Tuesday, July 8, 2014

পরীক্ষায় বিরতি না থাকলেই কি প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে?



জুলাই ৮, ২০১৪, মঙ্গলবার : আষাঢ় ২৪, ১৪২১
(উপ-সম্পাদকীয়)
পরীক্ষায় বিরতি না থাকলেই কি প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে?
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ০৮ জুলাই, ২০১৪
প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে যখন এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলাম, তখন পরীক্ষা হতো সকাল-বিকাল। বিশেষ করে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র বিষয়ের দুটি পরীক্ষার একটি হতো সকালে, আরেকটি বিকালে। অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষার মাঝখানে তেমন কোনো বিরতি থাকত না। তখন শিক্ষা বোর্ড এভাবেই পরীক্ষার সময়সূচি প্রণয়ন করত। মনে আছে, সকালে বাংলা বিষয়ের প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিয়ে দুপুরে এক ঘণ্টার বিরতির সময় খাওয়ার কাজটি সেরে নিয়েছি এবং যতটা সম্ভব বিকালে দ্বিতীয় পত্রের নির্ধারিত বইয়ের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়েছি। এখনকার মতো গাইড বইয়ের প্রচলন তখন ছিল না। ছিল না দেশজুড়ে যত্রতত্র কোচিং সেন্টারও। এমনকি বর্তমানকালের মতো তখন পড়ালেখার এত সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। অভিভাবকরাও আমাদের নিয়ে স্কুলে যেতেন না। তাদের এত সময়ও ছিল না। স্কুলের বইখাতা নিজেই গুছিয়ে একা স্কুলে যেতে হতো। নিজের পড়া বাড়িতে বসে নিজেকেই তৈরি করতে হতো। তবে আমাদের সময় গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার প্রচলন ছিল। তবে সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হতো না। আমরা অনেকেই শুধু কঠিন বিষয়গুলো যেমন- ইংরেজি, গণিত, নৈর্বাচনিক গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন পালাক্রমে প্রাইভেট পড়তাম। তখন পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হতো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ দিয়ে। যারা সব বিষয়ে শতকরা ৭৫ ভাগ নম্বর পেত, তাদের বলা হতো স্টার মার্কসধারী। আর যারা প্রত্যেক বিষয়ে গড়ে ৮০ বা তারও বেশি নম্বর পেয়ে বোর্ডভিত্তিক সেরা বিশের মধ্যে স্থান করে নিত, তাদের বোর্ডস্ট্যান্ড বলে গণ্য করা হতো। এরা এবং স্টার মার্কসধারীরাই ছিল তখনকার সময়ে সেরা শিক্ষার্র্থী। তখন প্রথম বিভাগ পাওয়াও কম ঈর্ষণীয় ছিল না। দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরও ভালো মানের বলে মনে করা হতো। আর স্টার মার্কস পাওয়া ও বোর্ডস্ট্যান্ড করা শিক্ষার্থীদের দিনে কে কত ঘণ্টা পড়াশোনা করেছে এবং কিভাবে ফলাফল ভালো করেছে তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো তাদের সাক্ষাৎকার। অবশ্য তখন এত মিডিয়াও ছিল না। এখন যে রকমভাবে গাইড বইয়ের প্রচলন হয়েছে, এমনকি দৈনিক পত্রিকাগুলোও গাইড বইয়ের বিকল্প হিসেবে যেভাবে কাজ করছে, তখন এ ধরনের পরিবেশের কথা চিন্তাও করা যেত না। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস বলে কিছু একটা আছে, এমন কোনো ব্যাপার কল্পনাও করা যেত না। তারপরও তখন এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণার পর সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে দেশজুড়ে হইচই পড়ে যেত। যারা বোর্ডস্ট্যান্ড করত, তাদের নাম ও ছবি ছাপা হতো খবরের কাগজে। তারা একদিকে নিজেরা যেমন গর্ববোধ করত, তেমনি শিক্ষক, অভিভাবকরাও তাদের নিয়ে গর্ব করতেন। ভালো ফল অর্জনকারীদের নিয়ে এলাকার অন্যরাও ঈর্ষাবোধ করতেন।
২.
এখন দিন অনেক পাল্টেছে। এখন আর পরীক্ষার ফলে বিভাগ বলে কিছু নেই। এখন পড়ালেখার পদ্ধতি, মূল্যায়ন ব্যবস্থা, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল ঘোষণায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। এখন পরীক্ষার ফল ঘোষণায় যুক্ত হয়েছে গ্রেডিং সিস্টেম। এটা এমন এক সিস্টেম যে, যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে ৮০ নম্বর করে পেয়েছে তারও ফল যা, আর যে শিক্ষার্থী পেয়েছে ৯৯ তারও ফল তা। উভয়ের সার্টিফিকেট একই মানের। নম্বরের এই বিরাট ব্যবধান কোনো পরীক্ষার্থী বা অন্য কারও জানার তেমন সুযোগ নেই। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের ফল এ-প্লাস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এভাবে সব বিষয়ে এ-প্লাস পেলে বলা হয় জিপিএ ৫ বা গোল্ডেন ৫; যদিও শিক্ষা বোর্ডের ফলাফলে গোল্ডেন ৫ বলে কিছু নেই। তবুও সব বিষয়ে এ-প্লাস পাওয়াকে অনেকেই গোল্ডেন ৫ বলে অভিহিত করেন। এটা এক ধরনের আত্মতৃপ্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন জিপিএ ৫ পাওয়া একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি জিপিএ ৫ পাওয়াদের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। একই সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগও বাড়ছে সমান তালে। কয়েক যুগ আগের পড়ালেখার পদ্ধতি ও মানের সঙ্গে বর্তমান সময়ের পদ্ধতি ও মানের এখানেই পার্থক্য!
আজকাল জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে তেমন কোনো হইচই হয় না। কারণ জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে কে কাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠবে? বেশি জিপিএ ৫ পাওয়া দোষের কিছু নয়। সমস্যা হল, এত বেশিসংখ্যক জিপিএ ৫-ধারীদেরও উচ্চশ্রেণীতে ভর্তি নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। তাদের ভর্তি করার মতো ভালো প্রতিষ্ঠান কিংবা পর্যাপ্ত আসন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। দুর্মুখেরা বলেন, আগের মতো দিনরাত পড়ালেখা না করে, পরিশ্রম না করেই যেভাবে এখন জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ভর্তির সংকট থেকেই যাবে। কেউ কেউ ঢালাওভাবে জিপিএ ৫ পাওয়ার পেছনে প্রশ্নপত্র ফাঁসকে দায়ী করেন। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই যে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বাড়বে এটা সব সময় ঠিক নয়। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়িয়ে পড়লে ভালো মানের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘœ ঘটে, তারা হতাশ হয়, এটা ঠিক। এসব কারণে কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যায় সেটাই হল আসল প্রশ্ন।
এখন এসএসসি, এইচএসসি উভয় ক্ষেত্রেই দীর্ঘ বিরতি দিয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার্থীরা যাতে কোনোরকম মানসিক ও শারীরিক চাপের মুখে না পড়ে সে জন্য কয়েক দিনের গ্যাপ দিয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে। এর ফলে একদিকে পরীক্ষার্থীরা যেমন চাপমুক্ত থেকে পরীক্ষা দিতে পারে, তেমনি পরীক্ষার দিনগুলোয় পর্যাপ্ত বিরতি থাকায় তারা সব বিষয়ে যথেষ্ট সময় নিয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতিও নিতে পারে। এটা এখনকার পরীক্ষার্থীদের জন্য একটি সুযোগ। কিন্তু এ ধরনের সুযোগ-সুবিধার অবসান হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এর প্রধান কারণ বলে অনুমান করা যায়।
৩.
অনেক দিন ধরেই দেশে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে আসছে। এসব অভিযোগের মুখে সরকারি কর্তৃপক্ষ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ২০১৪ সালের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের উৎস শনাক্ত করা এবং ভবিষ্যতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কার্যকর হবে এমন সুপারিশ প্রণয়ন করা। এ কমিটি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করলেও তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল উৎস চিহ্নিত করতে পারেনি বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। তবে ভবিষ্যতে যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয় সে জন্য কমিটি বেশকিছু সুপারিশ পেশ করেছে কর্তৃপক্ষের কাছে। এখন এসব সুপারিশের কতটুকু গ্রহণ ও কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব হবে সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তার আগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বিকল্প কী পথ অনুসরণ করা হয় সেটাও দেখার বিষয়।
তদন্ত কমিটি সাধারণ সুপারিশ হিসেবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষার সময়সূচি পুনঃনির্ধারণ করে সম্ভব হলে প্রতিদিন দুটি করে, একান্ত সম্ভব না হলে অন্তত প্রতিদিন একটি করে একনাগাড়ে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পরীক্ষার ব্যাপ্তি কমিয়ে আনার যে সুপারিশ করেছে তা নিয়ে এখন দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রপত্রিকায় এমন খবরও প্রচারিত হয়েছে যে, আগামীতে পাবলিক পরীক্ষায় কোনো গ্যাপ থাকবে না। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে কি পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই সাড়ে তিন দশক আগের দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছে? এরই মধ্যে এটা নিয়ে বিভিন্ন মহল নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের বিকল্প কি বিরতিহীন পরীক্ষা? তবে এ ধরনের পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শেষ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেটা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। তবে আমাদের মনে প্রশ্ন, পাবলিক পরীক্ষায় কোনো বিরতি না থাকলেই কি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে? এভাবে কি পরীক্ষার্থীরা আরও মানসিক চাপের মুখে পড়বে না?
৪.
অব্যাহতভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের মুখে প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতিই এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বিভিন্ন মহল থেকে নানা পরামর্শ ও সুপারিশ দেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের কাছে সম্ভবত কোনোটিই জুতসই মনে হচ্ছে না। কারণ এখনও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের কার্যকর উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা চরম দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে। আমার নিজের অভিমত, এখন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। কোচিং সেন্টার নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি। এগুলো বন্ধ করার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু একটিও কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়েছে বলে জানা যায়নি আজ পর্যন্ত। কাজেই এখন সময় এসেছে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার করার। এটা যতদিন করা সম্ভব না হবে ততদিন পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আমাদের উদ্বেগ থাকবেই।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

Monday, July 7, 2014

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা



ঢাকা, সোমবার ৭ জুলাই ২০১৪, ২৩ আষাঢ় ১৪২১, ৮ রমজান ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা
মো. মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় উচ্চশিক্ষা পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম বিরাজ করছে বহু বছর ধরে। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়াই বেসরকারি উদ্যোগে যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা স্থাপন, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অননুমোদিত কোর্স চালু, স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে গড়িমসি করা, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চহারে কোর্স ফি আদায় ইত্যাদি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ভর্তি-বাণিজ্য ও সনদ বিক্রির গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই চলছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে প্রায়ই দেশের গণমাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও বন্ধ হয়নি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ কার্যক্রম। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেশজুড়ে তাদের অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস খুলে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হলো, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নেই। কোনো কোনোটিতে রয়েছে একাধিক উপাচার্য। আবার উপাচার্যের পদ নিয়ে আদালতে মামলা-মোকদ্দমাও পরিচালিত হচ্ছে। মামলা রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়েও। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভালোমানের পড়ালেখা হয় না তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। আবার এসব বিরোধপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছেন তাদের অনেককেই চাকরির বাজারে বিপাকে পড়তে হচ্ছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনা নিয়ে গত ৩ জুলাই একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনুমোদন না পেলেও কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে সনদ-বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কার্যক্রম। অনুমোদনভুক্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তালিকায়ও এসব প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান বিনা বাধায় দেশ জুড়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির নামে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছে। এ ধরনের প্রবণতা আমাদের উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিয়ে এখন গুরুতর প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েও অনেক সময় প্রতারিত হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তার পরও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ধাবিত হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। যেসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের প্রচুর টাকা-পয়সা রয়েছে এবং যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয় তাদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছুটে যায়। অবশ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকট এবং সেশনজটসহ প্রায় সময়েই সৃষ্ট নানামুখী অস্থিরতার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোন কোর্সে কত টাকা আদায় করতে পারবে তা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণও চোখে পড়ে না। বরং বলা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ইচ্ছামতো টাকা আদায় করছে। এসব টাকার কোনো হিসাবও তারা কারো কাছে দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করে বলে মনে হয় না। এখানে বলা দরকার, উন্নত দেশগুলোতেও বেসরকারি উদ্যোগে উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হয়ে থাকে। সেসব দেশেও রয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানে শিক্ষার মান নিয়ে কোনো আপস করতে শোনা যায় না। বরং উন্নত দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের। তাদের বহু বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ওপরের দিকে রয়েছে। অথচ আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে স্থান করে নিতে পারছে না! মানসম্মত শিক্ষার জন্য দরকার পর্যাপ্ত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা; নিয়মিত গবেষণাধর্মী জার্নাল বের করাও জরুরি। কিন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষায় গবেষণা নিয়ে কী ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটাও জানা যায় না।
এ অবস্থায় বেসরকারি উদ্যোগে উচ্চশিক্ষা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে দ্রুত। দেশজুড়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা কতটুকু সমীচীন সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। দরকার হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত শিক্ষার গুণগতমান নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com