েক মাসে দেশের পত্রপত্রিকায় বহু সংবাদ-প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়-উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির তেমন কোন দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি একবার শোনা গিয়েছিল, বাড়ির মালিকরা কী পরিমাণ কর ফাঁকি দিচ্ছেন তা খুঁজে দেখবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ওই উদ্দেশ্যে শহরাঞ্চলে অবস্থিত বহুতল বাড়ির মালিকদের তালিকা তৈরির কথাও শোনা গিয়েছিল কিন্তু সে উদ্যোগে ভাটা পড়ল কিনা সেটিও এখন বোঝা যাচ্ছে না
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় গত কয়েক মাসে বাড়িভাড়া নিয়ে দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম এখানে ল্লে করা হল ডিসেম্বর, ২০১২ দৈনিক সমকাল শিরোনাম করেছে, লাল নোটিশে দিশেহারা চট্টগ্রামের ভাড়াটিয়ারা দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনের একটির শিরোনাম ছিল, দুর্বল আইনে সবল বাড়িওয়ালা এবং অন্যটির শিরোনাম ছিল, ভাড়াটিয়াদের জন্য নববর্ষের শুভেচ্ছা বাড়িভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ (কালের কণ্ঠ, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১২) দৈনিক যায়যায়দিনের শিরোনাম, বাড়িভাড়া পাগলা ঘোড়া (২২ ডিসেম্বর, ২০১২) যায়যায়দিনের সম্পাদকীয় শিরোনাম, ঊর্ধ্বমুখী বাড়িভাড়া : লাগাম টেনে ধরার প্রশাসন কই? (২৩ ডিসেম্বর, ২০১২) গত বছর ১৯ জুন শুধু প্রথম আলো পত্রিকায় বাড়িভাড়া নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ওই প্রতিবেদনগুলোর শিরোনাম ছিল, বাড়িভাড়া বাড়ছেই, চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ, প্রশ্নবিদ্ধ বাড়িভাড়া আইন, বেতনের সঙ্গে সঙ্গতি নেই বাড়িভাড়ার, ভাড়া বেড়েছে সব এলাকায় এখানে মাত্র কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত অল্পসংখ্যক সংবাদ-প্রতিবেদনের শিরোনাম উল্লেখ করা হল এর বাইরে অন্যান্য দৈনিকে আরও বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক যুগান্তরেও নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এত সব প্রতিবেদন নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পরও দৃশ্যত কর্তৃপক্ষ কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় বাড়ির মালিকরা ধরে নিয়েছেন পত্রিকা সংবাদ ছাপলে কিছু হয় না এটি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় বাড়ির মালিকদের বেপরোয়াভাবে উপর্যুপরি ভাড়া বাড়ানোর মধ্য দিয়ে আমরা কিছুতেই বুঝতে পারি না, কিভাবে বাড়ির মালিকরা প্রচলিত আইন-কানুনের কোন তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে বাড়ির ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারেন ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নীরবতাকে আইনের দুর্বলতা বলে মনে করেন অনেকেই অথচ একটি সভ্য দেশে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না
বাড়ির মালিকদের অব্যাহতভাবে ভাড়া বৃদ্ধির কারণে ভাড়াটিয়ারা একরকম দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন এবং ভাড়া দিয়ে বাড়িতে থাকলেও কখন যে বাড়িওয়ালা বাড়ি ছাড়ার নোটিশ জারি করেন সেই আতংকে দিন কাটছে বহু ভাড়াটিয়ার অধিকাংশ বাড়ির মালিক এতটাই প্রভাবশালী যে তাদের কোন আইন-কানুন স্পর্শ করতে পারে না সহজে তাদের বেপরোয়া মনোভাবের কাছে ভাড়াটিয়ারা রীতিমতো অসহায় বোধ করেন ভাড়াটিয়াদের অধিকার দেখার মতো কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না অথচ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে এখন পর্যাপ্ত আইন রয়েছে হতে পারে প্রচলিত আইনটি বিশ বছর আগের এবং এটি যুগোপযোগী নয় কিন্তু সেটিও মেনে চলা হয় না আবার শুধু আইন থাকলেই হয় না, দরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রশ্ন থেকে যায়, আইনের প্রয়োগ করবে কে? বাড়ির মালিকরা বুঝে গেছেন, দেশে যতই আইন থাকুক না কেন, পত্রপত্রিকায় যতই লেখালেখি করা হোক না কেন, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন মহলে যতই আলোচনা-সমালোচনা হোক না কেন তাতে বাড়িভাড়া বাড়াতে কোন অসুবিধা নেই কারণ ফি বছর বাড়িওয়ালারা তাদের ইচ্ছামতো বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিলেও বাড়িভাড়াসম্পর্কিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের কোন নজির দেখা যায় না ফলে প্রায় সব বাড়িওয়ালাই সামান্য অজুহাতে একচেটিয়াভাবে বাড়ির ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন নিয়মিত অবস্থা দেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করছে, বাড়িয়ে তুলছে সামাজিক সমস্যা বাড়িভাড়ার লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে যেসব ভাড়াটিয়া মাসে মাসে বাড়তি ভাড়া গুনতে বাধ্য হন তাদের অনেকেই একসময় সৎপথে থেকে নির্দিষ্ট আয় দিয়ে সংসারজীবন পরিচালনা করা নিয়ে চরম হতাশায় ভোগেন তাদের সামনে জীবনজীবিকা নির্বাহের সহজ কোন উপায় থাকে না ধরনের পরিস্থিতি কারও জন্যই ভালো নয়
বাড়িভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে এমনকি বিদ্যমান আইনটি আরও যুগোপযোগী করা দরকার কারণ অধিকাংশ বাড়িওয়ালা দোর্দণ্ড প্রতাপে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন নির্বিচারে বাড়িওয়ালারা ভালো করেই জানেন, ভাড়াটিয়াদের বাড়িভাড়া না নিয়ে কোন উপায় নেই কারণ শহরে থেকে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে হলে, কর্মস্থলের আশপাশে থাকতে হলে, সরকারি হাসপাতালের কাছে থেকে চিকিৎসার সুবিধা ভোগ করতে হলে, কাছাকাছি থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে হলে বেশি ভাড়া দিয়ে হলেও বাড়িভাড়া নিতেই হবে অনেক বাড়ির মালিক ঠিক সুযোগটিই গ্রহণ করেন নির্দ্বিধায় কোন কোন বাড়ির মালিক তো প্রকাশ্যেই বলে ফেলেন, বাড়িভাড়া দেয়া একটা ব্যবসা কাজেই সুযোগ থাকলে বেশি ভাড়া আদায় করা যাবে না কেন! শুধু টাকার জন্য দেশ থেকে নীতিনৈতিকতাবোধ কি একেবারে ওঠে যাচ্ছে? ব্যবসা করলেও তো নৈতিকতাবোধ থাকা জরুরি খুব কম বাড়িওয়ালাই আছেন যারা বাড়িভাড়া সম্পর্কিত বিদ্যমান আইন মেনে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর বাড়িভাড়া বাড়িয়ে থাকেন এবং এমন বাড়িওয়ালার সংখ্যাও খুব কম যারা বাড়ির প্রয়োজনে এবং ভাড়াটিয়ার চাহিদা মোতাবেক নিয়মিত বাড়ির সংস্কার রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে দেন আশ্চর্যের ব্যাপার, বহু বাড়ির মালিক বাড়িতে সাধারণ রঙ করার দরকার পড়লেও সুযোগ বুঝে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে কয়েক মাসের ভাড়ার টাকা অগ্রিম হিসেবে আদায় করতে দ্বিধা করেন না নিয়ে প্রতিবাদ করলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ অনেক সময় তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলা হয়, ভালো লাগলে থাকুন, না হয় বাড়ি ছেড়ে দিন এভাবেই বাড়ির মালিকদের সঙ্গে ভাড়াটিয়াদের প্রায়ই অহেতুক বাকবিতণ্ডা, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব অপ্রীতিকর সম্পর্কের সৃষ্টি হয় পরিস্থিতির অবসান করতে হলেও দরকার বাড়িভাড়া আইনের যথাযথ প্রয়োগ
অন্যদিকে বহু ভাড়াটিয়া সম্পর্কেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে অনেক বাড়ির মালিক বেশ সহজ সাদাসিধেভাবে বসবাস করতে চাইলেও অনেক সময় ভাড়াটিয়াদের নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না যাচ্ছে তাইভাবে বাড়ির ব্যবহার করা, অসতর্কভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়ির ফিটিংস নষ্ট করা, অধিকাংশ সময় অতিরিক্ত লোক নিয়ে বসবাস করা, যখন-তখন বাড়ির প্রধান গেট খোলা রেখে বাইরে চলে যাওয়া, বিনা প্রয়োজনেও অভ্যাসবশত গভীর রাতে বাড়িতে ফেরা, বসবাসের কথা বলে বাড়িভাড়া নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা আরম্ভ করা, কখনও কখনও বাড়িতে কোচিং সেন্টার গড়ে তোলা ইত্যাদি অভিযোগও অনেক ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে পাওয়া যায় এছাড়া এমন অনেক ভাড়াটিয়া রয়েছেন যারা বাড়িভাড়া নেয়ার পর চুক্তি লংঘন করেন যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের মধ্যে লিখিত কোন চুক্তিপত্র সম্পাদন করা হয় না তবুও বাড়িভাড়া নিয়ে উভয়ের মধ্যে অলিখিত মৌখিকভাবে যেসব শর্ত চূড়ান্ত করা হয় সেগুলোও অনেক ভাড়াটিয়া ভঙ্গ করেন বলে বহু বাড়িওয়ালা প্রায়ই অভিযোগ করেন এসব কারণে অনেক বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়া উঠিয়ে দিতে বাধ্য হন ফলে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে বাড়ির মালিকদের সৃষ্টি হয় অসহনশীল সম্পর্ক সম্পর্কের প্রভাব পড়ে পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির আইনানুগ অবসান ঘটানো জরুরি
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment