ঢাকা, শনিবার , অক্টোবর ১৩, ২০১২, আশ্বিন ২৭, ১৪১৯
(ঊপ-সম্পাদকীয়)
ব্যাংকব্যবস্থা
আস্থা
হারালে তা ফিরে পাওয়া কঠিন
মো.
মুজিবুর রহমান
ব্যাপক
অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাতের যে ঘটনা
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে উদ্ঘাটিত হয়েছে, তা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। একই
সঙ্গে হলমার্কের এমডির বিস্ময়কর উত্থান অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। শিশুকাল থেকে ‘আলাদীনের
চেরাগ’ নিয়ে যেসব গল্প শুনে এসেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের
হলমার্ক কেলেঙ্কারি সেসবের কাছে কিছুই না। কারণ হলমার্ক গ্রুপ অর্থ আত্মসাতের এ
রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটিয়েছে বাস্তবে; কোনো গল্প-উপন্যাস বা নাটকে নয়। যেভাবে হাজার
হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা
হয়েছে, তাকে আর্থিক জগতে কেলেঙ্কারি না বলে মহাকেলেঙ্কারি বলা যেতে পারে।
হলমার্ক
কেলেঙ্কারির প্রেক্ষাপটে ধারণা করা যায়, অর্থ আত্মসাতের ঘটনা যে শুধু সোনালী
ব্যাংকেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, তা নয়। বরং সোনালী ব্যাংকের পাশাপাশি আরও একাধিক
ব্যাংকেও অর্থ আত্মসাৎ
চলছে ভেতরে ভেতরে। এ ধরনের খবরও বের হচ্ছে পত্রপত্রিকায়। অনুমান করা যায়, এ ধরনের
আরও বড় বড় ঘটনা হয়তো পর্দার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। এমনকি যারা এবং যেসব প্রতিষ্ঠান
অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত, তারা ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়া এবং ভিন্ন খাতে প্রবাহিত
করার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে
হলমার্ক গ্রুপের এমডিকে গ্রেফতার করা হয়েছে গত রোববার। হলমার্কের আরও এক ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তাকেও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের ঘটনাও বেশ রোমাঞ্চকর।
সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ আশা করছে, অচিরেই এর সঙ্গে যুক্ত অন্যদেরও
গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। আমাদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, কীভাবে এত বিপুল অর্থ
আত্মসাতের পরও হলমার্ক বেশ দাপিয়ে তার কাজকর্ম পরিচালনা করে গেল? হলমার্ক গ্রুপের
আত্মসাৎ করা হাজার হাজার কোটি
টাকা উদ্ধার এবং স্মরণকালের অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের
মুখোমুখি করা সম্ভব হবে কি।
হলমার্ক
কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে সোনালী ব্যাংক এরই মধ্যে যথেষ্ট সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। এখন
সোনালী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের প্রতিও মানুষের আস্থা কমলে আশ্চর্যের কিছু
থাকবে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেলে দেশের আর্থিক
ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়বে বৈকি। ব্যাংক যদি আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে
ব্যর্থ হয়, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। এমনিতেই বিশ্বের অনেক
দেশেই আর্থিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। বিশ্বমন্দা নিয়ে উন্নত দেশগুলোও এখন
যথেষ্ট চাপের মুখে রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও আশানুরূপ শক্তিশালী নয়। এর
মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট হলে অর্থনীতিতে
বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এতে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা দেবে
অস্থিরতা। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে আর্থিক কার্যক্রম। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটবে
ব্যাপকভাবে। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিস্তার ঘটবে সর্বত্র। আমাদের বুঝতে হবে, এ
পরিস্থিতি কারও জন্যই স্বস্তিকর নয়।
দেশজুড়ে
এখন আলোচনা হচ্ছে শুধু হলমার্কের মহাকেলেঙ্কারি নিয়ে। এর বাইরে অনেক ব্যাংক যে
নানা কৌশলে আমানতকারীদের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে, সে বিষয়ে খুব একটা আলোচনা নেই।
প্রত্যেক ব্যাংকে ব্যাপক অনুসন্ধান চালালে হয়তো অর্থ আত্মসাতের আরও অনেক রহস্য
উদ্ঘাটিত হবে বলে ধারণা। সোনালী ব্যাংকে আমার একটি হিসাবে লেনদেন নিয়ে সৃষ্ট
অস্বস্তিকর পরিস্থিতি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি।
কোনো
এক জেলা শহরে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখায় আমার একটি সঞ্চয়ী হিসাব চালু
ছিল। এ হিসাবে প্রতি মাসে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া আমার বেতন-ভাতার চেক জমা হতো।
যেসব ব্যাংকে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে হিসাবের লেনদেনের রেকর্ড রাখা হয়, সেখানে
ম্যানুয়াল পাসবই চালু নেই। আগে যখন ম্যানুয়াল পাসবই চালু ছিল, তখন গ্রাহক প্রতিবার
তার অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উত্তোলনের সময় পাসবইটি হালনাগাদ করিয়ে নিতে পারতেন। তখন
প্রত্যেক গ্রাহক তার হিসাবে কত টাকা জমা আছে তা জানতে পারতেন। এখন হিসাববিবরণী
প্রতি বছর দুবার গ্রাহককে সরবরাহ করে থাকে ব্যাংক। ফলে গ্রাহকের টাকা লেনদেনের
বিবরণ ওই দুবার ছাড়া অন্য সময়ে দেখার সুযোগ সীমিত। এর বাইরে যদি কোনো গ্রাহক তার
হিসাবের স্থিতি জানতে চান, তাহলে তাকে স্বশরীরে ব্যাংকে উপস্থিত হতে হয়; দিতে হয় নির্দিষ্ট ফি। এ কারণে আমি আমার লেনদেনের
একটি পৃথক বিবরণ পাসবইয়ের আদলে নিজেই সংরক্ষণ করতাম। একবার হিসাবের স্থিতির
বিপরীতে একটি চেক ইস্যু করার পর পর্যাপ্ত টাকার অভাবে ব্যাংক চেকটি ডিজঅনার করে।
চেকটি ফেরত এলে আমি খানিকটা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। আমি আমার পুরো হিসাব মিলিয়ে নিশ্চিত
হই ইস্যুকৃত চেকের মাধ্যমে যে পরিমাণ টাকা উত্তোলন করতে চেয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি
টাকা জমা থাকার কথা। কিন্তু যেখানে ব্যাংক স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অর্থ লেনদেনের
হিসাব সংরক্ষণ করে, সেখানে আমার একটি ছোট্ট অ্যাকাউন্টে এ ধরনের ভুল হওয়া
অস্বাভাবিক মনে করলেও হাল ছেড়ে দিইনি। পর দিন নিজেই যাবতীয় প্রমাণপত্রসহ ব্যাংকে উপস্থিত
হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জানালাম, আমার এ হিসাবে যত টাকা স্থিতি দেখানো হচ্ছে,
বাস্তবে আরও ২০ হাজার টাকা বেশি থাকার কথা। আমার বক্তব্য শুনে ওই কর্মকর্তা বললেন,
অন্য কোনো হিসাবের টাকা আপনার হিসাবে ভুলক্রমে জমা হওয়ায় ব্যাংক আপনার হিসাব থেকে
২০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছে। এখন আপনার হিসাবে যত টাকা স্থিতি দেখানো হচ্ছে এটিই
প্রকৃত স্থিতি। বিষয়টি মেনে না নিয়ে আমি ক্যাশ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার
সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কম্পিউটারে আমার হিসাব বের করে টাকা লেনদেনের পুরো বিবরণ
দেখালেন। আমি হিসাববিবরণীর একটি প্রিন্ট কপি নিয়ে দেখলাম, আমার হিসাব থেকে
১০.০৭.২০১১ তারিখে ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে, ওই তারিখে ওই
পরিমাণ টাকার চেক ইস্যু করিনি। মজার ব্যাপার হলো, উত্তোলিত টাকার বিপরীতে কোনো চেক
নাম্বার লেখা নেই। এ টাকা কীভাবে উত্তোলন করা হলো তা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর
ওই কর্মকর্তা আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। তারও অনেক পর আমার হিসাবে পুনরায় ২০ হাজার
টাকা জমা দেখিয়ে আমাকে হিসাববিবরণীর আরেকটি প্রিন্ট কপি এনে তিনি বললেন, এ টাকাটি
ভুলক্রমে উত্তোলন করা হয়েছিল; এখন তা জমা দেয়া হয়েছে। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে
চলে এলাম। ভাবলাম, আমার মাসিক বেতন-ভাতার একটি হিসাব, যেখানে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট
পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়, সে হিসাব থেকে যদি ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয় ভুলক্রমে (?), তাহলে বড় বড় হিসাবে আরও বড় ধরনের
ভুল হচ্ছে না তো? যাদের পক্ষে নিয়মিত নিজের ব্যাংক হিসাব সংরক্ষণ করাও সম্ভব হয়
না, তাদের অবস্থা কী? আমার এ অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করি, নানা কৌশলে ব্যাংকের কিছু
অসাধু কর্মকর্তা আমানতকারীর হিসাব থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন; যা সাধারণ
আমানতকারীরা সহজে ধরতে পারেন না। ঘটনাটি কি ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা
হারিয়ে ফেলার মতো নয়? এভাবে কি ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দেবে না?
লেখক
: সহযোগী অধ্যাপক, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment