রবিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৬ আশ্বিন ১৪২১, ২৫ জিলকদ ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষা
শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিভাবক সমাবেশ
মোঃ মুজিবুর
রহমান
২১ সেপ্টেম্বর,
২০১৪ ইং
একবার স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের অভিভাবকদের
সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যোগদানের এক বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। বিরল বলছি এ কারণে যে,
আমাদের দেশের
অধিকাংশ স্কুলই শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের নিয়ে কোনো মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে চায়
না। অথচ স্কুলে শিখন-বান্ধব পরিবেশ বজায় রাখা এবং শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার
গুণগতমান উন্নয়নের জন্য তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করা
একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
শিক্ষক প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে আমি বহু স্কুল
পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছি। এখনও মাঝে-মাঝে স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম
পর্যবেক্ষণ করতে হয়। অনেক স্কুল পর্যবেক্ষণ করার সময় জানা গেছে,
ওইসব স্কুলে
নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করা হয় না। আবার অনেক স্কুল অভিভাবকদের এড়িয়ে চলার
চেষ্টা করে। স্কুলগুলোর ধারণা, ভালোভাবে স্কুল পরিচালনায় অভিভাবকদের চেয়ে স্কুল ম্যানেজিং
কমিটিই (এসএমসি) বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সন্দেহ নেই,
স্কুল উন্নয়নে
অভিভাবকদের তুলনায় এসএমসি’র সদস্যদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কিন্তু স্কুলগুলোর মনে রাখা দরকার, বহু অভিভাবক রয়েছেন যারা স্কুলে পড়ালেখার
মান উন্নয়নে নানাভাবে সহায়তা করতে পারেন। অনেক অভিভাবকের রয়েছে স্কুলশিক্ষায়
বিস্তৃত অভিজ্ঞতা এবং স্কুলশিক্ষা পরিচালনায় অনেকেই যথেষ্ট দক্ষ ও পারদর্শী। কেউ
কেউ শিক্ষার্থীদের আচরণ সম্বন্ধে বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। অথচ বাস্তবে দেখা যায়,
স্কুলগুলো
অভিভাবকদের তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না।
এবার আসা যাক কিন্ডার গার্টেনে অনুষ্ঠিত অভিভাবক সমাবেশ
প্রসঙ্গে। এ স্কুলটি একটি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ক্যাম্পাসে অবস্থিত। এর
পরিচালনার দায়িত্বভারও ওই কলেজের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজই কিন্ডার
গার্টেন স্কুলটি স্থাপন করে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বহু বছর ধরে পরিচালনা করে
আসছে। আমি ওই কলেজে বদলি হয়ে আসার পর কলেজের অধ্যক্ষ কিন্ডার গার্টেনটির একাডেমিক
কার্যক্রম তার পক্ষে দেখাশোনা করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। শিশুদের নিয়ে কাজ করা
এবং শিশুশিক্ষার ব্যাপারে আমার ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল থাকার কারণে আমি ওই স্কুলের
দায়িত্ব নিতে রাজি হই। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পাওয়ার পরদিন আমি একাই স্কুলটি
দেখতে যাই। স্কুলে গিয়ে দেখি, ক্লাস শুরু হতে তখনও পাঁচ-ছয় মিনিট বাকি আছে। শিশুদের কেউ কেউ
স্কুল ক্যাম্পাসে, কেউ কেউ ক্লাসের ভেতরে সুপরিসর জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করছে।
কিন্তু শিক্ষকদের সবাই তখনও স্কুলে এসে পৌঁছেননি। ইতিমধ্যে যে কয়েকজন শিক্ষক
এসেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তারা অনেকেই ক্লাস শুরুর একেবারে
পূর্বমুহূর্তে স্কুলে এসে পৌঁছান। কেন তাদের স্কুলে আসতে দেরি হয়— এমন প্রশ্নের জবাবে পথে যানজটের বিষয়টি কেউ কেউ তুলে
ধরলেন। তবে আমি জানি, ছোট জেলা শহরে যানজট তেমন একটা হয় না।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দেখলাম,
প্রধান শিক্ষক
এসে পৌঁছেছেন। পেছনে পেছনে অন্য একজন শিক্ষকও এসেছেন। ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা দশটায়
পৌঁছে গেছে। আমি শিক্ষকদের নিজ নিজ ক্লাসে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। শিক্ষকরা যে যার
মতো ক্লাসে চলে গেলেন। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন থেকে গেল,
শিক্ষকরা যদি
যথাসময়ে স্কুলে না আসেন তাহলে কি স্কুল ভালোভাবে চলতে পারে?
বিশেষ করে
শিশুদের স্কুলে শিক্ষকদের ক্লাস আরম্ভ হওয়ার অনেক আগেই আসা খুব জরুরি—এ দিকটি শিক্ষকদের মনে রাখা দরকার।
প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসে তার সঙ্গে স্কুলের নানা বিষয়
নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলার পর তাকে অনুরোধ করলাম আমাকে স্কুলের বিভিন্ন ক্লাস দেখার
সুযোগ করে দেয়ার জন্য। তিনি সম্মত হয়ে আমাকে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে নিয়ে
গেলেন। আমি ক্লাসগুলো ঘুরে দেখার সময় ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আসনগুলোর অবস্থা কেমন,
সব শিক্ষার্থীর
জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক আসন আছে কি-না, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে বসে কি-না, ব্ল্যাকবোর্ড কেমন,
পাঠ সহায়ক উপকরণ
আছে কি-না,
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কেমন,
শ্রেণিকক্ষে
পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করে কি-না, শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার্থীদের
পড়ালেখার অগ্রগতির খোঁজ-খবর করেন কি-না, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও
বাড়ির কাজ তাদের খাতায় লিখে দেয়া হয় কি-না ইত্যাদি দিক পর্যবেক্ষণ করলাম।
স্কুলটি শুধু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত বেতনের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হলেও
কোনো কোনো ক্লাসে হোয়াইটবোর্ডও চোখে পড়েছে। এসব দেখার পর আবারও প্রধান শিক্ষকের
সঙ্গে কথা হলো স্কুলের উন্নয়নে আর কী করা যায় সেসব বিষয়ে। এক পর্যায়ে আমি জানতে
চাইলাম, স্কুলে
নিয়মিত অভিভাবকদের নিয়ে কোনো মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয় কি-না। তিনি জানালেন,
এ ধরনের কোনো
সভা করা হয় না। তার এ কথা শুনে আমার মনে খানিকটা বিস্ময়ের সৃষ্টি হলো। স্কুলে যেসব
শিশু পড়ালেখা করতে আসে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে যদি স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনো
মতবিনিময় না-ই হয় তাহলে স্কুলের উন্নয়ন হবে কিভাবে?
কথার ফাঁকে আমিই
প্রস্তাব দিলাম, খুব দ্রুত অভিভাবকদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা
সম্ভব হবে কি-না। প্রধান শিক্ষক সহাস্যে আমার এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন
এবং বললেন, মতবিনিময় সভার তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে দেয়া হলে তিনি সভার
বিষয়টি অভিভাবকদের জানিয়ে দেবেন। এ আলোচনার পর আমি সেদিনের মতো স্কুল থেকে বিদায়
নিয়ে চলে এলাম। পরে স্কুল পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত আমার অন্য সহকর্মীদের
সঙ্গে আলোচনা করে অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভার তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে তা
প্রধান শিক্ষককে জানিয়ে দিলাম।
মতবিনিময় সভা আয়োজনের নির্ধারিত দিনে স্কুলে উপস্থিত হয়ে
দেখলাম, বহু
অভিভাবক ধৈর্য ধরে সভা শুরুর অপেক্ষায় বসে আছেন। আমরা যাওয়ার পর যথারীতি সভা আরম্ভ
হলো। শুরুতেই মতামত ব্যক্ত করার জন্য অভিভাবকদের অনুরোধ জানানো হলো। সভায় উপস্থিত
অভিভাবকদের মধ্য থেকে প্রায় ৮-১০ জন স্কুল বিষয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরলেন।
অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করায় অনেকেই তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন এবং
বললেন, এর
আগে কখনোই এ ধরনের কোনো সভার আয়োজন করা হয়নি। তারা বললেন,
অভিভাবকদের নিয়ে
নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করা স্কুলের স্বার্থেই জরুরি। অভিভাবকরা তাদের
সন্তানদের পড়ালেখার মান উন্নয়নের জন্য কিছু পরামর্শও দিলেন। তাদের পরামর্শের
প্রধান দিকগুলো ছিল, ১. শিশুদের হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য প্রতিটি শ্রেণিকে বছর
জুড়ে নির্দিষ্ট একজন শিক্ষকের দায়িত্বে রাখা; ২. শিশুদের ছবি আঁকায় যত্ন নেয়া;
৩.
শিক্ষকদের
যথাসময়ে স্কুলে আসা; ৪. বাড়ির কাজ তাদের নোট খাতায় তুলে দেয়া;
৫.
শ্রেণিকক্ষে
পড়ালেখায় শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য পাঠসহায়ক উপকরণ ব্যবহার করা;
৬.
সব শিশুকে
ব্যক্তিগতভাবে যত্ন নেয়া এবং ৭. পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
তারা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরলেন। তা হলো,
শিশুদের কোনো
কোনো বইয়ে কিছু বানান ভুল রয়েছে; কিন্তু শিক্ষকরা এগুলো শুদ্ধ না করে ভুলগুলোই শিক্ষার্থীদের
শিখিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে শিক্ষকদের বক্তব্য হলো, বইয়ে যেভাবে বানান রয়েছে ঠিক সেভাবেই
তারা শেখানোর চেষ্টা করেন। ভুল তথ্য এবং মুদ্রণজনিত ত্রুটি প্রসঙ্গে শিক্ষকদের এ
ধরনের যুক্তি কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা তারা নিজেরাই ভেবে দেখতে পারেন। অথচ আমি নিজেও
দেখেছি, অনেক
বইয়ে ভুল তথ্য, ভুল বানান রয়েছে। এসব ভুল সংশোধন করে সঠিক তথ্যটি শিক্ষার্থীদের
জানিয়ে দেয়া শিক্ষকের দায়িত্ব। কিন্তু দেখা যায়, অনেক শিক্ষক আছেন যারা এ গুরুত্বপূর্ণ
দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা ভুল শিক্ষাই পেয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে শিশুমনস্তত্ত্ব অনুযায়ী বলা দরকার,
শিশু
শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং তাদের কথাই সত্য বলে ধরে নেয়। ফলে
শিশুরা খাতায় কোনো ভুল তথ্য তুলে নিলে সেটি যদি তার শিক্ষিত অভিভাবক সংশোধন করে
দেয়ার চেষ্টা করেন তাহলেও শিশুটি তা সহজে মানতে চায় না। বরং অনেক সময় শিক্ষকের
পক্ষ হয়ে অভিভাবকের সঙ্গে শিশুরা তর্কে লিপ্ত হয়। এটি শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ বা
সমস্যা নয়। আমাদের জানতে হবে, এটিই শিশুর স্বাভাবিক প্রবণতা। কাজেই শিশুদের শেখানোর জন্য
শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকা দরকার। বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীরা যদি কখনও
শিক্ষকের কাছ থেকে কোনো ভুল তথ্য পায় তাহলে শিক্ষককে কিছু না বলে নিজেরাই তা শুদ্ধ
করে নেয়। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্ভাবনা নেই। এ দিকটিই আমাদের অনেক
শিক্ষক উপেক্ষা করেন।
শেষ করার আগে বলব, বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুল যদি অভিভাবকদের
নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভা এবং অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করে তাহলে শিক্ষার্থীসৃষ্ট
অনেক সমস্যা নিরসন সহজ হবে; দূর হবে বহুমুখী সামাজিক সমস্যাও। আর স্কুলের সঙ্গে
সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই সঠিক পথে পরিচালনা করাও
সম্ভব হবে। এসব কারণেই অভিভাবক সমাবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক :সহযোগী অধ্যাপক,
সরকারি টিচার্স
ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
http://epaper.ittefaq.com.bd/2014/09/21/images/08_103.jpg
No comments:
Post a Comment