ঢাকা, বুধবার, সেপ্টেম্বর
২৬, ২০১২, আশ্বিন ১১, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
স্কুলের যেসব সমস্যা জানা দরকার
মো. মুজিবুর রহমান
আমাদের দেশের স্কুলগুলোয় ভেতরে ভেতরে যেসব অভাবনীয় ও
অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এবং যেসব বহুমুখী সমস্যা বিরাজ করছে, সেগুলো সাধারণ
মানুষ বিশেষত অভিভাবকদের জানা দরকার। তার চেয়ে বেশি জানা দরকার যারা এগুলো সমাধান
করতে পারেন— তাদের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এসব ঘটনা বা
সমস্যা কর্তৃপক্ষ তো দূরের কথা, খোদ অভিভাবকরাই জানতে পারেন না। এমনকি স্কুল কর্তৃপক্ষও এসব
সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন না।
স্কুলের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে আসল ঘটনা সবার কাছে স্পষ্ট
হবে বলে ধারণা। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বহু শিক্ষার্থী নিয়মিত স্কুলে আসে না। তাদের না আসার কারণ
হিসেবে প্রধানত শিক্ষার্থীরা স্কুলের বাইরে প্রাইভেট পড়ায় ব্যস্ত থাকার বিষয়টি
উল্লেখ করে। আবার কোচিং নিয়েও ব্যস্ত থাকে অনেকে। প্রাইভেট পড়ানো এবং কোচিং করানো
এ দুই জায়গায়ই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্য তৈরি করা হয় বিশেষভাবে। সেখানে চলে
পাঠের বিষয়বস্তু মুখস্থ করানোর তীব্র প্রতিযোগিতা। কোচিং সেন্টারের সাজেশননির্ভর
এবং প্রশ্নভিত্তিক পড়ালেখার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায়
ভালো ফল করবে সেদিকে। ফলে তারা স্কুলে না গিয়ে ভিড় করে কোচিং সেন্টারে। অভিভাবকরাও
চান সন্তানরা যেন ভালো ফল করতে পারে, সেভাবেই তাদের তৈরি করা হোক। এ কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক
উভয়কেই কোচিং সেন্টারের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখা যায়। তাদের কারোরই স্কুলের প্রতি
তেমন আগ্রহ থাকে না। অভিভাবকরাও স্কুলের চেয়ে প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং করানোকে বেশি
গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে মাঝে মধ্যে উপস্থিত হয়ে শুধু নিয়ম
রক্ষা করে। যেসব শিক্ষার্থী স্কুলে আসে, তাদের কিছু অংশ ছুটির আগেই স্কুল থেকে চলে যায়। এমনও দেখা
গেছে, টিফিন পিরিয়ডে শিক্ষার্থীরা দলে দলে ব্যাগ নিয়ে স্কুল থেকে
বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। তারা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন অনুভব
করে না। অনেক শিক্ষার্থীকে এভাবে স্কুল থেকে চলে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা
অসংকোচে জানায়, কোচিং সেন্টারে ক্লাস করতে যেতে হবে। প্রাইভেট পড়ার বিষয়টিও
উল্লেখ করতে দ্বিধা করেনি অনেকেই।
শিক্ষার্থীরা যে স্কুল থেকে শিক্ষকদের অনুমতি না নিয়ে চলে
যায়, এ পরিস্থিতি স্কুল কর্তৃপক্ষও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কেন
শিক্ষার্থীরা বিনা অনুমতিতে বাইরে চলে যাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে অনেক শিক্ষক বলেছেন, এখন আর আগের মতো
শিক্ষার্থীদের তারা শাসন করতে পারেন না। কারণ সরকারি পরিপত্রের মাধ্যমে
শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনেক আগেই। তাদের মতে, শিক্ষার্থীদের
এখন আর শাসন করার সুযোগ না থাকায় তারা শিক্ষকদের অনেক নির্দেশই মানতে চায় না। মাঝে
মধ্যে শিক্ষার্থীদের সামান্য শাসন করলে তারা অভিভাবকের কাছে শিক্ষকের বিরুদ্ধে
অভিযোগ করে। অভিভাবকরাও সন্তানের কথা শুনে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের
কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। ফলে অনেক সময় শিক্ষকরা হয়রানির শিকার হন। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত
পরিস্থিতির মুখোমুখি যাতে শিক্ষকদের হতে না হয়, সে জন্য শিক্ষার্থীদের শাসন করা দূরের কথা, তাদের কিছুই
বলেন না তারা। এটি স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা বলে মনে করেন অনেক
শিক্ষক। তাদের অভিমত, শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে মৃদুভাবে হলেও শাসনের
নিয়ম চালু রাখা উচিত। কিন্তু শিক্ষকরা নিজেদের ঝামেলামুক্ত রাখতে এখন কাউকেই শাসন
করার আগ্রহ দেখান না। ফলে শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে ওপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীরা অনেক সময় শিক্ষকদের
সঙ্গে বেপরোয়া আচরণ করে থাকে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে
শাস্তি না দিয়েও বিরাজমান পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে দিকটিই
গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী স্কুলে এলেও তাদের বেশির ভাগ
ক্লাসে উপস্থিত না থেকে ক্লাসের সময়ে বাইরে ঘোরাফেরা করে সময় কাটায়। শিক্ষকরা
তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে পারেন না। শহরের অনেক শিক্ষার্থী স্কুলের নাম করে বাসা
থেকে বের হয়ে এখানে-সেখানে বসে আড্ডা দেয়। পরে স্কুল ছুটির সময় হলে বাসায় বা বাড়িতে ফিরে
যায়। এভাবে অনেকেই জড়িয়ে পড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপে। কেউ কেউ সুযোগ বুঝে ঢুকে
পড়ে সাইবার ক্যাফেতে। এ ধরনের ঘটনা ওপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বেশি
ঘটতে দেখা যায়। বিশেষ করে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বয়ঃসন্ধিকালের
হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বলে বহু শিক্ষক মনে করেন। এ অবস্থায় তাদের
নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দরকার মনস্তাত্ত্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা মোকাবেলা করা।
অথচ আমাদের স্কুলগুলোয় মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। অনেক আগে একবার শোনা গিয়েছিল, প্রত্যেক স্কুলে
একজন করে মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের যথাযথ পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতে
পারেন। এখন আর এ বিষয়ে আলোচনা শোনা যায় না। বলতে গেলে মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগের
বিষয়টি এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। অথচ প্রত্যেক স্কুলে যদি মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া
হতো, তাহলে তিনি শিক্ষার্থীদের সমস্যা শুনে তাদের সঙ্গে
আন্তরিকভাবে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারতেন। উন্নত দেশের স্কুলগুলোয়
শিক্ষার্থীদের একান্ত সমস্যাগুলো জেনে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরামর্শ দেয়ার জন্য
শিশুমনোবিজ্ঞানে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে এ বিষয়ে গুরুত্বই দেয়া
হচ্ছে না বলে মনে হয়।
স্কুলে আরেকটি বড় সমস্যা, শিক্ষকদের সময়মতো শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ না করা। পর্যবেক্ষণে
দেখা যায়, শ্রেণীকক্ষে প্রবেশের সময় হলেও কিছু শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে না
গিয়ে অযথা গল্পগুজব করে সময় নষ্ট এবং ৫-৬ মিনিট পর ক্লাসে আসেন। এ অবস্থায় স্কুলে পাঠদানের জন্য
বরাদ্দকৃত সময়ের অপচয় হয়। এমনিতেই আমাদের দেশে স্কুলে পাঠদানের জন্য ৪০-৪৫ মিনিট সময়
বরাদ্দ থাকে। দিনের শেষ দিকের ক্লাসের জন্য সময় থাকে ৩০-৩৫ মিনিট। এত
অল্প সময়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে ভালোভাবে পাঠদান দুরূহ ব্যাপার।
উন্নত দেশে প্রতি অধিবেশনের জন্য সময় নির্ধারণ করা থাকে ৫০-৫৫ মিনিট। কোথাও
কোথাও থাকে ১ ঘণ্টা। সেসব দেশের স্কুলে পুরো সময় ব্যবহার করা হয় পাঠদানে। অথচ
আমাদের দেশে পাঠদানের জন্য যতটুকু সময় বরাদ্দ রয়েছে তাও যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়
না। এ দিকটিও অভিভাবকসহ কর্তৃপক্ষের জানা দরকার। প্রশ্ন হলো, স্কুলে শিক্ষকরা
নিয়মিত ক্লাসে প্রবেশ করেন না, তা অভিভাবকরা জানবেন কীভাবে? আর তারা জানলেই বা তাদের কী করার আছে? কারণ স্কুলগুলো
চিরাচরিতভাবেই অভিভাবকদের চরমভাবে উপেক্ষা করে থাকে। অধিকাংশ স্কুলই অভিভাবকদের
তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না। অথচ স্কুলের সমস্যা সমাধানে অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত
মতবিনিময় এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের
উচিত অভিভাবকদের নিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক মাসে একবার মতবিনিময় সভার আয়োজন
করা। অথচ অভিভাবক সমাবেশ না করায় স্কুলে দিন দিন সমস্যা বেড়েই চলেছে বলে মনে করা
হয়। স্কুলে অভিভাবকদের নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজনের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে
শিক্ষা কর্তৃপক্ষ নির্দেশ জারি করতে পারে। এ ব্যাপারে স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনও
নিতে পারে উদ্যোগ।
এখানে স্কুলের যেসব সমস্যা আলোচনা করা হলো, সেগুলো ছাড়াও
রয়েছে- ১. প্রতিষ্ঠান প্রধানের যথাসময়ে স্কুলে না আসা ২. নিয়মিত
পাঠক্রমিক ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি পরিচালনা না করা ৩. ঊর্ধ্বতন
কর্তৃপক্ষের স্কুল মনিটরিং না করা ৪. শিক্ষার মান উন্নয়নে স্কুল কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রদর্শন ৫. স্কুলের উন্নয়নে
স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনের উদাসীনতা ৬. উন্নত পদ্ধতিতে পাঠদানে অধিকাংশ শিক্ষকের অনীহা ৭. অভিভাবকদের
সঙ্গে মতবিনিময়ে স্কুলের অসহযোগিতা ও অনাগ্রহ ৮. অকার্যকর শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি ৯. যথাযথভাবে স্কুল পরিচালনায় ম্যানেজিং কমিটির (এসএমসি) অদক্ষতা এবং
এসএমসির সঙ্গে স্কুলের স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ১০. স্কুলের অর্থের অপব্যবহার, এক কথায় ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি প্রভৃতি।
আলোচ্য সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য স্কুলের যেমন দায়িত্ব
রয়েছে, তেমনি শিক্ষা কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও জরুরি। স্কুলের সমস্যা
সমাধানে অভিভাবকদেরও সহায়তা নেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া স্কুলের সমস্যা শনাক্ত করার
জন্য দরকার স্কুলপর্যায়ে নিয়মিত গবেষণার ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমেই স্কুলের
সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উপযুক্ত পথ খুঁজে বের করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে
দেখা যায়, আমাদের দেশে স্কুলশিক্ষা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা পরিচালিত হয়
না। ফলে সমস্যাগুলো থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। আর এগুলোই মানসম্মত শিক্ষার প্রধান
অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। অথচ স্কুলের সমস্যা শনাক্ত করে তা নিরসনের জন্য
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার- মানসম্মত স্কুলশিক্ষার স্বার্থেই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment