Saturday, December 22, 2012

পারিবারিক বন্ধনহীন সমাজব্যবস্থাই আসলে দায়ী



ঢাকা, শনিবার , ডিসেম্বর ২২, ২০১২, পৌষ , ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
সাম্প্রতিক
পারিবারিক বন্ধনহীন সমাজব্যবস্থাই আসলে দায়ী
মো. মুজিবুর রহমান
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত স্যান্ডি হুক এলিমেন্টরি স্কুলে ২০ বছর বয়সী এক বন্দুকধারীর গুলিতে ওই স্কুলের ২০ শিশুশিক্ষার্থীসহ ২৮ জন নির্মমভাবে নিহত হন। নিউটাউনের ওই স্কুলে গুলি করে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অ্যাডাম লানজা নামক এক কিশোর অতর্কিতে গুলি ভর্তি বন্দুক নিয়ে স্কুলে ঢুকে গুলি চালানো শুরু করেন। তার গুলিতে ২০ জন শিশুশিক্ষার্থী মারা যায়। তার হাত থেকে স্কুলের অধ্যক্ষও রেহাই পাননি। তবে বেঁচে গেছে ওই স্কুলের বাংলাদেশী ছাত্র মামনুন। স্কুলে হামলার আগে ওই বন্দুকধারী বাড়িতে তার মাকেও গুলি করে হত্যা করে।
বন্দুক নিয়ে হঠাৎ স্কুলে উপস্থিত হয়ে অনেক শিক্ষার্থী হত্যার এ ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে রোমহর্ষক ও ভয়াবহ। এটি দ্বিতীয় ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হূদয়ে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শোকে বিহ্বল হয়ে টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেছেন, আমাদের হূদয় ভেঙে গেছে। এসব শিশুর বাবা-মা, বোন, স্বজন সবার জন্য আমার মন আজ ব্যথিত। ঘটনার পর সারা দেশে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুকধারীর অতর্কিতে আক্রমণের ফলে বহু শিক্ষার্থীর মৃত্যুবরণ এই প্রথম নয়; এর আগে ১৯৬৬ সালে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৬ জনকে হত্যা করা হয়। অন্য একবার কলোরাডোর ভার্জিনিয়া কলম্বাইন হাইস্কুলের দুই ছাত্র ১৫ জন ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে। মাত্র কয়েক বছর আগে ২০০৭ সালে ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটিতে এক বন্দুকধারী আকস্মিকভাবে হামলা চালিয়ে ৩২ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করে। শুধু এ বছরই আগ্নেয়াস্ত্রের হামলার অন্তত ১৬টি ঘটনা ঘটেছে। গত এপ্রিলে ওকল্যান্ডে একটি কলেজে বন্দুকধারীর গুলিতে মারা যান সাতজন। সিয়াটলের এক কফির দোকানে মে মাসে গুলিতে মৃত্যুবরণ কারণে আরও পাঁচজন। জুলাইয়ে একটি সিনেমা হলে গুলিতে মারা যান ১২ জন। ওই ঘটনায় আহত হন আরও ৫৮ জন। এরপর আগস্টে উইসকনসিনে গুলিতে নিহত হন সাতজন। পরবর্তী মাসে মিনেসোটায় এক কর্মস্থলে সাবেক কর্মীর গুলিতে নিহত হন পাঁচজন। এ রকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলো অত্যন্ত হূদয়বিদারক।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে বন্দুকধারীদের ঘন ঘন হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সবার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কেন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করে শিক্ষার্থীদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়? হত্যাকারীদের অনেকেই কিশোর-তরুণ। কেন তারা ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালায়? যুক্তরাষ্ট্র তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? এসব ঘটনা কি শুধু আগ্নেয়াস্ত্র আইনের শিথিলতার কারণে ঘটছে? নাকি এর পেছনে রয়েছে পারিবারিক অস্থিরতা অথবা অতিমাত্রায় ভোগবিলাসী জীবনের নেতিবাচক প্রভাব? কানেকটিকাটের স্কুলে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সমাজবিজ্ঞানীরা হয়তো ঘটনার পেছনের মূল কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। একসময় হয়তো আমরাও জানতে পারব এ হূদয়বিদারক ঘটনার পেছনে প্রকৃত কারণ কী। কিন্তু তার আগে এসব ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যেসব বিশ্লেষণ চলছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা দরকার আমাদের সবার স্বার্থেই।
কানেকটিকাটের নিউটাউনের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টরি স্কুলে এডাম লানজা কেন হামলা চালাল তা এখনো বিস্তারিত জানা না গেলেও, আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অবাধ চলাফেরায় তেমন বিধিনিষেধ না থাকাকে একটি কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করছেন। সারা দুনিয়ায় আলোচিত এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্র আইন পর্যালোচনার দাবি উঠেছে সে দেশেরই বিভিন্ন মহল থেকে। সে দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা এবং তা বহনের অবাধ অধিকার থাকায় অনেকে প্রকাশ্যেই গুলি ভর্তি রাইফেল নিয়ে চলাফেরা করে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। পারিবারিকভাবে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি অনেক সময় অপ্রাপ্ত বয়স্কদের হাতে চলে যায়। ফলে সাময়িক উত্তেজনাবশত অনেকেই আগ্নেয়াস্ত্রের বিপজ্জনক ব্যবহার করে। বাস্তবে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই অসহায় বলে ধারণা করা যায়। কারণ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যত বিভক্ত হয়ে আছে। নিউইয়র্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ স্পষ্টতই বলেছেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসলে এ বিষয়ে বলিষ্ঠ অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। কানেকটিকাটের সাবেক সিনেটর ক্রিস ডড বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্র আইন আদৌ ভারসাম্যপূর্ণ কি না, সে প্রশ্ন তোলার এখনই সময়। এসব মন্তব্য পর্যালোচনা করে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে যতই উদ্বেগ থাকুক না কেন; যেখানে প্রতিদিন বহু মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ দখল এবং বহন কতটা নিরাপদ ও যুক্তিসঙ্গত তা বিবেচনা করতে হবে আমেরিকানদেরই।
কানেকটিকাটের স্কুলে নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আমেরিকান পরিবারের কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে বেশির ভাগ পরিবারই ভঙ্গুর। তাদের অধিকাংশের পারিবারিক জীবন বলতে তেমন কিছুই নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব সামান্য কারণে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। দেখা যায়, সে দেশে নারী-পুরুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কিছুকাল পর পৃথকভাবে বসবাস করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক পুরুষ স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে অন্য নারীর সঙ্গে সংসার শুরু করে। একইভাবে অনেক নারীও স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর নতুন করে ঘর বাঁধে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবারগুলোর মধ্যে খুব কমসংখ্যকই স্থায়িত্ব লাভ করে। এ অবস্থায় পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুরা যখন দেখে, তাদের পিতা-মাতার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় কিংবা পিতা বা মাতা অথবা দুজনই অন্য নারী-পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে, তখন তারা খুব অসহায় হয়ে পড়ে; ভেঙে পড়ে মানসিকভাবে। এ পরিস্থিতি শিশুদের মধ্যে প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি করে, যা আমেরিকার নাগরিকরা সহজে বুঝতে পারেন কি না এমন সন্দেহ থেকে যায়। এডাম লানজার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সে অনেকটা মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দিন পার করছিল বলে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বলছে। সে একটা ভঙ্গুর পরিবারের সদস্য হওয়ায় তার পারিবারিক বন্ধন ছিল না; পরিবারে তার ছিল না সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান। তার পিতা-মাতার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ২০০৮ সালে। যদিও তার স্কুলশিক্ষিকা মা তাকে পরম স্নেহমমতা ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করার চেষ্টা করেছেন। তবু এডাম পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল। এডাম হয়তো কোনো কারণে তার মায়ের ওপরও বিরক্ত ছিল, রেগে গিয়েছিল প্রচণ্ডভাবে। যে কারণে সে তার মাকেই হত্যা করেছে আগে। তার আপন বড় ভাইয়ের সঙ্গে ২০১০ সাল থেকে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে সে একাকিত্বে ভুগত সারাক্ষণ। সন্দেহ নেই, সে মানসিকভাবে অনেকটাই বিধ্বস্ত ছিল। এসব কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা তার পক্ষে অস্বাভাবিক ও অসম্ভব কিছু নয়।
অন্যদিকে দেখা যায়, আমেরিকান সমাজব্যবস্থা অনেকটাই ভোগবাদী বৈশিষ্ট্যসংবলিত। সেখানে রয়েছে ধন-সম্পদের প্রাচুর্যতা, নানা ধরনের ভোগসামগ্রীর সহজলভ্যতা, উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিলাসী জীবন অতিবাহিত করার সুযোগ, পারিবারিক বন্ধনহীন তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষের যথেচ্ছ অবাধ বিচরণ, বাধাহীন ব্যক্তিস্বাধীনতার কারণে অনেক নাগরিকের নিয়মনীতিবহির্ভূতভাবে জীবন অতিবাহিত করার প্রয়াস। এ ছাড়া জীবনসংগ্রামে নাগরিকদের ব্যস্ততার কারণে পরিবারের সদস্যদের প্রতি পিতা-মাতা-অভিভাবকদের সময় কম দেয়ার প্রবণতা পরিবার থেকে শিশুদের অনেকখানি বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এসব কারণে আমেরিকান শিশুরা ছোটবেলা থেকেই নিজের সম্পর্কে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে ফেলে। এ ছাড়া তাদের অধিকাংশই অল্প বয়সে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ার হারও কম নয়। ফলে অনেক শিশু সেখানে যা ইচ্ছা তা করায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
বলতে দ্বিধা নেই, অধিকাংশ আমেরিকানের জীবনে বিরাজ করে পারিবারিক স্নেহমমতা ও ভালোবাসার প্রচণ্ড শূন্যতা। তাদের অনেকেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে চরম উচ্ছৃঙ্খলভাবে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়। তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এতটাই স্বাধীনতা ভোগ করে যে, রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘন ব্যতীত নিজেদের ভোগবিলাসের জন্য যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। এমনকি তাদের অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতার কাছে রাষ্ট্র কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আমেরিকান নাগরিকরা প্রযুক্তিনির্ভর জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কারণে ব্যক্তির সুষম ও স্বাভাবিক বিকাশে পরিবারের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে চলে। অথচ আমেরিকানদের মনে রাখা দরকার, শিশুর সামাজিক বিকাশে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা অন্য কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হতে পারে না; সম্ভবও নয়। আমেরিকানদের উচিত তাদের স্বার্থেই পারিবারিক বন্ধনকে একটি স্থায়ী রূপ দেয়ার চেষ্টা করা। আমেরিকানদের নিশ্চয়ই জানা আছে, বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন রয়েছে। ফলে এসব দেশে অর্থের প্রাচুর্যতা না থাকতে পারে, ভোগবিলাসের সরঞ্জাম এখানে কম থাকতে পারে; কিন্তু এখানকার পরিবারগুলোর মধ্যে রয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি সুখ ও শান্তি। এখানে রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন, আছে নীতিনৈতিকতার অনুশীলন; সামাজিক মূল্যবোধ এখানে এখনো অনেক উন্নত। এসব কারণে এখানকার পরিবারগুলোও শান্তিপ্রিয়। কাজেই স্থায়ী পারিবারিক কাঠামো নিয়ে আমেরিকানদের ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
লেখক: টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com

Friday, December 21, 2012

সহিংসতা শিশুর মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে




ডিসেম্বর ১৯, ২০১২, বুধবার : পৌষ ৫, ১৪১৯

(বাতায়ন)
সহিংসতা শিশুর মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে

মোঃ মু জি বু র র হ মা ন
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে যদি সব সময় আতংক ও অস্থিরতা বিরাজ করে তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপর। যে কোন অস্থিতিশীল পরিবেশ শিশুর জন্য চরম মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শিশুরা স্বভাবগতভাবে সহজ-সরল এবং সাধারণভাবে বিশ্বাসপ্রবণ বলেই তারা চোখের সামনে যা কিছু দেখে, যা কিছু শোনে তাই সত্য বলে ধরে নেয়। এ কারণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রভাব থেকে তারা কিছুতেই মুক্ত থাকতে পারে না। কোন ঘটনার সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ যাচাই করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে তারা যা দেখে তার প্রতিবিম্ব মনের মধ্যে গেঁথে নেয় অবচেতনভাবে। শিশুরা যদি ভালো কোন দৃশ্য বা আনন্দজনক ঘটনা ঘটতে দেখে, তাহলে সেটি যেমন তাদের মনের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে, তেমনি তারা যদি কোন খারাপ দৃশ্য বা দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেখে তাহলে এর মাধ্যমেও প্রভাবান্বিত হয়। বড়দের অসহনশীল আচরণ এবং সেখান থেকে সৃষ্ট নেতিবাচক ঘটনা শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর ফলে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বহু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা শিশুর মনের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করে তা আমরা শনাক্ত করতে পারি না সহজে, এমনকি শনাক্ত করার চেষ্টাও করি না। এসব নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোন কার্যকর গবেষণাও হয় না বললেই চলে। কী পরিবার, কী স্কুল কোথাও শিশুদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কোন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে শিশুরা একরকম অবহেলা ও অনাদরের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। এভাবে বড় হওয়ার কারণে তারা শিশুকাল থেকেই অন্যের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।

যেসব শিশু সব সময় বড়দের রুক্ষ আচরণ দেখছে, দেখছে হিংস্রতা, উন্মত্ততা আর বাড়াবাড়ি, তারা একদিন বড় হয়ে নিজেরা ঠিক একই ধরনের অসহনশীল আচরণ করবে- এটি স্পষ্টই বোঝা যায়। এ সত্যকে উপেক্ষা করলে আমাদের দিতে হবে চরম মূল্য। বাস্তবে আমরা দিচ্ছিও তা-ই। এখন দেখা যায় পথে-ঘাটে, হাট-বাজারে, স্কুল-কলেজে অনেকে প্রায়ই অসহিষ্ণু আচরণ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তো খোদ শিক্ষকরাই লিপ্ত হয়ে পড়েন হাতাহাতিতে। তরুণ জনগোষ্ঠীও এ ধরনের আচরণের বাইরে থাকে না। তাদের অনেকেই আমাদের চোখের সামনে খুব সহজেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, বিনা কারণে একজন আরেকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে, তুচ্ছ কারণে হয়ে উঠছে মারমুখী, কখনও সংঘবদ্ধভাবে পরস্পর আক্রমণে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। কোথাও কোন সামান্য অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও কেউ কেউ সেলফোনের মাধ্যমে দ্রুত বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে এনে প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখায়, ত্রাস সৃষ্টি করে, এমনকি কখনও কখনও মারধরও করে। এসব কি সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের লক্ষণ নয়? প্রশ্ন থেকে যায়, এভাবে কি আমরা সহনশীল ও উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারব? আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা কি ভেবে দেখবেন, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কী?

মাঝেমধ্যে দেখা যায়, দেশে নানা কারণে সৃষ্ট সংঘাত ও সংঘর্ষের কবলে পড়ে সাধারণ নাগরিকের প্রাণহানি ঘটে। বিবদমান পক্ষগুলোর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কখনও কখনও আহত হয় অনেক মানুষ। অনেক সময় জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে অনেকেই। অসহনশীল আচরণের চরম প্রকাশ ঘটিয়ে চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। ভাংচুর ও জ্বালাও-পোড়াও চলে নির্বিচারে। সহিংস ঘটনায় পড়ে সাধারণ পথচারীদের প্রাণভয়ে আতংকিত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। নিরীহ পথচারীরাও অনেক সময় নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়। রিকশা কিংবা অন্য কোন যানবাহনে চড়ে যাওয়া সাধারণ মানুষকে বলপূর্বক নামিয়ে দেয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালগামী রোগীদেরও নিস্তার থাকে না। সঙ্গে শিশু থাকলেও রেহাই পাওয়া যায় না। পরিস্থিতি এমন হয় যে ভয়ে বড়রাও আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শিশুরা আতংকিত হয় আরও বেশি।

এ ধরনের সংঘাতময় ঘটনা যে বাংলাদেশে নতুন, তা কিন্তু নয়। বরং বহু বছর ধরেই একই ধরনের সহিংস পরিস্থিতি চলে আসছে। নানা কারণে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ভাংচুরের ঘটনা গণমাধ্যমে দেখার পর অনেক শিশু মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। আমরা কি তার খবর রাখি? মারামারি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার কিছু ঘটনা আছে, যা শুধু নাটক-সিনেমায় দেখানো সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবে নাটক-সিনেমার চেয়েও বেশি দুর্ধর্ষ ও লোমহর্ষক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এসব ঘটনার ফলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ মানসিকভাবে চরম যন্ত্রণায় নিপতিত হয়। অনেকের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করা সম্ভব হয় না। সব সময় এক অনিশ্চয়তা ভর করে থাকে মনের মধ্যে। কেউ কেউ হতাশায় ভোগেন। জীবন-জীবিকা নিয়ে আশাহত হন অনেকেই। এসব ঘটনা যখন সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় তখন স্বভাবতই শিশুরাও মনোযোগী শ্রোতা হয়ে যায়। ফলে তারা ছোটবেলা থেকেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে পড়ছে অনিচ্ছাকৃতভাবেই। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া এসব দুঃখজনক ঘটনা থেকে শিশুদের দূরে রাখতে, কিন্তু কিছুতেই যেন তাদের দূরে রাখতে পারছি না। পারছি না তাদের আতংকমুক্ত রাখতে। এটাই আমাদের উদ্বেগের মূল কারণ।

দেশে যে কোন কারণে যতই সংঘাত ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হোক না কেন, এর সব কিছুই যেন বড়দের গা সওয়া হয়ে গেছে আজকাল। যে কোন কর্মসূচিতে, সভা-সমাবেশে, আলোচনা অনুষ্ঠানে হইচই হবে, হাতাহাতি হবে, হবে মারামারি, ঘটবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা- এটি যেন এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন মনে হয়, আমাদের অনেকের মধ্যে সহিষ্ণুতার বড় অভাব দেখা দিয়েছে। এসব অসহিষ্ণু আচরণ ও কার্যকলাপ বড়দের চিন্তা-চেতনায় যে ভূমিকাই রাখুক না কেন, কোমলমতি শিশুদের বেলায় কী প্রভাব রাখে, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা দরকার।

আমাদের দুশ্চিন্তা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। কারণ মানুষ হয়ে মানুষের ওপর উন্মত্তভাবে হামলে পড়ার দৃশ্য গণমাধ্যমে দেখে শিশুরা মানসিকভাবে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত সংঘাত ও সংঘর্ষের ভয়াবহ চিত্র শিশুদের মনে দেশ ও সমাজ সম্পর্কে যে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করছে, তা নিয়ে রাষ্ট্র কতটুকু চিন্তিত এমন প্রশ্নের সৃষ্টি হতেই পারে। বোঝা যায়, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি শিশু বিকাশের অনুকূলে রাখা যাচ্ছে না। শিশুদের নিরাপদভাবে গড়ে তোলার জন্য যে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার, তা যেন কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন। স্কুল-কলেজে যাতায়াত হয়ে উঠছে অনিরাপদ ও বিপদসংকুল। নানা অপ্রীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তাদের পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ব্যাপকভাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পরীক্ষা পেছাতে হচ্ছে বারবার। ফলে পরিবার, সমাজ, স্কুল-কলেজ ও দেশ সম্পর্কে শিশুদের মনে শিশুকাল থেকেই চরম আস্থাহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে বেড়ে ওঠা শিশুরা ভবিষ্যতে নিজেরা আক্রমণাত্মক আচরণ করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ উদ্দেশ্যে সমাজের প্রত্যেক মানুষের থাকতে হবে ইতিবাচক ভূমিকা। অস্বীকার করার উপায় নেই, নানা কারণে সৃষ্ট গোলযোগের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধরনের আতংক বিরাজ করে, তার চেয়েও বেশি আতংক বিরাজ করে শিশুদের মনে; তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপও তৈরি করে। এসব ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের সমাজের ওপর দীর্ঘমেয়াদে, এতে সন্দেহ নেই।

মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com

Sunday, November 25, 2012

শিশুটির মানসিক ক্ষতি পূরণ করবে কে?



নভেম্বর ২৫, ২০১২, রবিবার : অগ্রহায়ণ ১১, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
 শিশুটির মানসিক ক্ষতি পূরণ করবে কে?
মোঃ মু জি বু র র হ মা ন
মাত্র ছয় বছরের ছোট্ট শিশু পরাগ আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতার যে নির্মম শিকার হয়েছে, তার প্রতিকার করবে কে? কে পরাগের মানসিক ক্ষতি পূরণ করবে? আদৌ কি পরাগের মানসিক ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হবে? পরাগের নিরাপত্তা রক্ষায় আমাদের ব্যর্থতার দায়ভার কেন পরাগকে বহন করতে হবে? আমরা বেশ বুঝতে পারছি, পরাগের অপহরণের ফলে সৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে তাকে উদ্ধারের মধ্য দিয়েও শেষ হয়ে যায়নি শিশু অপহরণের আতংক। আজ শুধু পরাগ নয়, পরাগের মতো আরও বহু শিশুর অভিভাবকের মনে এক অজানা উদ্বেগ দানা বেঁধে আছে। অভিভাবকরা শিশু সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। কখন যে কার জীবনে নেমে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়, তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। পরাগের অপহরণ ঘটনা বিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও আসলে এটি আমাদের সমাজের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের এক জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশে নানাভাবে শিশুদের মানসিক নির্যাতন করা নতুন কোন ঘটনা নয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শিশু অপহরণ। দেশের নানা স্থানে প্রায়ই শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, অনেক সময় দাবি মতো টাকা না পেলে তাদের মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটছে। পারিবারিক শত্রুতা কিংবা অন্য কোন কারণে প্রতিশোধপরায়ণ হয়েও শিশুদের অপহরণ করা হয়। অনেকের মনে প্রশ্ন, পরাগের মতো আর কোন শিশুকে যাতে অপহরণের শিকার হতে না হয় সেজন্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে কি? কী দোষ ছিল নিষ্পাপ পরাগের? কেন তার জন্য এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হল? তার বাবার প্রচুর ধন-সম্পদই কি তাকে অপহরণের একমাত্র কারণ? নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোন উদ্দেশ্য? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে শিশুসহ সবার নিরাপত্তার স্বার্থেই।
রাজধানী ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে শিশু পরাগ মণ্ডল অপহরণের ঘটনা সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ঘটনাটিতে আমাদের নাগরিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের রূঢ় চিত্র প্রকাশ পেয়েছে স্পষ্টভাবে। এখন বলা যায়, আমাদের সমাজে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে তা অনেকের মধ্যে লোভ সৃষ্টি করে চলেছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে শিক্ষিত করতে পারলেও সুশিক্ষিত করতে পারছে না বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ন্যায়-নীতি যেন আজ এক বিসর্জিত ব্যাপার। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে শুধু বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার সীমাহীন প্রতিযোগিতা দেখা যায়। কীভাবে অল্প সময়ে বিনা পুঁজিতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানো যায়, কীভাবে সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করা যায় সে চেষ্টাই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পড়ালেখা করে সাধারণ মানুষের মতো সাদাসিধে জীবনযাপন করার কোন মানসিকতা এখন দেখা যায় না বললেই চলে। অনেককেই আজ যেন পেয়ে বসেছে বড়লোক হওয়ার চরম উন্মাদনায়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের চারপাশের অনেক মানুষ কেমন যেন বাইরে একরকম আচরণ করে, আর ভেতরে ভেতরে অন্য রকম। অধিকাংশই মনের মধ্যে পুষিয়ে রাখছে ধনী হওয়ার প্রবল বাসনা। ধনী হওয়া খারাপ কিছু নয়। কিন্তু ধনী হওয়া উচিত ন্যায় ও সত্যের পথে থেকে। পরিশ্রম করে, বুদ্ধি খাঁটিয়ে ধনী হলে কারও কিছু বলার থাকে না। অথচ দেখা যায়, নানা বাঁকা পথে হেঁটে বড়লোক হওয়ার জন্য অনেকেই আজ বড় বেশি উদগ্রীব। সত্য বলতে যা আছে, আমাদের সমাজ থেকে তা যেন একরকম উধাও হওয়ার পথে। আজকাল যে যত বেশি মিথ্যা বলতে পারে এবং যে নানাভাবে কথা যত ঘুরিয়ে বলতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে যে যত বেশি প্রলোভনের দুর্ভেদ্য (?) বলয়, আমরা সমাজের অনেক মানুষ তাকেই তত বেশি সমীহ করে চলি, তাকে বাহবা দিই, প্রশংসা করি কখনও কখনও। এখন যেন সমাজব্যবস্থায় জেঁকে বাসা বেঁধেছে অসত্য আর অন্যায়। ভালো মানুষ আর ভালো কথার কদর এখন কেউ করতে চায় না সহজে। তাহলে শিক্ষার শক্তি থাকল কোথায়?
ফিরে আসি পরাগ অপহরণ ঘটনায়। একটি শিশুর জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ব্যক্তি হল তার মা, আর নিরাপদ স্থান মায়ের কোল। শিশু পরাগ তার মায়ের সঙ্গে রওনা দিয়েছিল স্কুলের পথে। সে পথে থামিয়ে দেয়া হল তার স্কুলে যাওয়া, তাকে ছিনিয়ে নেয়া হল আপনজনদের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করা হল আরও কয়েকজনকে। এখন দেখা যায়, সবচেয়ে নিরাপদ স্থানেও শিশু নিরাপদ নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরাগ অপহরণের ঘটনাটি আমাদের সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে, আমরা এখনও জিম্মি হয়ে আছি অল্পসংখ্যক মানুষের লোভ-প্রবৃত্তির কাছে। যে ছোট্ট শিশুটিকে পথে ছেড়ে দিলে ঠিকমতো বাড়ি চিনে একা একা ফিরে আসতে পারবে না, সে শিশুটিকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হল! গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, পরাগকে অপহরণের আগে তার পরিবারের গতিবিধির ওপর নজর রাখা এবং সব তথ্য জানিয়ে দেয়ার জন্য নিয়োজিত করা হয়েছিল অন্য একজনকে; যে কি-না স্বীকার করেছে টাকার লোভে পড়ে সে ওই কাজ করেছে। পরাগ অপহরণ ঘটনার পেছনে এখন আরও অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে। ঘটনার পেছনে উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, একটি ছোট্ট শিশুকে অপহরণ করা গুরুতর অপরাধ। আমরা বলব, এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত।
পরাগ উদ্ধারের পর এখন অনেকেই আত্মপ্রসাদ লাভ করছি এই বলে যে, শিশু পরাগের ভাগ্য ভালো (?)শেষ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় ফিরে পাওয়া গেছে তাকে! প্রশ্ন থেকে যায়, আধুনিক সভ্য যুগে এটাই কি হওয়া উচিত ছিল? যারা শিশু পরাগ অপহরণের সঙ্গে জড়িত তাদের কি পরাগের মতো কোন আপনজন নেই? তাদের কি নেই শিশুসন্তান? কেন একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে নিস্তেজ করে দেয়া হয়েছিল? এটা কি শুধুই টাকার জন্য? মানুষের জীবনে টাকার কি এতই প্রয়োজন? মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগের ফলে শিশুটি তো মারাও যেতে পারত। এখন পরাগের চিকিৎসার জন্য তাকে ইনজেকশন দিতে গেলে সে ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বোঝা যায়, তার বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার এখনও উন্নতি হয়নি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা শিশু পরাগের ঘুম জড়ানো ঢুলু ঢুলু চোখ আর অবসন্ন দেহের ছবি পত্রিকার পাতায় দেখে কার না মন কেঁদে ওঠে? অপহরণকারীরা কি বুঝতে অক্ষম যে তাদের কারণে কী ভয়াবহভাবে শিশু পরাগের মানসিক ক্ষতি হয়েছে? তার এ ক্ষতি পূরণ করা যাবে কি কখনও? রাষ্ট্র কি পারবে পরাগের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে? আমরা জানি, এটা আর সম্ভব নয়। তবে স্বস্তি পাব যদি ভবিষ্যতে আর কোন শিশুকে পরাগের মতো অপহরণের শিকার হতে না হয়।
এরই মধ্যে শিশু পরাগ ফিরে এসেছে তাদের বাড়িতে। প্রশ্ন থেকে যায়, পরাগ কি তার মায়ের কোলে থেকেও আর আগের মতো নিরাপদ বোধ করবে? এ দিকটি নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে। তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবতে হবে। একই সঙ্গে আমরা চাই, সমাজের সব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। কারণ প্রতিটি শিশু শুধু তার পরিবারের একার নয়, পুরো রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ। কাজেই শিশুসহ সবার জন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সমাজের প্রত্যেক মানুষকে হতে হবে সচেতন। অপরাধীদের বিষয়েও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। মনে রাখতে হবে, অপরাধীদেরও বসবাস এ সমাজেই। যারা বিপথগামী এবং যাদের বিচরণ অপরাধ জগতে, তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে সঠিক পথে; দেখাতে হবে আলোর পথ।
মোঃ মুজিবুর রহমান : টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক
mujibur29@gmail.com