Sunday, November 25, 2012

শিশুটির মানসিক ক্ষতি পূরণ করবে কে?



নভেম্বর ২৫, ২০১২, রবিবার : অগ্রহায়ণ ১১, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
 শিশুটির মানসিক ক্ষতি পূরণ করবে কে?
মোঃ মু জি বু র র হ মা ন
মাত্র ছয় বছরের ছোট্ট শিশু পরাগ আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতার যে নির্মম শিকার হয়েছে, তার প্রতিকার করবে কে? কে পরাগের মানসিক ক্ষতি পূরণ করবে? আদৌ কি পরাগের মানসিক ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হবে? পরাগের নিরাপত্তা রক্ষায় আমাদের ব্যর্থতার দায়ভার কেন পরাগকে বহন করতে হবে? আমরা বেশ বুঝতে পারছি, পরাগের অপহরণের ফলে সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে তাকে উদ্ধারের মধ্য দিয়েও শেষ হয়ে যায়নি শিশু অপহরণের আতংক। আজ শুধু পরাগ নয়, পরাগের মতো আরও বহু শিশুর অভিভাবকের মনে এক অজানা উদ্বেগ দানা বেঁধে আছে। অভিভাবকরা শিশু সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। কখন যে কার জীবনে নেমে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়, তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। পরাগের অপহরণ ঘটনা বিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও আসলে এটি আমাদের সমাজের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের এক জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশে নানাভাবে শিশুদের মানসিক নির্যাতন করা নতুন কোন ঘটনা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শিশু অপহরণ। দেশের নানা স্থানে প্রায়ই শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, অনেক সময় দাবি মতো টাকা না পেলে তাদের মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটছে। পারিবারিক শত্রুতা কিংবা অন্য কোন কারণে প্রতিশোধপরায়ণ হয়েও শিশুদের অপহরণ করা হয়। অনেকের মনে প্রশ্ন, পরাগের মতো আর কোন শিশুকে যাতে অপহরণের শিকার হতে না হয় সেজন্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে কি? কী দোষ ছিল নিষ্পাপ পরাগের? কেন তার জন্য এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হল? তার বাবার প্রচুর ধন-সম্পদই কি তাকে অপহরণের একমাত্র কারণ? নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোন উদ্দেশ্য? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে শিশুসহ সবার নিরাপত্তার স্বার্থেই।
রাজধানী ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে শিশু পরাগ মণ্ডল অপহরণের ঘটনা সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ঘটনাটিতে আমাদের নাগরিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের রূঢ় চিত্র প্রকাশ পেয়েছে স্পষ্টভাবে। এখন বলা যায়, আমাদের সমাজে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে তা অনেকের মধ্যে লোভ সৃষ্টি করে চলেছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে শিক্ষিত করতে পারলেও সুশিক্ষিত করতে পারছে না বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ন্যায়-নীতি যেন আজ এক বিসর্জিত ব্যাপার। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে শুধু বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার সীমাহীন প্রতিযোগিতা দেখা যায়। কীভাবে অল্প সময়ে বিনা পুঁজিতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানো যায়, কীভাবে সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করা যায় সে চেষ্টাই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পড়ালেখা করে সাধারণ মানুষের মতো সাদাসিধে জীবনযাপন করার কোন মানসিকতা এখন দেখা যায় না বললেই চলে। অনেককেই আজ যেন পেয়ে বসেছে বড়লোক হওয়ার চরম উন্মাদনায়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের চারপাশের অনেক মানুষ কেমন যেন বাইরে একরকম আচরণ করে, আর ভেতরে ভেতরে অন্য রকম। অধিকাংশই মনের মধ্যে পুষিয়ে রাখছে ধনী হওয়ার প্রবল বাসনা। ধনী হওয়া খারাপ কিছু নয়। কিন্তু ধনী হওয়া উচিত ন্যায় ও সত্যের পথে থেকে। পরিশ্রম করে, বুদ্ধি খাঁটিয়ে ধনী হলে কারও কিছু বলার থাকে না। অথচ দেখা যায়, নানা বাঁকা পথে হেঁটে বড়লোক হওয়ার জন্য অনেকেই আজ বড় বেশি উদগ্রীব। সত্য বলতে যা আছে, আমাদের সমাজ থেকে তা যেন একরকম উধাও হওয়ার পথে। আজকাল যে যত বেশি মিথ্যা বলতে পারে এবং যে নানাভাবে কথা যত ঘুরিয়ে বলতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে যে যত বেশি প্রলোভনের দুর্ভেদ্য (?) বলয়, আমরা সমাজের অনেক মানুষ তাকেই তত বেশি সমীহ করে চলি, তাকে বাহবা দিই, প্রশংসা করি কখনও কখনও। এখন যেন সমাজব্যবস্থায় জেঁকে বাসা বেঁধেছে অসত্য আর অন্যায়। ভালো মানুষ আর ভালো কথার কদর এখন কেউ করতে চায় না সহজে। তাহলে শিক্ষার শক্তি থাকল কোথায়?
ফিরে আসি পরাগ অপহরণ ঘটনায়। একটি শিশুর জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ব্যক্তি হল তার মা, আর নিরাপদ স্থান মায়ের কোল। শিশু পরাগ তার মায়ের সঙ্গে রওনা দিয়েছিল স্কুলের পথে। সে পথে থামিয়ে দেয়া হল তার স্কুলে যাওয়া, তাকে ছিনিয়ে নেয়া হল আপনজনদের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করা হল আরও কয়েকজনকে। এখন দেখা যায়, সবচেয়ে নিরাপদ স্থানেও শিশু নিরাপদ নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরাগ অপহরণের ঘটনাটি আমাদের সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে, আমরা এখনও জিম্মি হয়ে আছি অল্পসংখ্যক মানুষের লোভ-প্রবৃত্তির কাছে। যে ছোট্ট শিশুটিকে পথে ছেড়ে দিলে ঠিকমতো বাড়ি চিনে একা একা ফিরে আসতে পারবে না, সে শিশুটিকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হল! গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, পরাগকে অপহরণের আগে তার পরিবারের গতিবিধির ওপর নজর রাখা এবং সব তথ্য জানিয়ে দেয়ার জন্য নিয়োজিত করা হয়েছিল অন্য একজনকে; যে কি-না স্বীকার করেছে টাকার লোভে পড়ে সে ওই কাজ করেছে। পরাগ অপহরণ ঘটনার পেছনে এখন আরও অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে। ঘটনার পেছনে উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, একটি ছোট্ট শিশুকে অপহরণ করা গুরুতর অপরাধ। আমরা বলব, এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত।
পরাগ উদ্ধারের পর এখন অনেকেই আত্মপ্রসাদ লাভ করছি এই বলে যে, শিশু পরাগের ভাগ্য ভালো (?)শেষ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় ফিরে পাওয়া গেছে তাকে! প্রশ্ন থেকে যায়, আধুনিক সভ্য যুগে এটাই কি হওয়া উচিত ছিল? যারা শিশু পরাগ অপহরণের সঙ্গে জড়িত তাদের কি পরাগের মতো কোন আপনজন নেই? তাদের কি নেই শিশুসন্তান? কেন একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে নিস্তেজ করে দেয়া হয়েছিল? এটা কি শুধুই টাকার জন্য? মানুষের জীবনে টাকার কি এতই প্রয়োজন? মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগের ফলে শিশুটি তো মারাও যেতে পারত। এখন পরাগের চিকিৎসার জন্য তাকে ইনজেকশন দিতে গেলে সে ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বোঝা যায়, তার বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার এখনও উন্নতি হয়নি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা শিশু পরাগের ঘুম জড়ানো ঢুলু ঢুলু চোখ আর অবসন্ন দেহের ছবি পত্রিকার পাতায় দেখে কার না মন কেঁদে ওঠে? অপহরণকারীরা কি বুঝতে অক্ষম যে তাদের কারণে কী ভয়াবহভাবে শিশু পরাগের মানসিক ক্ষতি হয়েছে? তার এ ক্ষতি পূরণ করা যাবে কি কখনও? রাষ্ট্র কি পারবে পরাগের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে? আমরা জানি, এটা আর সম্ভব নয়। তবে স্বস্তি পাব যদি ভবিষ্যতে আর কোন শিশুকে পরাগের মতো অপহরণের শিকার হতে না হয়।
এরই মধ্যে শিশু পরাগ ফিরে এসেছে তাদের বাড়িতে। প্রশ্ন থেকে যায়, পরাগ কি তার মায়ের কোলে থেকেও আর আগের মতো নিরাপদ বোধ করবে? এ দিকটি নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে। তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবতে হবে। একই সঙ্গে আমরা চাই, সমাজের সব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। কারণ প্রতিটি শিশু শুধু তার পরিবারের একার নয়, পুরো রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ। কাজেই শিশুসহ সবার জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সমাজের প্রত্যেক মানুষকে হতে হবে সচেতন। অপরাধীদের বিষয়েও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। মনে রাখতে হবে, অপরাধীদেরও বসবাস এ সমাজেই। যারা বিপথগামী এবং যাদের বিচরণ অপরাধ জগতে, তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে সঠিক পথে; দেখাতে হবে আলোর পথ।
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com

Saturday, November 24, 2012

কেন পড়ালেখার খরচ বাড়ানো?



ঢাকা, শনিবার, নভেম্বর ২৪, ২০১২, অগ্রহায়ন ১০, ১৪১৯
 উপ-সম্পাদকীয়
কেন পড়ালেখার খরচ বাড়ানো?
 মো. মুজিবুর রহমান
এমনিতেই আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ হারে ভর্তি ফিসহ নানা খাতে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছে। তার পরও যদি আবারও বিদ্যালয় ভর্তিসহ অন্যান্য খাতে টাকা বাড়ানো হয়, তাহলে এর চাপ পড়বে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের অভিভাবকদের ওপর। অবাক ব্যাপার, একটি এক পাতার ভর্তি ফরমের দাম সরকার নির্ধারণ করেছে ১০০ টাকা; অথচ অনেক বিদ্যালয়ে তা বিক্রি করছে কয়েক গুণ বেশি দামে। শুধু তাই নয়, আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফরমের দাম বাড়ানোর জন্য ঢাকার কয়েকটি স্কুল এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। যেসব স্কুল ভর্তি ফরমের দাম বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে, তারা আবেদন করেই বসে থাকেনি; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগও করছে বলে খবর রয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রবণতা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও হয়তো ভর্তি ফরমের মূল্য বাড়ানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে এক সময়। তবে আশার কথা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থী ভর্তি খাতে এবার কোনো টাকা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
ভর্তি ফরমের দাম বাড়ানোর জন্য যেসব স্কুলের কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে এবং যেসব স্কুল আবেদন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সেসবের কয়েকটির বিরুদ্ধে বিগত দিনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। এমনও খবর রয়েছে, এসব স্কুলকে আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের বেতনের সঙ্গে সমন্বয় অথবা ফেরত দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিলেও কয়েকটি স্কুল এ নির্দেশ উপেক্ষা করে চলেছে। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলগুলোকে আবার ১৫ দিনের সময় দিয়েছে আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ শিক্ষার্থীদের ফেরত অথবা বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ কতটুকু প্রতিপালন করা হবে, এটিই এখন দেখার বিষয়।
২০১৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য নীতিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১১ নভেম্বর একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে স্কুলে সংসদ সদস্যদের জন্য দুই শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। কোটা সংরক্ষণ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এটি নিয়ে এরই মধ্যে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও করা হয়েছে। তবে বিষয়টি শুধু আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় মহামান্য হাইকোর্ট রিটটি মুলতবি করে দিয়েছেন। সংসদ সদস্যদের জন্য স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তিতে কোটা সংরক্ষণ করা হলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে কি না, এটি নিয়েও কর্তৃপক্ষ চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের জন্য কোটা সংরক্ষণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবরও প্রকাশিত হয়েছে ১৩ নভেম্বর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এরপর প্রক্রিয়াটি বাতিল করেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এসময় অনেক জল ঘোলা করা হয়েছে।
কোটা সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা বলব, স্কুল পরিচালনা কমিটিসহ সবার গুরুত্ব দেয়া উচিত কীভাবে এগুলোকে আরও ভালো ও উন্নত স্কুলে পরিণত করা যায় সেদিকে। দেখা যায়, আমাদের দেশের সব স্কুলই সমানভাবে ভালো নয় এবং সব স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবক আকর্ষণ ক্ষমতা সমান নয়। যেসব স্কুল পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে, সেসব স্কুলের প্রতিই শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ থাকে বেশি। এ কারণে ভালো স্কুলে ভর্তির চাপ বেশি এবং যেখানে ভর্তির চাপ বেশি থাকে সেখানে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী ভর্তির প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এসব অনিয়মের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিসহ অনেক শিক্ষকও জড়িয়ে পড়েন কখনো কখনো। শুধু তাই নয়, ভর্তির সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থের সংশ্লিষ্টতা থাকা এবং ভর্তিতে ব্যাপক প্রতিযোগিতার কারণে স্কুল পরিচালনা কমিটির অনেক সদস্যও এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হন বলে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হয়। এ ধরনের অসুস্থ প্রবণতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা কোনোটারই স্বাভাবিক বিকাশে সহায়ক নয়। বরং অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবে, তাদের বেশির ভাগ পড়ালেখা শেষ করে ভবিষ্যতে নিজেরা দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে পড়বে এতে সন্দেহ নেই। এটি মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা, একবার দুর্নীতির মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে গেলে পরে একইভাবে আরও একাধিক সুবিধা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে।
স্কুলে ভর্তিসহ অন্যান্য ফি বাড়ানো হলে পড়ালেখার খরচ বেড়ে যাবে এ দিকটি কর্তৃপক্ষকে বিবেচনা করতে হবে। দেখা যায়, একদিকে সরকার বিনা মূল্যে কোটি কোটি টাকার বই বিতরণ করছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে, অন্যদিকে স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থকে নানা খাতে আদায় করছে বাড়তি অর্থ। স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ আদায় করলে শিক্ষার্থীরা সরকারের বিনা মূল্যে বই বিতরণের সুফল পেল কোথায়? একটি সরকারি স্কুলে অর্থ আদায়ের রসিদ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২০টিরও বেশি খাতে  টাকা নেয়া হচ্ছে। কেন ২০টিরও বেশি খাতে অর্থ আদায় করা হচ্ছে সে বিষয়টি কি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই? যেসব খাতে স্কুলগুলো অর্থ আদায় করে সেসব কতটুকু নিয়মসম্মত তা কি খুঁজে দেখার দরকার পড়ে না? বিভিন্ন স্কুলে নিয়মিত অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হলেও সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ কি অনুসন্ধান করে দেখছে প্রতি মাসে আদায় করা বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে খরচ হয়?
শিক্ষার্থীর কাছ থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোন খাতে কী পরিমাণ অর্থ আদায় করতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করে দেয়া জরুরি। আঞ্চলিক ভিত্তিতে এসব খাতে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে, তবে খাতভিত্তিক ব্যাপক পার্থক্য কাম্য নয়। স্কুলগুলোর মধ্যে অর্থ আদায়ে যাতে একটি সাধারণ সমতা বজায় থাকে, সে জন্যই খাতগুলো নির্দিষ্ট করে দেয়া দরকার। শিক্ষার্থী ভর্তি খাতে টাকা বাড়ানোর বিষয়টি প্রতি পাঁচ বছর পর পর বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে সরকার নির্ধারিত টাকার বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে না পারে, সে জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মানুযায়ী আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আরও মানসম্পন্ন ও উন্নত হতে বেশি সময় লাগবে না।
লেখক: টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com