(বাতায়ন)
সহিংসতা শিশুর মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে
সহিংসতা শিশুর মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে
মোঃ মু জি বু র র হ মা ন
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে যদি সব সময় আতংক ও অস্থিরতা বিরাজ করে তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপর। যে কোন অস্থিতিশীল পরিবেশ শিশুর জন্য চরম মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুরা স্বভাবগতভাবে সহজ-সরল এবং সাধারণভাবে বিশ্বাসপ্রবণ বলেই তারা চোখের সামনে যা কিছু দেখে, যা কিছু শোনে তাই সত্য বলে ধরে নেয়। এ কারণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রভাব থেকে তারা কিছুতেই মুক্ত থাকতে পারে না। কোন ঘটনার সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ যাচাই করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে তারা যা দেখে তার প্রতিবিম্ব মনের মধ্যে গেঁথে নেয় অবচেতনভাবে। শিশুরা যদি ভালো কোন দৃশ্য বা আনন্দজনক ঘটনা ঘটতে দেখে, তাহলে সেটি যেমন তাদের মনের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে, তেমনি তারা যদি কোন খারাপ দৃশ্য বা দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেখে তাহলে এর মাধ্যমেও প্রভাবান্বিত হয়। বড়দের অসহনশীল আচরণ এবং সেখান থেকে সৃষ্ট নেতিবাচক ঘটনা শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর ফলে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বহু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা শিশুর মনের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করে তা আমরা শনাক্ত করতে পারি না সহজে, এমনকি শনাক্ত করার চেষ্টাও করি না। এসব নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোন কার্যকর গবেষণাও হয় না বললেই চলে। কী পরিবার, কী স্কুল কোথাও শিশুদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে শিশুরা একরকম অবহেলা ও অনাদরের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। এভাবে বড় হওয়ার কারণে তারা শিশুকাল থেকেই অন্যের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে যদি সব সময় আতংক ও অস্থিরতা বিরাজ করে তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপর। যে কোন অস্থিতিশীল পরিবেশ শিশুর জন্য চরম মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুরা স্বভাবগতভাবে সহজ-সরল এবং সাধারণভাবে বিশ্বাসপ্রবণ বলেই তারা চোখের সামনে যা কিছু দেখে, যা কিছু শোনে তাই সত্য বলে ধরে নেয়। এ কারণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রভাব থেকে তারা কিছুতেই মুক্ত থাকতে পারে না। কোন ঘটনার সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ যাচাই করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে তারা যা দেখে তার প্রতিবিম্ব মনের মধ্যে গেঁথে নেয় অবচেতনভাবে। শিশুরা যদি ভালো কোন দৃশ্য বা আনন্দজনক ঘটনা ঘটতে দেখে, তাহলে সেটি যেমন তাদের মনের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে, তেমনি তারা যদি কোন খারাপ দৃশ্য বা দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেখে তাহলে এর মাধ্যমেও প্রভাবান্বিত হয়। বড়দের অসহনশীল আচরণ এবং সেখান থেকে সৃষ্ট নেতিবাচক ঘটনা শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর ফলে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বহু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা শিশুর মনের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করে তা আমরা শনাক্ত করতে পারি না সহজে, এমনকি শনাক্ত করার চেষ্টাও করি না। এসব নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোন কার্যকর গবেষণাও হয় না বললেই চলে। কী পরিবার, কী স্কুল কোথাও শিশুদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে শিশুরা একরকম অবহেলা ও অনাদরের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। এভাবে বড় হওয়ার কারণে তারা শিশুকাল থেকেই অন্যের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
যেসব শিশু সব সময় বড়দের রুক্ষ আচরণ
দেখছে, দেখছে হিংস্রতা, উন্মত্ততা আর বাড়াবাড়ি, তারা একদিন বড়
হয়ে নিজেরা ঠিক একই ধরনের অসহনশীল আচরণ করবে- এটি স্পষ্টই বোঝা যায়। এ সত্যকে
উপেক্ষা করলে আমাদের দিতে হবে চরম মূল্য। বাস্তবে আমরা দিচ্ছিও তা-ই। এখন দেখা যায়
পথে-ঘাটে, হাট-বাজারে, স্কুল-কলেজে অনেকে প্রায়ই অসহিষ্ণু আচরণ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
তো খোদ শিক্ষকরাই লিপ্ত হয়ে পড়েন হাতাহাতিতে। তরুণ জনগোষ্ঠীও এ ধরনের আচরণের বাইরে
থাকে না। তাদের অনেকেই আমাদের চোখের সামনে খুব সহজেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, বিনা কারণে
একজন আরেকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে, তুচ্ছ কারণে হয়ে উঠছে মারমুখী, কখনও সংঘবদ্ধভাবে
পরস্পর আক্রমণে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। কোথাও কোন সামান্য অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও কেউ কেউ সেলফোনের
মাধ্যমে দ্রুত বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে এনে প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখায়, ত্রাস সৃষ্টি করে,
এমনকি কখনও কখনও মারধরও করে। এসব কি সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের লক্ষণ নয়? প্রশ্ন থেকে
যায়, এভাবে কি আমরা সহনশীল ও উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারব? আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা
কি ভেবে দেখবেন, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কী?
মাঝেমধ্যে দেখা যায়, দেশে নানা কারণে
সৃষ্ট সংঘাত ও সংঘর্ষের কবলে পড়ে সাধারণ নাগরিকের প্রাণহানি ঘটে। বিবদমান পক্ষগুলোর
প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কখনও কখনও আহত হয় অনেক মানুষ। অনেক সময় জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও
উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে অনেকেই। অসহনশীল আচরণের চরম প্রকাশ ঘটিয়ে
চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। ভাংচুর ও জ্বালাও-পোড়াও চলে নির্বিচারে। সহিংস ঘটনায় পড়ে সাধারণ
পথচারীদের প্রাণভয়ে আতংকিত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। নিরীহ
পথচারীরাও অনেক সময় নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়। রিকশা কিংবা অন্য কোন যানবাহনে চড়ে যাওয়া
সাধারণ মানুষকে বলপূর্বক নামিয়ে দেয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালগামী রোগীদেরও নিস্তার
থাকে না। সঙ্গে শিশু থাকলেও রেহাই পাওয়া যায় না। পরিস্থিতি এমন হয় যে ভয়ে বড়রাও আতংকগ্রস্ত
হয়ে পড়ে। শিশুরা আতংকিত হয় আরও বেশি।
এ ধরনের সংঘাতময় ঘটনা যে বাংলাদেশে
নতুন, তা কিন্তু নয়। বরং বহু বছর ধরেই একই ধরনের সহিংস পরিস্থিতি চলে আসছে। নানা কারণে
প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ভাংচুরের ঘটনা গণমাধ্যমে দেখার পর অনেক শিশু
মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। আমরা কি তার খবর রাখি? মারামারি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার কিছু ঘটনা
আছে, যা শুধু নাটক-সিনেমায় দেখানো সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবে নাটক-সিনেমার চেয়েও বেশি
দুর্ধর্ষ ও লোমহর্ষক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এসব ঘটনার ফলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ মানসিকভাবে
চরম যন্ত্রণায় নিপতিত হয়। অনেকের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করা সম্ভব হয় না। সব
সময় এক অনিশ্চয়তা ভর করে থাকে মনের মধ্যে। কেউ কেউ হতাশায় ভোগেন। জীবন-জীবিকা নিয়ে
আশাহত হন অনেকেই। এসব ঘটনা যখন সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় তখন স্বভাবতই
শিশুরাও মনোযোগী শ্রোতা হয়ে যায়। ফলে তারা ছোটবেলা থেকেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার
সঙ্গে পরিচিত হয়ে পড়ছে অনিচ্ছাকৃতভাবেই। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন সমাজ ও রাষ্ট্রে
ঘটে যাওয়া এসব দুঃখজনক ঘটনা থেকে শিশুদের দূরে রাখতে, কিন্তু কিছুতেই যেন তাদের দূরে
রাখতে পারছি না। পারছি না তাদের আতংকমুক্ত রাখতে। এটাই আমাদের উদ্বেগের মূল কারণ।
দেশে যে কোন কারণে যতই সংঘাত ও সংঘর্ষের
সৃষ্টি হোক না কেন, এর সব কিছুই যেন বড়দের গা সওয়া হয়ে গেছে আজকাল। যে কোন কর্মসূচিতে,
সভা-সমাবেশে, আলোচনা অনুষ্ঠানে হইচই হবে, হাতাহাতি হবে, হবে মারামারি, ঘটবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা-
এটি যেন এখন সাধারণ
ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন মনে হয়, আমাদের অনেকের মধ্যে সহিষ্ণুতার বড় অভাব দেখা দিয়েছে।
এসব অসহিষ্ণু আচরণ ও কার্যকলাপ বড়দের চিন্তা-চেতনায় যে ভূমিকাই রাখুক না কেন, কোমলমতি
শিশুদের বেলায় কী প্রভাব রাখে, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা দরকার।
আমাদের দুশ্চিন্তা শিশুদের মানসিক
স্বাস্থ্য নিয়ে। কারণ মানুষ হয়ে মানুষের ওপর উন্মত্তভাবে হামলে পড়ার দৃশ্য গণমাধ্যমে
দেখে শিশুরা মানসিকভাবে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়
প্রচারিত সংঘাত ও সংঘর্ষের ভয়াবহ চিত্র শিশুদের মনে দেশ ও সমাজ সম্পর্কে যে বিরূপ ধারণার
সৃষ্টি করছে, তা নিয়ে রাষ্ট্র কতটুকু চিন্তিত এমন প্রশ্নের সৃষ্টি হতেই পারে। বোঝা
যায়, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি শিশু বিকাশের অনুকূলে রাখা যাচ্ছে না। শিশুদের
নিরাপদভাবে গড়ে তোলার জন্য যে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার, তা যেন কঠিন হয়ে পড়ছে
দিন দিন। স্কুল-কলেজে যাতায়াত হয়ে উঠছে অনিরাপদ ও বিপদসংকুল। নানা অপ্রীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা
তাদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ব্যাপকভাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পরীক্ষা
পেছাতে হচ্ছে বারবার। ফলে পরিবার, সমাজ, স্কুল-কলেজ ও দেশ সম্পর্কে শিশুদের মনে শিশুকাল
থেকেই চরম আস্থাহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে বেড়ে ওঠা শিশুরা ভবিষ্যতে নিজেরা আক্রমণাত্মক
আচরণ করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার
সুযোগ করে দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ উদ্দেশ্যে সমাজের প্রত্যেক মানুষের থাকতে হবে
ইতিবাচক ভূমিকা। অস্বীকার করার উপায় নেই, নানা কারণে সৃষ্ট গোলযোগের ফলে সাধারণ মানুষের
মধ্যে যে ধরনের আতংক বিরাজ করে, তার চেয়েও বেশি আতংক বিরাজ করে শিশুদের মনে; তাদের
ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপও তৈরি করে। এসব ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের সমাজের ওপর
দীর্ঘমেয়াদে, এতে সন্দেহ নেই।
মোঃ মুজিবুর রহমান
: টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment