Sunday, March 9, 2014

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে কেন?



মার্চ ৯, ২০১৪, রোববার : ফাল্গুন ২৫, ১৪২০
(বাতায়ন)
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে কেন?
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ০৯ মার্চ, ২০১৪
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেদখল হওয়া তাদের কয়েকটি হল পুনরুদ্ধারের জন্য প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন। এর অংশ হিসেবে তারা ১৯ ফেব্রয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করে দিয়ে সামনের সড়ক অবরোধ এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। হল উদ্ধারের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা ওইদিন সকাল ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেন। এ সময় সড়কের বিভিন্ন স্থানে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এরই মধ্যে হল উদ্ধারের জন্য শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সমিতি। ফলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে। এদিকে ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা তিব্বত হলসহ বেদখল হওয়া অন্য হলগুলো উদ্ধারের জন্য রাস্তায় নেমে এলে পুলিশের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় জনমনে ব্যাপক আতংকের সৃষ্টি হয়। এ সংঘর্ষে শিক্ষকসহ বহু শিক্ষার্থী আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করতে গিয়ে যে ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা উদ্বেগজনক। আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির দ্রুত অবসান চাই।
হল উদ্ধারের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক হল অবৈধভাবে দখলে রয়েছে বহু বছর ধরে। সরকারি জগন্নাথ কলেজটি ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরের আগ থেকেই হলগুলো বেদখল হয়ে আছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা ১৯৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি হল দখল করে নেয় বলে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে বেদখল হওয়া এসব হলের মধ্যে নাকি মাত্র ৬টির বৈধ কাগজপত্র রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। হলগুলো উদ্ধারের জন্য তখন জগন্নাথ কলেজের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হলে মামলার রায় কলেজের অনুকূলে যায়। তারপরও তখনকার সরকারের পক্ষ থেকে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা কিংবা হল উদ্ধারের জন্য তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে দেখা যায়, বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আদালতের রায় পেলেও হলগুলোর দখল বুঝে পায়নি। এখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট আরও তীব্র হওয়ায় অনন্যোপায় হয়ে শিক্ষার্থীরা হলগুলো নিজেদের দখলে নিয়ে আসার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। হল উদ্ধারের এ আন্দোলন এখন কোন দিকে মোড় নেয় সেটাই আমাদের ভাবনার বিষয়, একই সঙ্গে উদ্বেগেরও। কারণ আমাদের দেশে আন্দোলন মানেই সংঘাত-সংঘর্ষ আর শক্তি প্রদর্শন করা। পরিতাপের ব্যাপার, এ দেশে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হতে দেখা যায় না সচরাচর।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে শুধু তাদের বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করছেন, তা নয়। বরং তারা এ আন্দোলনের মাধ্যমে হল উদ্ধারের দাবির সঙ্গে আরও কয়েকটি দাবিও উত্থাপন করেছেন। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদরঘাট শাখা স্থানান্তর, শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট মোকাবেলায় নতুন হল নির্মাণ এবং শিক্ষকদের আবাসনের ব্যবস্থা করা। শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি উত্থাপন করেছেন সেগুলো জরুরি হলেও এর সমর্থনে সহিংস আন্দোলন কাম্য নয় কিছুতেই। কয়েকদিন আগে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা শহীদ আজমল হোসেন হলের সামনে ব্যানার টাঙাতে গেলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছিল। পরে শিক্ষার্থীরা অন্য একটি হলের সামনে ব্যানার টাঙিয়ে রেখে চলে আসার কিছুক্ষণ পর ব্যবসায়ীরা সেটি খুলে ফেলেন এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এ ধরনের পাল্টাপাল্টি মনোভাব পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলবে সন্দেহ নেই।
এদিকে সোমবারও শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার মোড় অবরোধ করে সমাবেশ করেছেন। ওইদিন বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে মানববন্ধন করে শিক্ষক সমিতি। তারা চতুর্থ দিনের মতো কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে এখন মনে হচ্ছে, আগামী দিনগুলোয় আন্দোলন আরও তীব্র হবে। ফলে বাড়বে সংঘাত। অন্যদিকে বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধারের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্থানীয় এক সংসদ সদস্যকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য যথাসম্ভব কাছাকাছি স্থানে নতুন জমি কেনার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষকে আহ্বায়ক করে জমি ক্রয় কমিটি গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এমনকি আবাসিক সমস্যা নিরসন না করা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কাজেই এ অবস্থায় আমরা আশা করব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন এবং অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেবেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো উদ্ধারের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং এর ফলে যে ধরনের সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
অনেকেই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধারের দায়িত্ব কি শিক্ষার্থীদের? আমরা ভেবে পাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে কেন? অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন পড়ালেখা করার জন্য, হল উদ্ধারে আন্দোলন করার জন্য নয়। দেশে কার্যকর সরকার ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ, এমনকি আমাদের আদালতও রয়েছেন। কাজেই সংঘাতের পথে না গিয়ে আইনসম্মত উপায়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে এটাই কাম্য। হলগুলো উদ্ধারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কেন আইনানুগ পথে যাচ্ছে না? যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে আদালতে একবার মামলা করেছিল এবং রায়ও হয়েছিল তাদের অনুকূলে, কিন্তু রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় তারা কি এখন আবার আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না? মনে রাখতে হবে, হলগুলো উদ্ধারের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের, শিক্ষার্থীদের নয়। যেসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করছেন, এটা তাদের করার কথা নয়। শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। কাজেই আমরা আশা করব, হল নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনসম্মত পথে এগিয়ে যাবে। অন্যদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের প্রতি যে ধরনের ক্ষুব্ধ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন সেটাও কাম্য নয়। শিক্ষার্থীদের টাঙিয়ে দেয়া ব্যানার পুড়িয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে শক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। এটা না করে তারা সহনশীল মনোভাব নিয়ে আলোচনার পথে এগিয়ে যেতে পারতেন।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, আমাদের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রছাত্রীদের আবাসনের তীব্র সংকট রয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম কয়েক বছর বহু শিক্ষার্থী হলে সিট লাভে ব্যর্থ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনেক ছাত্রনেতার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগও রয়েছে। এ অবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সিটপ্রাপ্তি নিয়ে সংকট থেকেই যায়। এ পরিস্থিতির অবসান করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই। আবার অনেক হলে যতজন শিক্ষার্থী থাকার কথা, বাস্তবে থাকতে হচ্ছে আরও অনেক বেশি শিক্ষার্থীকে। কোনো পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরই এভাবে হলে গাদাগাদি করে থাকা সমীচীন নয়, প্রত্যাশিতও নয়। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে সত্য। তারপরও কিভাবে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট মোকাবেলা করা যায় সেদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বেশি মনোযোগ দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য নতুন হল নির্মাণ করার জন্য সরকারের তরফ থেকেও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক,সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment