Monday, March 24, 2014

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে চাই আরো উদ্যোগ



ঢাকা, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০১৪, ১০ চৈত্র ১৪২০
(দৃষ্টিকোণ)
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে চাই আরো উদ্যোগ
মো. মুজিবুর রহমান
সাধারণ পরিবারের শিশুরাও যাতে শিক্ষালাভের সুযোগ পায় সে জন্য বিগত কয়েক বছরে সরকারের তরফ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে টেকস্ট বই বিতরণ, টেকস্ট বইগুলো আরো সহজলভ্য করার জন্য ই-বুকে রূপান্তর, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তির সংখ্যা বৃদ্ধি, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য স্কুল শিক্ষকদের ধারাবাহিক পেশাগত প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি এবং সেগুলো শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ নেয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এখন আবার দেশজুড়ে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে চলছে শিক্ষকদের তৈরি মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট প্রতিযোগিতা- ২০১৩। এ প্রতিযোগিতা চলবে ৩০ মার্চ পর্যন্ত। এর মাধ্যমে সেরা শিক্ষকদের বাছাই করে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ১০ শিক্ষক নির্বাচন করা হবে এবং তাদের পুরস্কৃত করা হবে। এর আগেও পরপর দুই বছর এ ধরনের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার প্রতিযোগিতার শেষ পর্যায়ে শিক্ষা নিয়ে টেলিভিশনে ২৬ পর্বের রিয়েলিটি শো অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরিকল্পনা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় আইসিটি দক্ষতা অর্জনসহ তাদের একুশ শতকের উপযোগী করে গড়ে তোলা মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরির কর্মসূচি বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য। এরই মধ্যে দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। দেশের ২৩ হাজার ৩০০ স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ ধীরে ধীরে বাড়ছে- এটা সত্য। একই সঙ্গে পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারও বাড়ছে; কিন্তু সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের পরও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ১২ বছরের শিক্ষায় প্রায় ৬৫ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৪ ভাগ প্রথম পাঁচ বছরে বা পঞ্চম শ্রেণিতে এবং পরের পাঁচ বছরে বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত আরো ২৬ ভাগ ও বাকিরা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ঝরে যায় (দৈনিক যুগান্তর, ২২.০৩.১৪)। আরেক তথ্যে দেখা যায়, প্রতি বছর সরকার প্রাথমিক স্তরে ৭০ লাখ, মাধ্যমিক স্তরে ৪০ লাখ এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ১ লাখ ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীকে উপ-বৃত্তি প্রদান করছে। শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ বাড়ানো এবং শিক্ষার মান ও গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের এত উদ্যোগ গ্রহণের পরও ঝরে পড়ার হার নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা উদ্বেগজনক। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, কেন এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এদের ধরে রাখতে হলে আর কী করা দরকার?
এদিকে ঢাকায় প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৪ ভাগ পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। আর অবশিষ্টদের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি ১০ জনে যেতে পারে প্রায় ৭ জন। এসব চিত্র আমাদের শিক্ষার জন্য মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। এ অবস্থায় কিভাবে প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। কারণ যে সব শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে তারা নিজেদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। যারা পড়ালেখা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় কিংবা পড়ালেখার সুযোগ পেলেও নানা কারণে তা অব্যাহত রাখতে পারে না তারা একসময় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি করে। আবার স্বল্প পড়ালেখা জানা ব্যক্তিরা না পারে ভাল কোনো কাজ জোগাড় করতে, আবার না পারে স্বতস্ফূর্তভাবে কৃষিকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা অন্য কোনো কর্মে যোগ দিতে। ফলে তারা অদক্ষ জনবলে পরিণত হয়। সব শেষে এদের এক বিরাট অংশ অনন্যোপায় হয়ে অর্থনৈতিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ অদক্ষ শ্রমের বাজারে প্রবেশ করে। সন্দেহ নেই, যে কোনো দেশেই অদক্ষ জনবল রাষ্ট্রের বড় রকমের বোঝা। এ বোঝা লাঘব করতে হলে এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ানো যায় এবং তাদের শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখা যায়। আর যারা একান্ত বাধ্য হয়েই পড়ালেখা চালিয়ে নিতে পারবে না তারা যাতে অন্তত কর্মোপযোগী শিক্ষা গ্রহণ না করা পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে না পারে সে ব্যবস্থাও নিতে হবে একই সঙ্গে।
স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার যে সব স্বীকৃত কারণ রয়েছে সেগুলো ছাড়াও দেখা যায়, ১. শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের অসচেতনতা, ২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরানন্দ শিক্ষা ব্যবস্থা, ৩. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার বিরক্তিকর একটানা সময়সূচি, ৪. বছরের পুরো সময় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করানোর ফলে পঠন-পাঠন কার্যক্রমে বৈচিত্র্যময় পরিবেশের সৃষ্টি না হওয়া, ৫. দিনব্যাপী শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা না থাকা, ৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত সমস্যা, ৭. বেশির ভাগ শিক্ষকের গতানুগতিক পদ্ধতিতে পাঠদান, ৮. পরীক্ষামুখী শিক্ষা কার্যক্রম, ৯. উপেক্ষিত সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী, ১০. স্কুলগুলোয় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব, ১১. অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব, ১২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থী টেনে নিয়ে আসার জন্য বহু কোচিং সেন্টারের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও নানামুখী প্রচেষ্টা, ১৩. গবেষণাহীন শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, ১৪. টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পরিচালিত শিক্ষক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণবিহীন বহু প্রশিক্ষক (প্রকৃতপক্ষে প্রশিক্ষণবিহীনদের প্রশিক্ষক বলা যায় না) দিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালানো ইত্যাদি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। কাজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে হলে এখানে যে সব দিকের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো নিরসনে মনোযোগ দিতে হবে এখনই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

Sunday, March 9, 2014

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে কেন?



মার্চ ৯, ২০১৪, রোববার : ফাল্গুন ২৫, ১৪২০
(বাতায়ন)
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে কেন?
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ০৯ মার্চ, ২০১৪
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেদখল হওয়া তাদের কয়েকটি হল পুনরুদ্ধারের জন্য প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন। এর অংশ হিসেবে তারা ১৯ ফেব্রয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করে দিয়ে সামনের সড়ক অবরোধ এবং অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। হল উদ্ধারের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা ওইদিন সকাল ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেন। এ সময় সড়কের বিভিন্ন স্থানে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এরই মধ্যে হল উদ্ধারের জন্য শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সমিতি। ফলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে। এদিকে ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা তিব্বত হলসহ বেদখল হওয়া অন্য হলগুলো উদ্ধারের জন্য রাস্তায় নেমে এলে পুলিশের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় জনমনে ব্যাপক আতংকের সৃষ্টি হয়। এ সংঘর্ষে শিক্ষকসহ বহু শিক্ষার্থী আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করতে গিয়ে যে ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা উদ্বেগজনক। আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির দ্রুত অবসান চাই।
হল উদ্ধারের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক হল অবৈধভাবে দখলে রয়েছে বহু বছর ধরে। সরকারি জগন্নাথ কলেজটি ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরের আগ থেকেই হলগুলো বেদখল হয়ে আছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা ১৯৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি হল দখল করে নেয় বলে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে বেদখল হওয়া এসব হলের মধ্যে নাকি মাত্র ৬টির বৈধ কাগজপত্র রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। হলগুলো উদ্ধারের জন্য তখন জগন্নাথ কলেজের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হলে মামলার রায় কলেজের অনুকূলে যায়। তারপরও তখনকার সরকারের পক্ষ থেকে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা কিংবা হল উদ্ধারের জন্য তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে দেখা যায়, বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আদালতের রায় পেলেও হলগুলোর দখল বুঝে পায়নি। এখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট আরও তীব্র হওয়ায় অনন্যোপায় হয়ে শিক্ষার্থীরা হলগুলো নিজেদের দখলে নিয়ে আসার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। হল উদ্ধারের এ আন্দোলন এখন কোন দিকে মোড় নেয় সেটাই আমাদের ভাবনার বিষয়, একই সঙ্গে উদ্বেগেরও। কারণ আমাদের দেশে আন্দোলন মানেই সংঘাত-সংঘর্ষ আর শক্তি প্রদর্শন করা। পরিতাপের ব্যাপার, এ দেশে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হতে দেখা যায় না সচরাচর।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে শুধু তাদের বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করছেন, তা নয়। বরং তারা এ আন্দোলনের মাধ্যমে হল উদ্ধারের দাবির সঙ্গে আরও কয়েকটি দাবিও উত্থাপন করেছেন। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদরঘাট শাখা স্থানান্তর, শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট মোকাবেলায় নতুন হল নির্মাণ এবং শিক্ষকদের আবাসনের ব্যবস্থা করা। শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি উত্থাপন করেছেন সেগুলো জরুরি হলেও এর সমর্থনে সহিংস আন্দোলন কাম্য নয় কিছুতেই। কয়েকদিন আগে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা শহীদ আজমল হোসেন হলের সামনে ব্যানার টাঙাতে গেলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছিল। পরে শিক্ষার্থীরা অন্য একটি হলের সামনে ব্যানার টাঙিয়ে রেখে চলে আসার কিছুক্ষণ পর ব্যবসায়ীরা সেটি খুলে ফেলেন এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এ ধরনের পাল্টাপাল্টি মনোভাব পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলবে সন্দেহ নেই।
এদিকে সোমবারও শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার মোড় অবরোধ করে সমাবেশ করেছেন। ওইদিন বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে মানববন্ধন করে শিক্ষক সমিতি। তারা চতুর্থ দিনের মতো কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে এখন মনে হচ্ছে, আগামী দিনগুলোয় আন্দোলন আরও তীব্র হবে। ফলে বাড়বে সংঘাত। অন্যদিকে বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধারের ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্থানীয় এক সংসদ সদস্যকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের জন্য যথাসম্ভব কাছাকাছি স্থানে নতুন জমি কেনার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষকে আহ্বায়ক করে জমি ক্রয় কমিটি গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এমনকি আবাসিক সমস্যা নিরসন না করা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কাজেই এ অবস্থায় আমরা আশা করব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন এবং অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেবেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো উদ্ধারের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং এর ফলে যে ধরনের সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
অনেকেই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধারের দায়িত্ব কি শিক্ষার্থীদের? আমরা ভেবে পাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে কেন? অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন পড়ালেখা করার জন্য, হল উদ্ধারে আন্দোলন করার জন্য নয়। দেশে কার্যকর সরকার ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ, এমনকি আমাদের আদালতও রয়েছেন। কাজেই সংঘাতের পথে না গিয়ে আইনসম্মত উপায়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে এটাই কাম্য। হলগুলো উদ্ধারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কেন আইনানুগ পথে যাচ্ছে না? যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে আদালতে একবার মামলা করেছিল এবং রায়ও হয়েছিল তাদের অনুকূলে, কিন্তু রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় তারা কি এখন আবার আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না? মনে রাখতে হবে, হলগুলো উদ্ধারের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের, শিক্ষার্থীদের নয়। যেসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধারের জন্য আন্দোলন করছেন, এটা তাদের করার কথা নয়। শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। কাজেই আমরা আশা করব, হল নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনসম্মত পথে এগিয়ে যাবে। অন্যদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের প্রতি যে ধরনের ক্ষুব্ধ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন সেটাও কাম্য নয়। শিক্ষার্থীদের টাঙিয়ে দেয়া ব্যানার পুড়িয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে শক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। এটা না করে তারা সহনশীল মনোভাব নিয়ে আলোচনার পথে এগিয়ে যেতে পারতেন।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, আমাদের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রছাত্রীদের আবাসনের তীব্র সংকট রয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম কয়েক বছর বহু শিক্ষার্থী হলে সিট লাভে ব্যর্থ হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনেক ছাত্রনেতার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগও রয়েছে। এ অবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সিটপ্রাপ্তি নিয়ে সংকট থেকেই যায়। এ পরিস্থিতির অবসান করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই। আবার অনেক হলে যতজন শিক্ষার্থী থাকার কথা, বাস্তবে থাকতে হচ্ছে আরও অনেক বেশি শিক্ষার্থীকে। কোনো পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরই এভাবে হলে গাদাগাদি করে থাকা সমীচীন নয়, প্রত্যাশিতও নয়। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে সত্য। তারপরও কিভাবে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট মোকাবেলা করা যায় সেদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বেশি মনোযোগ দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য নতুন হল নির্মাণ করার জন্য সরকারের তরফ থেকেও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক,সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

Tuesday, March 4, 2014

বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধারের দায়িত্ব কি শিক্ষার্থীদের?

 
ঢাকা, মঙ্গলবার, ০৪ মার্চ ২০১৪, ২০ ফাল্গুন ১৪২০, ০২ জমা. আউয়াল ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধারের দায়িত্ব কি শিক্ষার্থীদের?

মো. মুজিবুর রহমান
আমাদের ধারণা ছিল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধারের জন্য সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দেয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে ধীরে ধীরে। আমরা এটাও ভেবেছিলাম, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করবে দ্রুত। অথচ বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বরং হল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য এসবের সঙ্গে পুলিশও জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শহীদ আজমল হোসেন হলটি নিজেদের দখলে নিয়ে আসার জন্য গত রবিবার অভিযান চালিয়েছে। এর আগে বেদখল হওয়া হলগুলো উদ্ধারের জন্য তাদের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। তৈরি করা হয়েছিল সাইনবোর্ড, ব্যানার। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ওইদিন আজমল হোসেন হলের সামনে ব্যানারও টাঙাতে গিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তারা অন্য একটি হলের সামনে ব্যানার লাগিয়ে দেয়। এর কিছুক্ষণ পর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সেটি খুলে পুড়িয়ে ফেলেন এবং আবাসিক এলাকায় হল না করার জন্য স্লোগানও দেন। এ নিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া হলগুলো দ্রুত উদ্ধার এবং অশান্ত পরিস্থিতির অবসান হবে সেটাই এখন ভাবনার বিষয়। কারণ হল উদ্ধার নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যে ধরনের পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে যে কোনো মুহূর্তে পুরো এলাকায় ঘটতে পারে আরো বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এর আগে এ নিয়ে এক ভয়াবহ সংঘর্ষে প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থীসহ অনেক শিক্ষকও আহত হওয়ার খবর রয়েছে। এ অবস্থায় হল উদ্ধার নিয়ে বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বিগ্ন।
বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে পুরান ঢাকার স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি হল দখল করে নেয়। বেদখল হওয়া এসব হলের মধ্যে মাত্র ৬টি হলের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। হলগুলো উদ্ধারের জন্য অনেক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা দায়ের করে। আদালত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে প্রভাবশালীরা হলগুলো নিজেদের দখলে রাখে। বিস্ময়ের ব্যাপার, তখন সরকারের পক্ষ থেকেও আদালতের রায় বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকদফা চেষ্টা করেও হলগুলো উদ্ধার করতে পারেনি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেগুলো বেদখলমুক্ত করার জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছে।
এখানে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, যেসব হল বেদখল হয়েছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে সেগুলো দখলমুক্ত করে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করার কোনো বিকল্প নেই। আর এটি করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই। এ উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কাম্য নয় কিছুতেই। আমরা ভেবে পাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধারের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হবে কেন? শিক্ষার্থীদের কাজ কি হল উদ্ধার করা? দেশে উপযুক্ত আইন-আদালত রয়েছে, রয়েছে কার্যকর সরকার ব্যবস্থা। আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীও রয়েছে। কাজেই এ অবস্থায় একদিকে যেমন বহু বছর ধরে বেদখলে থাকা হলগুলো উদ্ধারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযান চালানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তেমনি অন্যদিকে হলগুলো উদ্ধারে কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততাও প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা মনে করি, যে কোনো স্থাপনা বেআইনি দখলমুক্ত করার দায়িত্ব সরকারের। প্রয়োজন হলে সরকারকে আইনসম্মত উপায়ে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে।
আলোচ্য ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আদালতের রায়ও রয়েছে। কাজেই আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযানে নামতে হবে শিগগির; শিক্ষার্থীদের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত আবাসনের ব্যবস্থা করা।
সন্দেহ নেই, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চরম আবাসন সংকটের মধ্যদিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, জগন্নাথ কলেজটি ২০০৫ সালের এক আইনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হওয়ার পর থেকে নানা ধরনের সমস্যা ও সংকটের মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগেও যে এখানে সমস্যা ছিল না তা নয়। কিন্তু তখন সরকারি কলেজ হিসেবে এর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করত সরকার। এখন এর দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। ফলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসংকট আরো বেড়েছে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে চেষ্টা করে আয় বাড়ানোর জন্য কোর্স ফি বাড়িয়ে দেয়ার। একবার বিভিন্ন কোর্সের ফি বৃদ্ধি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পথে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক সংকট এবং অযৌক্তিভাবে কোর্স ফি বাড়ানোই ছিল তখনকার আন্দোলনের মূল কারণ। এবারও দেখা যাচ্ছে, হল নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন আরম্ভ করেছে। আমরা চাই, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নেয়ার আগেই সরকারের তরফ থেকে দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ নেয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা হবে। এ দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়েরও।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com
http://www.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDNfMDRfMTRfMV80XzFfMTEzMDk1