নভেম্বর ০৫, ২০১২, সোমবার : কার্তিক ২১, ১৪১৯
বাংলা বানানে সমতা আসবে কি?
মোঃ মুজিবুর রহমানবাংলা বানানে সমতা আসবে কি?
এবার নির্দেশ জারি হয়েছে
সরকারের সব মন্ত্রণালয়,
বিভাগ, অধিদফতর, সংস্থা ও দফতরে বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানরীতি সম্পর্কিত
অভিধানগুলোর পর্যাপ্ত সংখ্যক কপি সংগ্রহ করার জন্য। উদ্দেশ্য, সরকারের সব দাফতরিক কাজের সর্বক্ষেত্রে বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানরীতি
অনুসরণ করা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ নির্দেশ সংবলিত পরিপত্রটি জারি করা হয়েছে
৩১ অক্টোবর বুধবার।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, সরকারের
বিভিন্ন দফতরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম বানানরীতি অনুসরণ করা
হচ্ছে। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বানানের শুদ্ধতা সম্পর্কে যত্নবান
হওয়া আবশ্যক এবং সরকারি কাজে ভাষারীতির অভিন্নতা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। এ
অবস্থায় বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানরীতি অনুসরণের মাধ্যমে সরকারি কাজে
বাংলা ভাষার ব্যবহারে সামঞ্জস্য বিধান করা প্রয়োজন। পরিপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলা
একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানরীতি এরই মধ্যে পাঠ্যপুস্তকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুসরণ
করা হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আলোচ্য পরিপত্রটি জারি করা হল। বাংলা ভাষার বানানে
অভিন্ন রীতি অনুসরণের উদ্দেশ্যে জারি করা সরকারের এ পরিপত্রের জন্য আমরা
কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে আমরা প্রত্যাশা করব, সরকারের সব বিভাগ, অধিদফতর, দফতর ও সংস্থায় যাতে পরিপত্রটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় তা নিশ্চিত করা
হবে।
বাংলাদেশে বাংলা বানানে যে কী
ধরনের বিভ্রান্তি বিরাজ করছে তা বিভিন্ন চিঠিপত্র, ব্যানার, সাইনবোর্ড, লিফলেট, পোস্টার
দেখলেই বোঝা যায়। দেশের পত্রপত্রিকাগুলোতেও বাংলা বানান লেখায় ব্যাপক ভিন্নতা
পরিলক্ষিত হয়। পত্রপত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন বানানরীতির প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের
শুদ্ধভাবে বানান শেখায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের
পাঠ্যপুস্তকে বাংলা একাডেমীর প্রকাশিত প্রমিত বাংলা বানানরীতি অনুসরণ করার প্রয়াস অব্যাহত
থাকলেও অন্যান্য স্তরের বইপত্রে বাংলা বানানে বিভ্রান্তি ঠিকই রয়ে গেছে। একটু
অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে দেশের সর্বত্র বাংলা বানানে
বিরাজ করছে যথেচ্ছাচার। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি ছাড়া বাংলা ভাষা, বাংলাসাহিত্য
এবং বাংলা বানান নিয়ে আমাদের মধ্যে তেমন কোন সচেতনতা লক্ষ্য করা যায় না। ফেব্রুয়ারি
এলেই যেন বাংলা ভাষা নিয়ে দেখা দেয় যত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ভাষার মাস চলে গেলে সব ঠিক
আগের মতো বেসামাল হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতি বাংলা ভাষা তো নয়ই, কোন দেশের অন্য কোন ভাষার জন্যও মঙ্গলজনক নয় বলে আমার ধারণা। যে কোন ভাষাকে
তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হতে দিতে হলে ভাষার শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে সবার
আগে। ভাষার ভুল ব্যবহার, বাক্য গঠনের জন্য অনুপযুক্ত শব্দ
চয়ন, বাক্য বিন্যাস ও প্রয়োগে জটিলতা ভাষার মান ক্ষুণ্ন করে
ব্যাপকভাবে। তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয় কোন ভাষায় বানানগত বিভ্রান্তি থাকলে। বাংলা
ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায়,
বানানে বিভ্রান্তি নিরসন এবং অভিন্ন বানানরীতি অনুসরণের জন্য
দেশের জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছেন বহুকাল থেকে। এ চেষ্টা ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও কম দেখা যায় না। সেখানেও গুণী
ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বাংলা ভাষার উন্নয়নে এবং বানানের অসমতা দূরীকরণে প্রয়াস
চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। এদিকে এক সময় আমাদের বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’। এ অভিধানটি ধাপে ধাপে বর্তমান পর্যায়ে এসে উপনীত
হয়েছে। বাংলা বানানের অভিন্ন রূপ প্রসঙ্গে এ অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণের প্রসঙ্গ
কথায় যথার্থই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল; সময়ের
ব্যবধানে তাই শব্দের বানান, তার উচ্চারণ এবং ব্যঙ্গার্থে
প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কোন ভাষায় ব্যবহƒত শব্দের বানানের
একাধিক রূপ এবং একাধিক অর্থ ওই ভাষার জীবনীশক্তি এবং প্রবহমানতারই বহিঃপ্রকাশ। তা সত্ত্বেও, বিশেষত
শব্দের বানানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান প্রবণতা একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি
প্রয়োগের পক্ষপাতী— যা শিক্ষার্থী ও ব্যবহারিক ভাষা চর্চাকারীদের
পক্ষে সুবিধাজনক।’ বাংলা একাডেমী প্রকাশিত অভিধানের এ অভিমত অনুযায়ীও
বাংলা বানানে অভিন্ন রীতি অনুসরণ করা জরুরি। স্বীকার করি, ভাষার নিজস্ব
গতিময়তার কারণে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সব সময় সম্ভব নয়। কিন্তু তার পরও ভাষায় একটি
সাধারণ মান ধরে রাখার জন্য ভাষা ব্যবহারে,বানান লেখায় এবং
বাক্য গঠনে সর্বোচ্চ সচেতনতা অবলম্বন করা দরকার। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষার্থীদের
স্বার্থেই বাংলা বানানে অভিন্ন রীতি অনুসরণ করা উচিত।
বাংলা বানান নিয়ে রবীন্দ্র
ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক,
গবেষক পবিত্র সরকার, যিনি দীর্ঘদিন ধরে
বাংলা বানান নিয়ে গবেষণা করছেন। গত ১২ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ‘বাংলা বানান তোমার কিসের দুঃখ’ শীর্ষক
একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি তার লেখায় বাংলা বানানের সংস্কার এবং
সমতা বিধানের মূল যুক্তি তুলে ধরেছেন স্পষ্টভাবে। এ ছাড়া বাংলা বানান সংস্কারের
ক্ষেত্রে ১৯৩৬ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতির গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকারও উল্লেখ পাওয়া যায় তার এ নিবন্ধে। ওই নিবন্ধ নিয়ে তার সঙ্গে আমার ই-মেইল
যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। একপর্যায়ে আমার এক ই-মেইলের জবাবে তিনি লিখেছেন, ‘প্রিয়বরেষু, আপনার চিঠি
এবং লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। লেখাটি আমি কাল দেখব, আমার মতামতও জানাব।
আপনি এ বিষয়ে ভাবছেন,
সেটা আনন্দের কথা। এ বিষয়ে বেশি লোক তো ভাবে না।’ বাংলা ভাষা ও বানান নিয়ে যে আমাদের সবার আরও বেশি করে
ভাবা উচিত— এ দিকটিই তার মন্তব্যে প্রতিফলিত
হয়েছে বলে আমার ধারণা। তারও আগে অক্টোবরের ৫ তারিখে প্রবীণ গবেষক শ্রদ্ধাভাজন
গোলাম মুরশিদ ওই একই পত্রিকায় ‘দুখিনী বাংলা বানান’ শিরোনামের এক নিবন্ধে আমার অজানা অনেক তথ্য তুলে
ধরেছিলেন। শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকার ওই লেখার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতেই প্রথম
আলোয় তার লেখাটি দিয়েছিলেন। তিনি যে বাংলা বানান নিয়ে কিছু বিষয়ে গোলাম মুরশিদের সঙ্গে
ভিন্নমত পোষণ করেন,
সেটিও প্রকাশ করেছেন অকপটে। লেখা দুটি প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে
আমরা বাংলা বানান লেখায় আরও সচেতন হব কি না সেটিই আমার কাছে মুখ্য বিষয়।
বাংলা ভাষা ও বানান নিয়ে আমি নিজেও
দৈনিক যুগান্তরে একাধিক নিবন্ধ লিখেছি। বাংলা বানান নিয়ে ‘শুদ্ধ
বাংলা বানান প্রসঙ্গে’ শীর্ষক আমার একটি ছোট্ট লেখা
প্রথম আলো পত্রিকার ‘পাঠকের কলম’ বিভাগে ছাপা হয়েছিল ২০০৮ সালের ২১ মে। ওই লেখায় আমি
প্রস্তাব রেখেছিলাম,
ভুল বানান লেখার প্রবণতা রোধে প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি ‘ভুল বানান নির্মূল দিবস’
উদ্যাপন
করার জন্য। লেখাটি শেষ করেছিলাম একটি প্রশ্ন দিয়ে। এখানে প্রশ্নটির পুনরুল্লেখ
করা হল— ‘লেখাপড়া জানা মানুষ হিসেবে আমরা যদি শুদ্ধভাবে
মাতৃভাষায় এক পাতা লিখতে না পারি, তাহলে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার মর্যাদা
বৃদ্ধি করব কীভাবে?’ এর পর ‘গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর বাংলা বানান’ শীর্ষক আমার আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যুগান্তরে গত
বছর ২৫ অক্টোবর। ‘শ্রেণীকক্ষের
ভাষা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় একই পত্রিকায় এ বছর ৭
মে। তারও আগে এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভাষার মর্যাদা’ শীর্ষক আমার আরও একটি নিবন্ধ। এ নিবন্ধে আমি বাংলা
বানানের বিভ্রান্তি নিরসনে কিছু সুপারিশ রেখেছিলাম। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় যুগান্তর পাঠকদের
জন্য ওই লেখা থেকে সুপারিশের একটি অংশ পুনরায় তুলে দিলাম। সুপারিশটি ছিল— ‘এ সুযোগে আমি
বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর সম্পাদক পরিষদের কাছে সবিনয় আবেদন রাখব, তারা যেন
নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে একসঙ্গে বসে বাংলা বানান বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করেন এবং
তাদের আলোচনা ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিজেরা নিজেদের পত্রিকায় একই বানানের অভিন্ন
রূপ অনুসরণে একমত হন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অন্যদের বেলায় তা অনুসরণের জন্য
সুপারিশ রাখেন। তাহলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস, অবশ্যই বাংলা
বানানের ক্ষেত্রে বিরাজিত বিভ্রান্তিজনক পরিস্থিতির অবসান হবে দ্রুত এবং তা হবে
চিরতরে। এ ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারলে অবশ্যই তা হবে আমাদের বাংলা ভাষার জন্য এক
বড় ও সাফল্যজনক অর্জন। এ সাফল্যের প্রধান দাবিদার হতে পারে সংবাদপত্রের সম্পাদক পরিষদ।’ আমি জানি না আমার মতো সামান্য একজন মানুষের একটি অতি
সাধারণ লেখা বাংলাদেশের সম্পাদক পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল কি না।
তবুও আমি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল বাংলা ভাষার স্বার্থে আবারও সম্পাদক পরিষদের প্রতি একই
অনুরোধ রাখব।
শেষ করার আগে মন্ত্রিপরিষদ
বিভাগের জারি করা আলোচ্য পরিপত্র প্রসঙ্গে বলব, বাংলা ভাষার বানানে অভিন্ন রীতির
প্রয়োগ শুধু সরকারি অফিস-আদালতে সীমাবদ্ধ না রেখে এমন ব্যবস্থা নেয়া উচিত, যাতে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও প্রমিত বানানরীতি অনুসরণে আগ্রহী
হয়ে ওঠে। সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে
পারে।
mujibur29@gmail.com
No comments:
Post a Comment