ঢাকা, শনিবার, নভেম্বর ২৪, ২০১২, অগ্রহায়ন ১০, ১৪১৯
উপ-সম্পাদকীয়
কেন পড়ালেখার খরচ বাড়ানো?
মো. মুজিবুর রহমান
এমনিতেই আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ হারে ভর্তি ফিসহ নানা খাতে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়
করছে। তার পরও যদি আবারও বিদ্যালয় ভর্তিসহ অন্যান্য খাতে টাকা বাড়ানো হয়, তাহলে এর চাপ পড়বে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের অভিভাবকদের ওপর।
অবাক ব্যাপার, একটি এক পাতার ভর্তি ফরমের দাম সরকার
নির্ধারণ করেছে ১০০ টাকা; অথচ অনেক বিদ্যালয়ে তা বিক্রি করছে কয়েক
গুণ বেশি দামে। শুধু তাই নয়, আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফরমের দাম
বাড়ানোর জন্য ঢাকার কয়েকটি স্কুল এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। যেসব
স্কুল ভর্তি ফরমের দাম বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে, তারা আবেদন করেই বসে থাকেনি; শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগও করছে বলে খবর রয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের
এ ধরনের প্রবণতা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে— এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষা
মন্ত্রণালয়ও হয়তো ভর্তি ফরমের মূল্য বাড়ানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে এক সময়।
তবে আশার কথা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থী ভর্তি খাতে
এবার কোনো টাকা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিবাচক
ফল বয়ে আনবে।
ভর্তি ফরমের দাম বাড়ানোর জন্য যেসব স্কুলের কর্তৃপক্ষ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে এবং যেসব স্কুল আবেদন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সেসবের কয়েকটির বিরুদ্ধে বিগত দিনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে
অতিরিক্ত অর্থ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। এমনও খবর রয়েছে, এসব স্কুলকে আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ পরবর্তীকালে
শিক্ষার্থীদের বেতনের সঙ্গে সমন্বয় অথবা ফেরত দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়
নির্দেশ দিলেও কয়েকটি স্কুল এ নির্দেশ উপেক্ষা করে চলেছে। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
স্কুলগুলোকে আবার ১৫ দিনের সময় দিয়েছে আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ শিক্ষার্থীদের ফেরত
অথবা বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ কতটুকু প্রতিপালন
করা হবে, এটিই এখন দেখার বিষয়।
২০১৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য নীতিমালা প্রণয়নের
উদ্দেশ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১১ নভেম্বর একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় অন্যান্য
বিষয়ের মধ্যে স্কুলে সংসদ সদস্যদের জন্য দুই শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিষয়টিও আলোচনায়
আসে। কোটা সংরক্ষণ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এটি নিয়ে এরই মধ্যে মহামান্য
হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও করা হয়েছে। তবে বিষয়টি শুধু আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ
থাকায় মহামান্য হাইকোর্ট রিটটি মুলতবি করে দিয়েছেন। সংসদ সদস্যদের জন্য স্কুলে
শিক্ষার্থী ভর্তিতে কোটা সংরক্ষণ করা হলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে কি না, এটি নিয়েও কর্তৃপক্ষ চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেছে। এদিকে
প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের জন্য কোটা সংরক্ষণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে
একটি গুরুত্বপূর্ণ খবরও প্রকাশিত হয়েছে ১৩ নভেম্বর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এরপর
প্রক্রিয়াটি বাতিল করেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এসময় অনেক জল ঘোলা করা হয়েছে।
কোটা সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা বলব, স্কুল পরিচালনা কমিটিসহ সবার গুরুত্ব দেয়া উচিত— কীভাবে এগুলোকে আরও ভালো ও উন্নত স্কুলে
পরিণত করা যায় সেদিকে। দেখা যায়, আমাদের দেশের সব স্কুলই সমানভাবে ভালো নয়
এবং সব স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবক আকর্ষণ ক্ষমতা সমান নয়। যেসব স্কুল
পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে, সেসব স্কুলের প্রতিই শিক্ষার্থীদের
আকর্ষণ থাকে বেশি। এ কারণে ভালো স্কুলে ভর্তির চাপ বেশি এবং যেখানে ভর্তির চাপ
বেশি থাকে সেখানে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী ভর্তির প্রবণতা লক্ষ করা
যায়। এসব অনিয়মের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিসহ অনেক শিক্ষকও জড়িয়ে
পড়েন কখনো কখনো। শুধু তাই নয়, ভর্তির সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থের
সংশ্লিষ্টতা থাকা এবং ভর্তিতে ব্যাপক প্রতিযোগিতার কারণে স্কুল পরিচালনা কমিটির
অনেক সদস্যও এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হন বলে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হয়। এ ধরনের
অসুস্থ প্রবণতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা কোনোটারই স্বাভাবিক বিকাশে
সহায়ক নয়। বরং অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবে, তাদের বেশির ভাগ পড়ালেখা শেষ করে ভবিষ্যতে নিজেরা
দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে পড়বে— এতে সন্দেহ নেই। এটি মানুষের স্বাভাবিক
প্রবণতা, একবার দুর্নীতির মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে গেলে পরে একইভাবে আরও একাধিক সুবিধা পাওয়ার
আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে।
স্কুলে ভর্তিসহ অন্যান্য ফি বাড়ানো হলে পড়ালেখার খরচ বেড়ে
যাবে— এ দিকটি কর্তৃপক্ষকে
বিবেচনা করতে হবে। দেখা যায়, একদিকে সরকার বিনা মূল্যে কোটি কোটি
টাকার বই বিতরণ করছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে, অন্যদিকে
স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থকে নানা খাতে আদায় করছে বাড়তি অর্থ। স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ
থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ আদায় করলে শিক্ষার্থীরা সরকারের বিনা মূল্যে বই বিতরণের
সুফল পেল কোথায়? একটি সরকারি স্কুলে অর্থ আদায়ের রসিদ
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২০টিরও বেশি খাতে টাকা নেয়া হচ্ছে। কেন ২০টিরও বেশি খাতে অর্থ আদায় করা হচ্ছে— সে বিষয়টি কি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই? যেসব খাতে স্কুলগুলো অর্থ আদায় করে সেসব কতটুকু নিয়মসম্মত— তা কি খুঁজে দেখার দরকার পড়ে না? বিভিন্ন স্কুলে নিয়মিত অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হলেও সরকারের
কোনো কর্তৃপক্ষ কি অনুসন্ধান করে দেখছে— প্রতি মাসে আদায় করা বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে খরচ হয়?
শিক্ষার্থীর কাছ থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোন খাতে কী পরিমাণ
অর্থ আদায় করতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করে দেয়া জরুরি। আঞ্চলিক
ভিত্তিতে এসব খাতে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে, তবে
খাতভিত্তিক ব্যাপক পার্থক্য কাম্য নয়। স্কুলগুলোর মধ্যে অর্থ আদায়ে যাতে একটি
সাধারণ সমতা বজায় থাকে, সে জন্যই খাতগুলো নির্দিষ্ট করে দেয়া
দরকার। শিক্ষার্থী ভর্তি খাতে টাকা বাড়ানোর বিষয়টি প্রতি পাঁচ বছর পর পর বিবেচনার
সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে সরকার নির্ধারিত টাকার বাইরে অতিরিক্ত
অর্থ আদায় করতে না
পারে, সে জন্যও
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মানুযায়ী আর্থিক
কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আরও
মানসম্পন্ন ও উন্নত হতে বেশি সময় লাগবে না।
লেখক: টিচার্স ট্রেনিং
কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment