Friday, August 17, 2012

রাজধানীকে বাসযোগ্য করতে সদিচ্ছা জরুরি



(সম্পাদকীয়)
ঢাকা, শুক্রবার, আগস্ট ১৭, ২০১২, শ্রাবণ ৩০, ১৪১৯

রাজধানীকে বাসযোগ্য করতে সদিচ্ছা জরুরি
মো. মুজিবুর রহমান
খবরটি আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। একদিক থেকে চরম হতাশার,অন্যদিকে বিপজ্জনকও বটে। ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০১২ সালের জরিপ প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে আমাদের জন্য হতাশাজনক এ তথ্য। বিশ্বের ১৪০টি শহরের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখানো হয়েছে, বসবাসের উপযোগিতার দিক থেকে ঢাকার অবস্থান সবার নিচে। অর্থাৎ বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকা সবার শীর্ষে। শহরের স্থিতিশীলতা, নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুবিধা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাসহ ৩০টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এ জরিপ। এতে ১০০-এর ভেতরে ঢাকার স্কোর হয়েছে ৩৮ দশমিক ৭ এবং মেলবোর্নের স্কোর হয়েছে ৯৭ দশমিক ৫এ জন্যই বসবাসের সবচেয়ে উপযোগী শহরের শীর্ষে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। এটি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের জন্য সুখের খবর। আমাদের জন্য তা হতাশার খবর এ কারণে যে, গত বছরের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৯তম। এবার ঢাকার অবস্থান আরও একধাপ নিচে নেমে গেছে। গেল বছর অযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে ছিল জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। যদিও এ ধরনের জরিপে এক-দুই ধাপ আগে-পিছে হওয়ার মধ্যে তেমন গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। তার পরও বলা যায়, হারারে নিশ্চয়ই গতবারের অবস্থান থেকে বের হয়ে আসার জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে,যার ফলে এবার দেশটি অন্তত খারাপের দিক থেকে শীর্ষ হওয়ার দুর্নাম ঘোচাতে সক্ষম হয়েছেঅথচ আমরা তিলোত্তমা ঢাকার কথা শুনেছি বহুবার। ঢাকাকে আধুনিক শহরে পরিণত করার নানা ব্যয়বহুল পরিকল্পনার কথাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু ঢাকা বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠছে না কিছুতেই।
প্রশ্ন ওঠে,বসবাসের যোগ্য শহরের পরিণত হতে না পারলেও ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কি আমাদের মধ্যে কম দেখা যায়? মোটেই না। বরং এখন ঢাকার জমির দাম অনুমান করি,পৃথিবীর অনেক বড় বড় ও দামি শহরের মাটির তুলনায় অনেক বেশি। ঢাকা যাওয়ার জন্য আমাদের মধ্যে এক ধরনের তীব্র প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। অনেকেই পৈতৃক ভিটাবাড়ি,সহায়-সম্বল বিক্রি করে ঢাকায় প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালান। কী কারণে এমন প্রবণতা, তা গবেষণার বিষয় হলেও মূল কারণটি অনেকের অজানা নয়। দেখা যায়, পড়ালেখার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ঢাকা শহরেই বেশি বিদ্যমান; ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থাও ঢাকায়ই বেশি। সরকারের সব প্রশাসনিক কাজ তো ঢাকা থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি গার্মেন্ট ব্যবসাও ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। শুধু শেয়ার মার্কেটে টাকা খাটানোর জন্যও অনেকে ঢাকার মেসে থাকছেন বছরের পর বছর। নানা উপলক্ষে, প্রয়োজনে জনস্রোত এখন ঢাকামুখী। ঢাকা শহরে গড়ে উঠেছে অনেক বস্তি। এখানে যারা বসবাস করেন তারাও জানেন, ঢাকায় থাকলে দু-চার পয়সা উপার্জন করা যায়। তবে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন কি ঢাকায় সম্ভব?
আমরা যদি শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার দিকটি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে, শুধু শিক্ষাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় গড়ে উঠেছে বহুমুখী প্রতিষ্ঠান। কিছুতেই ঢাকার বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না এগুলো। এমনকি যারা বিভিন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন, তারাও নানা অজুহাতে ঢাকায় বসবাস করছেন এক নাগাড়ে বহু বছর। তাদের অনেকেই সরকারের নিয়ম রক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর ঢাকা শহরের এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলি হয়ে কাটাচ্ছেন চাকরির পুরো সময়। এভাবেই ঢাকায় থেকে যাচ্ছেন অনেকে। আবার সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকেই চাকরি শুরু করেছেন ঢাকায় এবং ঢাকায়ই তা শেষ করেছেন। বেসরকারি চাকরির বাজারও ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে আছে। মোট কথা,ঢাকার আকর্ষণ ছাড়তে পারছেন না বেশির ভাগ মানুষ
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণার কথা বাদ দিলেও প্রশ্ন থেকে যায়, ঢাকায় বসবাস করা কি আদৌ সম্ভব? যারা ঢাকায় থাকেন, তারা হয়তো এ প্রশ্নের জবাবে বলবেন, সম্ভব না হলে ঢাকা এখন মেগা সিটিতে পরিণত হলো কী করে? তবে শুধু ঢাকায় যারা বসবাস করেন তারাই নন; বরং দেশের সাধারণ মানুষও জানেন, ঢাকা এখন কার্যত যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। শুধু ঢাকার যানজট নিয়েই দেশের গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন নানা প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে। ঢাকায় যানজট নিরসনের কত পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনার কথাই না আমরা শুনেছি। মনোরেল, মেট্রো রেলের বিষয়টিও পরিকল্পনায় উঠে এসেছে। কিন্তু কোনোটিই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারছে না। এ ছাড়া যানজট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগ থেকে যেসব দৈনন্দিন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, সেগুলোও তেমন কাজে আসছে না। শুধু যানজটে পড়ে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে বহু কর্মঘণ্টা,পুড়ছে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি, বিষাক্ত হচ্ছে ঢাকার বাতাস। ঢাকার বাতাসে এখন সিসার পরিমাণ বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে, যা মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্বিষহ যানজটের কবলে পড়ে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, শিশুসহ সব বয়সের মানুষ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগছেনএক কথায়, ঢাকার সবাই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে।
নিরাপত্তার দিকটি আলোচনা করলে দেখা যায়, ঢাকা এখন দেশের অন্য শহরের তুলনায় বেশি অনিরাপদ শহরে পরিণত হয়েছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন প্রভৃতি ঢাকা শহরেই বেশি ঘটতে দেখা যায়। এক কথায়, যত ধরনের সামাজিক সমস্যা রয়েছে, তার সবই ঢাকায় ঘটে বলে পত্রপত্রিকায় প্রায়ই খবর প্রকাশ হয়। বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে যতটা পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল,বাস্তবে ঢাকা তেমনটি নয়। পানি, গ্যাস ও বিদ্যুত্সংকটের মধ্যে দিন কাটাতে হয় ঢাকাবাসীকে। তার পরও ঢাকা ছাড়তে নারাজ অনেকেই।
ঢাকা শহরে যেভাবে অপরিকল্পিত আবাসনব্যবস্থা গড়ে উঠছে,তাতে ঢাকা আর বসবাসের উপযোগী হতে পারবে কি না, এমন সন্দেহ থেকেই যায়। দেশে প্রতিদিন বাড়ছে মানুষ, একই সঙ্গে ঢাকায়ও বাড়ছে বসবাসকারীর সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি ও যানবাহনের সংখ্যাও। অথচ বাড়ছে না ঢাকা শহরের জমির পরিমাণ। যদিও ঢাকা এখন বিস্তৃত হতে হতে অনেক বড় হয়ে গেছে। তার পরও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা এখন প্রাকৃতিকভাবেও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার মধ্যে পড়েছে। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ গাছপালা ও বন থাকার প্রয়োজন ছিল, তার সিকি ভাগও নেই। প্রাচীন ঢাকায় যেসব খাল ছিল, আশপাশে যেসব নদী ছিল, সেগুলো এখন অস্তিত্বহীন। নদী ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে অনেক অবৈধ বহুতল ভবন, খাল ভরাট করা হচ্ছে বর্জ্য দিয়ে। শহরের ড্রেনগুলো তো মানুষ নিজেরাই ময়লা-আবর্জনা দিয়ে মেরে ফেলছে ধীরে ধীরে। অবাক বিষয়, অনেকেই ময়লা-আবর্জনা নিজের হাতে ড্রেনে ফেলে দেন। ফলে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে বর্ষাকালে বেশি পানি প্রবাহ করতে পারে না। অনেক রাস্তার পাশে তো ড্রেনই নেই। যেসব এলাকায় ড্রেন রয়েছে,সেখানে নির্মাণসামগ্রী ফেলে ড্রেন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি নাগরিকদের দায়িত্বও কম নয়। মোট কথা, ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি নাগরিক দায়িত্ববোধও বাড়াতে হবে। নিজেদের শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রতিটি নাগরিক কী করতে পারেন, তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে এ নিবন্ধ শেষ করব।
আমি তখন নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরে অবস্থান করছিলাম। একদিন ভ্রমণের উদ্দেশে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে নিউজিল্যান্ডের ওয়েস্টকোস্ট যাচ্ছিলাম। সঙ্গে গাইড হিসেবে ছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব এক নারী। নাম ক্রিস সুলিভানআমাদের কোচ চালাচ্ছিলেন নারীর স্বামী জেরম। যাত্রা করে ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর নাশতা খাওয়ার জন্য মহাসড়কের পাশে পর্বতের কোলে একটু সমতল স্থানে গাড়ি থেমে গেল। আমরা গাড়ি থেকে নেমে সবার সঙ্গে থাকা পাউরুটি, ডিম, কলা, জুস খেয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। কিন্তু গাড়ি তো ছাড়ছে না। দেখলাম ক্রিস নেই, ড্রাইভারও নেই। কয়েক মিনিট পর দেখলাম, ক্রিস একটি বড় পলিথিনের ভেতরে কী যেন নিয়ে গাড়িতে উঠছে। তার দেরি করার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, নাশতা খাওয়ার পর আমাদের ফেলে দেয়া পাউরুটির প্যাকেট, ডিম ও কলার খোসা, জুস এবং পানির খালি বোতল ক্রিস কুড়িয়ে পলিথিনে ভরে এনেছে। তার স্বামী ড্রাইভার জেরম পাউরুটির কয়েকটি প্যাকেট প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে এনে পরে পলিথিনে রেখেছে। আমরা এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় জেরম বলল, Keep New Zealand Clean. পরে দেখলাম, এক হোটেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে কুড়িয়ে নেয়া ময়লাভর্তি পলিথিন ডাস্টবিনে রেখে এসেছে ক্রিস। শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখার জন্য শুধু এই একটি উদাহরণই নয়। অন্য একদিন নিউজিল্যান্ডের লিটলটন শহরে যাওয়ার পথে দেখলাম, বিশাল এক জলাধার। অনেকটা আমাদের দেশের বিলের মতো। সেখানে পানি জমে আছে। ক্রিসকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, এটি পানি শোধনাগার। শহরের সব ময়লা পানি ড্রেনেজ সিস্টেমের মাধ্যমে এ শোধনাগারে এসে পড়েছে। ময়লা পানি ড্রেন দিয়ে এসে প্রথমে এ শোধনাগারে জমা হয়। তারপর কৃত্রিম উপায়ে পানি শোধন করে সাগরে ছেড়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ তারা ময়লা পানিও সাগরে না ফেলে শোধন করার ব্যবস্থা করেছে। আর আমরা কি করছি?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment