ঢাকা, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০১৪, ১০ চৈত্র ১৪২০
(দৃষ্টিকোণ)
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে চাই আরো উদ্যোগ
মো. মুজিবুর রহমান
সাধারণ
পরিবারের শিশুরাও যাতে শিক্ষালাভের সুযোগ পায় সে জন্য বিগত কয়েক বছরে সরকারের তরফ
থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে প্রাথমিক স্তর থেকে
আরম্ভ করে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে টেকস্ট বই বিতরণ,
টেকস্ট বইগুলো আরো সহজলভ্য করার জন্য ই-বুকে রূপান্তর, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য
বৃত্তির সংখ্যা বৃদ্ধি, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য
স্কুল শিক্ষকদের ধারাবাহিক পেশাগত প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, ডিজিটাল
কনটেন্ট তৈরি এবং সেগুলো শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ নেয়া ইত্যাদি
উল্লেখযোগ্য। এখন আবার দেশজুড়ে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে
চলছে শিক্ষকদের তৈরি মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট প্রতিযোগিতা- ২০১৩। এ প্রতিযোগিতা
চলবে ৩০ মার্চ পর্যন্ত। এর মাধ্যমে সেরা শিক্ষকদের বাছাই করে জাতীয় পর্যায়ে
শ্রেষ্ঠ ১০ শিক্ষক নির্বাচন করা হবে এবং তাদের পুরস্কৃত করা হবে। এর আগেও পরপর দুই
বছর এ ধরনের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার প্রতিযোগিতার শেষ পর্যায়ে শিক্ষা
নিয়ে টেলিভিশনে ২৬ পর্বের রিয়েলিটি শো অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরিকল্পনা রয়েছে
সংশ্লিষ্টদের। বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষকদের
প্রয়োজনীয় আইসিটি দক্ষতা অর্জনসহ তাদের একুশ শতকের উপযোগী করে গড়ে তোলা মাল্টিমিডিয়া
কনটেন্ট তৈরির কর্মসূচি বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য। এরই মধ্যে দেশের বহু শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। দেশের ২৩ হাজার
৩০০ স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে স্কুলের
প্রতি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ ধীরে ধীরে বাড়ছে- এটা সত্য। একই সঙ্গে পাবলিক পরীক্ষায়
পাসের হারও বাড়ছে; কিন্তু সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ
গ্রহণের পরও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ সম্প্রতি
প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রাথমিক
থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ১২ বছরের শিক্ষায় প্রায় ৬৫ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে।
এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৪ ভাগ প্রথম পাঁচ বছরে বা পঞ্চম শ্রেণিতে এবং পরের পাঁচ
বছরে বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত আরো ২৬ ভাগ ও বাকিরা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ঝরে যায়
(দৈনিক যুগান্তর, ২২.০৩.১৪)। আরেক তথ্যে দেখা যায়,
প্রতি বছর সরকার প্রাথমিক স্তরে ৭০ লাখ, মাধ্যমিক স্তরে ৪০ লাখ এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ১
লাখ ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীকে উপ-বৃত্তি প্রদান করছে। শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের নাগালে
নিয়ে আসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের
আকর্ষণ বাড়ানো এবং শিক্ষার মান ও গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের এত উদ্যোগ
গ্রহণের পরও ঝরে পড়ার হার নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তা উদ্বেগজনক। এ
পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, কেন এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
এদের ধরে রাখতে হলে আর কী করা দরকার?
এদিকে
ঢাকায় প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে,
বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ২৪ ভাগ পঞ্চম
শ্রেণির শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। আর অবশিষ্টদের মধ্যে
ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি ১০ জনে যেতে পারে প্রায় ৭ জন। এসব চিত্র আমাদের শিক্ষার
জন্য মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। এ অবস্থায় কিভাবে প্রাথমিক স্তর থেকে আরম্ভ করে উচ্চ
শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে
হবে গুরুত্বের সঙ্গে। কারণ যে সব শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে তারা নিজেদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। যারা পড়ালেখা করার
সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় কিংবা পড়ালেখার সুযোগ পেলেও নানা কারণে তা অব্যাহত রাখতে
পারে না তারা একসময় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন
ধরনের সমস্যা তৈরি করে। আবার স্বল্প পড়ালেখা জানা ব্যক্তিরা না পারে ভাল কোনো
কাজ জোগাড় করতে, আবার না পারে স্বতস্ফূর্তভাবে কৃষিকাজ,
ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা অন্য কোনো কর্মে যোগ দিতে। ফলে তারা
অদক্ষ জনবলে পরিণত হয়। সব শেষে এদের এক বিরাট অংশ অনন্যোপায় হয়ে অর্থনৈতিকভাবে কম
গুরুত্বপূর্ণ অদক্ষ শ্রমের বাজারে প্রবেশ করে। সন্দেহ নেই, যে কোনো দেশেই অদক্ষ জনবল রাষ্ট্রের বড় রকমের বোঝা। এ বোঝা লাঘব
করতে হলে এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ানো
যায় এবং তাদের শ্রেণিকক্ষে ধরে রাখা যায়। আর যারা একান্ত বাধ্য হয়েই পড়ালেখা চালিয়ে
নিতে পারবে না তারা যাতে অন্তত কর্মোপযোগী শিক্ষা গ্রহণ না করা পর্যন্ত শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে না পারে সে ব্যবস্থাও নিতে হবে একই সঙ্গে।
স্কুল
থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার যে সব স্বীকৃত কারণ রয়েছে সেগুলো ছাড়াও দেখা যায়,
১. শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের অসচেতনতা, ২.
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরানন্দ শিক্ষা ব্যবস্থা, ৩.
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার বিরক্তিকর একটানা সময়সূচি, ৪. বছরের পুরো সময় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করানোর ফলে
পঠন-পাঠন কার্যক্রমে বৈচিত্র্যময় পরিবেশের সৃষ্টি না হওয়া, ৫. দিনব্যাপী শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের
ব্যবস্থা না থাকা, ৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত সমস্যা,
৭. বেশির ভাগ শিক্ষকের গতানুগতিক পদ্ধতিতে পাঠদান, ৮. পরীক্ষামুখী শিক্ষা কার্যক্রম, ৯. উপেক্ষিত
সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী, ১০. স্কুলগুলোয় বিষয়ভিত্তিক
শিক্ষকের অভাব, ১১. অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
দূরত্ব, ১২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থী টেনে নিয়ে
আসার জন্য বহু কোচিং সেন্টারের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও নানামুখী প্রচেষ্টা, ১৩. গবেষণাহীন শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, ১৪.
টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পরিচালিত শিক্ষক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণবিহীন বহু প্রশিক্ষক
(প্রকৃতপক্ষে প্রশিক্ষণবিহীনদের প্রশিক্ষক বলা যায় না) দিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম
চালানো ইত্যাদি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। কাজেই শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে হলে এখানে যে সব দিকের উল্লেখ করা হয়েছে
সেগুলো নিরসনে মনোযোগ দিতে হবে এখনই।
লেখক
: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com