Tuesday, October 30, 2012

সহজে ব্যবসার সুযোগ বাড়াতে হবে আরও


 

ঢাকা, মঙ্গলবার, অক্টোবর ৩০, ২০১২, কার্তিক ১৫, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
ডুয়িং বিজনেস-২০১৩
সহজে ব্যবসার সুযোগ বাড়াতে হবে আরও


মো. মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকার পরও বিভিন্ন কারণে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এসব কারণের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনা, লোডশেডিং, আরম্ভ করার প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা, ব্যাংকঋণ পেতে বহুমুখী জটিলতা ও ক্ষেত্রবিশেষে ঘুষ প্রদানে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হওয়া, পণ্য পরিবহন সমস্যা, যোগাযোগ সমস্যা, কর্মী-অসন্তোষ, ব্যবসায়িক নিরাপত্তাহীনতাকে উল্লেখ করেন অনেকে। এ ধরনের সমস্যা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরসন করা না যায়, তাহলে ব্যবসাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে তোলা দুরূহ হবে। একই সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও বাংলাদেশে আকৃষ্ট করা সহজ হবে না। প্রকারান্তরে বাংলাদেশে সহজে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আরও পিছিয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক ও এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ২২ অক্টোবর ডুয়িং বিজনেস-২০১৩ শীর্ষক যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে, তাতেও সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ব্যবসায়ী মহলসহ দেশের অনেকেই হতাশ হবেন সন্দেহ নেই। তার পরও আমরা বলব, বাংলাদেশে এখনো অন্য অনেক দেশের চেয়ে সহজে ব্যবসা করার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। একে আরও উজ্জ্বল করে তুলতে হলে সরকারকে নিতে হবে ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থেই জরুরি। কারণ কোনো দেশে যদি সারা বছর ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করে, তাহলে একদিকে যেমন ওই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, অন্যদিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করাও সহজ হয়ে ওঠে। ব্যবসার মাধ্যমে কেবল ব্যবসায়ীরাই লাভবান হন এমনটি নয়, বরং পুরো দেশের উন্নয়ন ঘটে এতে। দেখা যায়, উন্নত দেশগুলো শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমেই আজ উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রকৌশল, চিকিত্সাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। অর্থনৈতিকভাবেও উন্নত দেশগুলোর অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী। এশিয়া মহাদেশের হয়েও জাপান শিল্পোন্নত দেশের শীর্ষে উঠে গেছে তরতর করে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার অবস্থানও উল্লেখ করার মতো। অথচ উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পেছনে থেকে এখনো শুধু উন্নয়নশীল দেশ হিসেবেই পরিচিতি পাচ্ছে বিশ্বব্যাপী।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি সংক্ষেপে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোনো দেশে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করা কতটুকু সহজ হবে, এর ওপর বিশ্বব্যাংক জরিপ চালায়। এ জরিপে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১০টি বিষয় আলাদা আলাদা মানদণ্ডের ভিত্তিতে দেশগুলোর র‍্যাংকিং করা হয়। এ র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, ভুটান ও মালদ্বীপ। প্রকাশিত সূচকে দেখা যায়, বাংলাদেশ আগেরবারের তুলনায় এ বছর আরও পিছিয়েছে। বিশ্বের ১৮৫টি দেশের ২০১১ সালের জুন থেকে ২০১২-এর জুন পর্যন্ত সময়ে সংগৃহীত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ওই সূচক প্রকাশ করা হয়েছে। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১২৯তম। ২০১২ সালে প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২২তম। তারও আগে ২০১১ সালের সূচকে ছিল ১১৮তম। এ প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেরিতে পাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়েছে। পাশাপাশি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান তেমন ভালো নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, তা করতেই দুই সপ্তাহের বেশি সময় লেগে যায়। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুমতির ক্ষেত্রে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার, তা করতেও অনেক দেরি হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রক্রিয়া শেষ করতে সিঙ্গাপুরে সময় লাগে মাত্র ১৫০ দিন। অথচ বাংলাদেশে প্রয়োজন হয় অনেক দীর্ঘ সময়। বিভিন্ন চুক্তি বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন সূচক থেকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় কী? বাংলাদেশ কি আগামী দিনগুলোয় ব্যবসাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে?
আইএফসির ওই প্রতিবেদন অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তবে ভারত ও ভুটান বাংলাদেশের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সূচকে এ বছরও ভারত গতবারের ১৩২তম স্থানে রয়েছে। প্রকাশিত সূচকে দেখা যায়, বিশ্বে ব্যবসা করার সবচেয়ে উপযুক্ত দেশ হলো সিঙ্গাপুর। আইএফসির প্রকাশিত তালিকার শীর্ষে এখন অবস্থান করছে সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের পর পর্যায়ক্রমে দশটি দেশের তালিকায় রয়েছে হংকং (চীন), নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, জর্জিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। লক্ষণীয়, অষ্ট্রেলিয়া গতবারের তালিকায় ১৫তম থেকে এবার দশম স্থানে উঠে এসেছে। জর্জিয়ার অবস্থান
আগেরবারের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। গত বছর জর্জিয়ার অবস্থান ছিল ১৬তম। এবার দেশটি নবম স্থানে উঠে এসেছে। প্রশ্ন ওঠে, জর্জিয়া কীভাবে সাত ধাপ এগিয়ে গেল? ওই দেশটি এমন কী পরিবর্তন সাধন করেছে যে, এক বছরেই শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে? অথচ বাংলাদেশ যাচ্ছে পেছনের দিকে! বাংলাদেশে কেন ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়ছে— এ প্রশ্নের সুরাহা হওয়া উচিত। ব্যবসা করার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে আমরা আরও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবো না কি? দেশে সহজে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে যাবতীয় বাধা দ্রুত অপসারণ করা হোক। যদি এমনটি করা যায়, তাহলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও মজবুত হবে।
শেষ করার আগে ব্যবসাক্ষেত্রে বিরাজিত আরেকটি সমস্যা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। অনেক ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময়ে চাঁদাবাজির শিকার হন বলে প্রায়ই অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। বড় ব্যবসায়ীদের নাকি বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়, তেমনি ছোট ব্যবসায়ীদেরও দিতে হয় ছোট অঙ্কের চাঁদা। ব্যবসাকে পর্যুদস্ত করে চাঁদাবাজি। ব্যবসাক্ষেত্রে অব্যাহত চাঁদাবাজির পরিপ্রেক্ষিতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় এবং এর প্রভাব পড়ে জনজীবনে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা যদি ব্যাহত হয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে, তাহলে ওই পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। চাঁদা দাবির এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে দেশের স্বার্থেই; সুযোগ তৈরি করতে হবে নিরাপদে এবং সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য করার। মোট কথা, বাংলাদেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, তার সবই করতে হবে কোনোরূপ কালক্ষেপণ না করেই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment