Sunday, September 21, 2014

শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিভাবক সমাবেশ



রবিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪, আশ্বিন ১৪২১, ২৫ জিলকদ ১৪৩৫
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষা
শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিভাবক সমাবেশ
মোঃ মুজিবুর রহমান
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ইং
একবার স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যোগদানের এক বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। বিরল বলছি এ কারণে যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ স্কুলই শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের নিয়ে কোনো মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে চায় না। অথচ স্কুলে শিখন-বান্ধব পরিবেশ বজায় রাখা এবং শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার গুণগতমান উন্নয়নের জন্য তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
শিক্ষক প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে আমি বহু স্কুল পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছি। এখনও মাঝে-মাঝে স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হয়। অনেক স্কুল পর্যবেক্ষণ করার সময় জানা গেছে, ওইসব স্কুলে নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করা হয় না। আবার অনেক স্কুল অভিভাবকদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। স্কুলগুলোর ধারণা, ভালোভাবে স্কুল পরিচালনায় অভিভাবকদের চেয়ে স্কুল ম্যানেজিং কমিটিই (এসএমসি) বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সন্দেহ নেই, স্কুল উন্নয়নে অভিভাবকদের তুলনায় এসএমসির সদস্যদের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু স্কুলগুলোর মনে রাখা দরকার, বহু অভিভাবক রয়েছেন যারা স্কুলে পড়ালেখার মান উন্নয়নে নানাভাবে সহায়তা করতে পারেন। অনেক অভিভাবকের রয়েছে স্কুলশিক্ষায় বিস্তৃত অভিজ্ঞতা এবং স্কুলশিক্ষা পরিচালনায় অনেকেই যথেষ্ট দক্ষ ও পারদর্শী। কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের আচরণ সম্বন্ধে বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, স্কুলগুলো অভিভাবকদের তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না।
এবার আসা যাক কিন্ডার গার্টেনে অনুষ্ঠিত অভিভাবক সমাবেশ প্রসঙ্গে। এ স্কুলটি একটি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ক্যাম্পাসে অবস্থিত। এর পরিচালনার দায়িত্বভারও ওই কলেজের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজই কিন্ডার গার্টেন স্কুলটি স্থাপন করে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বহু বছর ধরে পরিচালনা করে আসছে। আমি ওই কলেজে বদলি হয়ে আসার পর কলেজের অধ্যক্ষ কিন্ডার গার্টেনটির একাডেমিক কার্যক্রম তার পক্ষে দেখাশোনা করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। শিশুদের নিয়ে কাজ করা এবং শিশুশিক্ষার ব্যাপারে আমার ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল থাকার কারণে আমি ওই স্কুলের দায়িত্ব নিতে রাজি হই। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পাওয়ার পরদিন আমি একাই স্কুলটি দেখতে যাই। স্কুলে গিয়ে দেখি, ক্লাস শুরু হতে তখনও পাঁচ-ছয় মিনিট বাকি আছে। শিশুদের কেউ কেউ স্কুল ক্যাম্পাসে, কেউ কেউ ক্লাসের ভেতরে সুপরিসর জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করছে। কিন্তু শিক্ষকদের সবাই তখনও স্কুলে এসে পৌঁছেননি। ইতিমধ্যে যে কয়েকজন শিক্ষক এসেছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তারা অনেকেই ক্লাস শুরুর একেবারে পূর্বমুহূর্তে স্কুলে এসে পৌঁছান। কেন তাদের স্কুলে আসতে দেরি হয় এমন প্রশ্নের জবাবে পথে যানজটের বিষয়টি কেউ কেউ তুলে ধরলেন। তবে আমি জানি, ছোট জেলা শহরে যানজট তেমন একটা হয় না।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দেখলাম, প্রধান শিক্ষক এসে পৌঁছেছেন। পেছনে পেছনে অন্য একজন শিক্ষকও এসেছেন। ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা দশটায় পৌঁছে গেছে। আমি শিক্ষকদের নিজ নিজ ক্লাসে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। শিক্ষকরা যে যার মতো ক্লাসে চলে গেলেন। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন থেকে গেল, শিক্ষকরা যদি যথাসময়ে স্কুলে না আসেন তাহলে কি স্কুল ভালোভাবে চলতে পারে? বিশেষ করে শিশুদের স্কুলে শিক্ষকদের ক্লাস আরম্ভ হওয়ার অনেক আগেই আসা খুব জরুরিএ দিকটি শিক্ষকদের মনে রাখা দরকার।
প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসে তার সঙ্গে স্কুলের নানা বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলার পর তাকে অনুরোধ করলাম আমাকে স্কুলের বিভিন্ন ক্লাস দেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। তিনি সম্মত হয়ে আমাকে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে নিয়ে গেলেন। আমি ক্লাসগুলো ঘুরে দেখার সময় ক্লাসে শিক্ষার্থীদের আসনগুলোর অবস্থা কেমন, সব শিক্ষার্থীর জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক আসন আছে কি-না, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে গাদাগাদি করে বসে কি-না, ব্ল্যাকবোর্ড কেমন, পাঠ সহায়ক উপকরণ আছে কি-না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কেমন, শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করে কি-না, শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার অগ্রগতির খোঁজ-খবর করেন কি-না, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও বাড়ির কাজ তাদের খাতায় লিখে দেয়া হয় কি-না ইত্যাদি দিক পর্যবেক্ষণ করলাম। স্কুলটি শুধু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত বেতনের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হলেও কোনো কোনো ক্লাসে হোয়াইটবোর্ডও চোখে পড়েছে। এসব দেখার পর আবারও প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলো স্কুলের উন্নয়নে আর কী করা যায় সেসব বিষয়ে। এক পর্যায়ে আমি জানতে চাইলাম, স্কুলে নিয়মিত অভিভাবকদের নিয়ে কোনো মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয় কি-না। তিনি জানালেন, এ ধরনের কোনো সভা করা হয় না। তার এ কথা শুনে আমার মনে খানিকটা বিস্ময়ের সৃষ্টি হলো। স্কুলে যেসব শিশু পড়ালেখা করতে আসে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে যদি স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনো মতবিনিময় না-ই হয় তাহলে স্কুলের উন্নয়ন হবে কিভাবে? কথার ফাঁকে আমিই প্রস্তাব দিলাম, খুব দ্রুত অভিভাবকদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা সম্ভব হবে কি-না। প্রধান শিক্ষক সহাস্যে আমার এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন এবং বললেন, মতবিনিময় সভার তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে দেয়া হলে তিনি সভার বিষয়টি অভিভাবকদের জানিয়ে দেবেন। এ আলোচনার পর আমি সেদিনের মতো স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। পরে স্কুল পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত আমার অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভার তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে তা প্রধান শিক্ষককে জানিয়ে দিলাম।
মতবিনিময় সভা আয়োজনের নির্ধারিত দিনে স্কুলে উপস্থিত হয়ে দেখলাম, বহু অভিভাবক ধৈর্য ধরে সভা শুরুর অপেক্ষায় বসে আছেন। আমরা যাওয়ার পর যথারীতি সভা আরম্ভ হলো। শুরুতেই মতামত ব্যক্ত করার জন্য অভিভাবকদের অনুরোধ জানানো হলো। সভায় উপস্থিত অভিভাবকদের মধ্য থেকে প্রায় ৮-১০ জন স্কুল বিষয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরলেন। অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করায় অনেকেই তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এর আগে কখনোই এ ধরনের কোনো সভার আয়োজন করা হয়নি। তারা বললেন, অভিভাবকদের নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন করা স্কুলের স্বার্থেই জরুরি। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়ালেখার মান উন্নয়নের জন্য কিছু পরামর্শও দিলেন। তাদের পরামর্শের প্রধান দিকগুলো ছিল, . শিশুদের হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য প্রতিটি শ্রেণিকে বছর জুড়ে নির্দিষ্ট একজন শিক্ষকের দায়িত্বে রাখা; . শিশুদের ছবি আঁকায় যত্ন নেয়া; . শিক্ষকদের যথাসময়ে স্কুলে আসা; . বাড়ির কাজ তাদের নোট খাতায় তুলে দেয়া; . শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখায় শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য পাঠসহায়ক উপকরণ ব্যবহার করা; . সব শিশুকে ব্যক্তিগতভাবে যত্ন নেয়া এবং ৭. পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি। তারা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরলেন। তা হলো, শিশুদের কোনো কোনো বইয়ে কিছু বানান ভুল রয়েছে; কিন্তু শিক্ষকরা এগুলো শুদ্ধ না করে ভুলগুলোই শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে শিক্ষকদের বক্তব্য হলো, বইয়ে যেভাবে বানান রয়েছে ঠিক সেভাবেই তারা শেখানোর চেষ্টা করেন। ভুল তথ্য এবং মুদ্রণজনিত ত্রুটি প্রসঙ্গে শিক্ষকদের এ ধরনের যুক্তি কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা তারা নিজেরাই ভেবে দেখতে পারেন। অথচ আমি নিজেও দেখেছি, অনেক বইয়ে ভুল তথ্য, ভুল বানান রয়েছে। এসব ভুল সংশোধন করে সঠিক তথ্যটি শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেয়া শিক্ষকের দায়িত্ব। কিন্তু দেখা যায়, অনেক শিক্ষক আছেন যারা এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা ভুল শিক্ষাই পেয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে শিশুমনস্তত্ত্ব অনুযায়ী বলা দরকার, শিশু শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং তাদের কথাই সত্য বলে ধরে নেয়। ফলে শিশুরা খাতায় কোনো ভুল তথ্য তুলে নিলে সেটি যদি তার শিক্ষিত অভিভাবক সংশোধন করে দেয়ার চেষ্টা করেন তাহলেও শিশুটি তা সহজে মানতে চায় না। বরং অনেক সময় শিক্ষকের পক্ষ হয়ে অভিভাবকের সঙ্গে শিশুরা তর্কে লিপ্ত হয়। এটি শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ বা সমস্যা নয়। আমাদের জানতে হবে, এটিই শিশুর স্বাভাবিক প্রবণতা। কাজেই শিশুদের শেখানোর জন্য শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকা দরকার। বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীরা যদি কখনও শিক্ষকের কাছ থেকে কোনো ভুল তথ্য পায় তাহলে শিক্ষককে কিছু না বলে নিজেরাই তা শুদ্ধ করে নেয়। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্ভাবনা নেই। এ দিকটিই আমাদের অনেক শিক্ষক উপেক্ষা করেন।
শেষ করার আগে বলব, বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুল যদি অভিভাবকদের নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভা এবং অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করে তাহলে শিক্ষার্থীসৃষ্ট অনেক সমস্যা নিরসন সহজ হবে; দূর হবে বহুমুখী সামাজিক সমস্যাও। আর স্কুলের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই সঠিক পথে পরিচালনা করাও সম্ভব হবে। এসব কারণেই অভিভাবক সমাবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com

http://epaper.ittefaq.com.bd/2014/09/21/images/08_103.jpg

Tuesday, July 8, 2014

পরীক্ষায় বিরতি না থাকলেই কি প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে?



জুলাই ৮, ২০১৪, মঙ্গলবার : আষাঢ় ২৪, ১৪২১
(উপ-সম্পাদকীয়)
পরীক্ষায় বিরতি না থাকলেই কি প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হবে?
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : ০৮ জুলাই, ২০১৪
প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে যখন এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলাম, তখন পরীক্ষা হতো সকাল-বিকাল। বিশেষ করে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র বিষয়ের দুটি পরীক্ষার একটি হতো সকালে, আরেকটি বিকালে। অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষার মাঝখানে তেমন কোনো বিরতি থাকত না। তখন শিক্ষা বোর্ড এভাবেই পরীক্ষার সময়সূচি প্রণয়ন করত। মনে আছে, সকালে বাংলা বিষয়ের প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিয়ে দুপুরে এক ঘণ্টার বিরতির সময় খাওয়ার কাজটি সেরে নিয়েছি এবং যতটা সম্ভব বিকালে দ্বিতীয় পত্রের নির্ধারিত বইয়ের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়েছি। এখনকার মতো গাইড বইয়ের প্রচলন তখন ছিল না। ছিল না দেশজুড়ে যত্রতত্র কোচিং সেন্টারও। এমনকি বর্তমানকালের মতো তখন পড়ালেখার এত সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। অভিভাবকরাও আমাদের নিয়ে স্কুলে যেতেন না। তাদের এত সময়ও ছিল না। স্কুলের বইখাতা নিজেই গুছিয়ে একা স্কুলে যেতে হতো। নিজের পড়া বাড়িতে বসে নিজেকেই তৈরি করতে হতো। তবে আমাদের সময় গৃহশিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার প্রচলন ছিল। তবে সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে হতো না। আমরা অনেকেই শুধু কঠিন বিষয়গুলো যেমন- ইংরেজি, গণিত, নৈর্বাচনিক গণিত, পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন পালাক্রমে প্রাইভেট পড়তাম। তখন পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হতো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ দিয়ে। যারা সব বিষয়ে শতকরা ৭৫ ভাগ নম্বর পেত, তাদের বলা হতো স্টার মার্কসধারী। আর যারা প্রত্যেক বিষয়ে গড়ে ৮০ বা তারও বেশি নম্বর পেয়ে বোর্ডভিত্তিক সেরা বিশের মধ্যে স্থান করে নিত, তাদের বোর্ডস্ট্যান্ড বলে গণ্য করা হতো। এরা এবং স্টার মার্কসধারীরাই ছিল তখনকার সময়ে সেরা শিক্ষার্র্থী। তখন প্রথম বিভাগ পাওয়াও কম ঈর্ষণীয় ছিল না। দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরও ভালো মানের বলে মনে করা হতো। আর স্টার মার্কস পাওয়া ও বোর্ডস্ট্যান্ড করা শিক্ষার্থীদের দিনে কে কত ঘণ্টা পড়াশোনা করেছে এবং কিভাবে ফলাফল ভালো করেছে তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো তাদের সাক্ষাৎকার। অবশ্য তখন এত মিডিয়াও ছিল না। এখন যে রকমভাবে গাইড বইয়ের প্রচলন হয়েছে, এমনকি দৈনিক পত্রিকাগুলোও গাইড বইয়ের বিকল্প হিসেবে যেভাবে কাজ করছে, তখন এ ধরনের পরিবেশের কথা চিন্তাও করা যেত না। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস বলে কিছু একটা আছে, এমন কোনো ব্যাপার কল্পনাও করা যেত না। তারপরও তখন এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণার পর সেরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে দেশজুড়ে হইচই পড়ে যেত। যারা বোর্ডস্ট্যান্ড করত, তাদের নাম ও ছবি ছাপা হতো খবরের কাগজে। তারা একদিকে নিজেরা যেমন গর্ববোধ করত, তেমনি শিক্ষক, অভিভাবকরাও তাদের নিয়ে গর্ব করতেন। ভালো ফল অর্জনকারীদের নিয়ে এলাকার অন্যরাও ঈর্ষাবোধ করতেন।
২.
এখন দিন অনেক পাল্টেছে। এখন আর পরীক্ষার ফলে বিভাগ বলে কিছু নেই। এখন পড়ালেখার পদ্ধতি, মূল্যায়ন ব্যবস্থা, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল ঘোষণায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। এখন পরীক্ষার ফল ঘোষণায় যুক্ত হয়েছে গ্রেডিং সিস্টেম। এটা এমন এক সিস্টেম যে, যে শিক্ষার্থী সব বিষয়ে ৮০ নম্বর করে পেয়েছে তারও ফল যা, আর যে শিক্ষার্থী পেয়েছে ৯৯ তারও ফল তা। উভয়ের সার্টিফিকেট একই মানের। নম্বরের এই বিরাট ব্যবধান কোনো পরীক্ষার্থী বা অন্য কারও জানার তেমন সুযোগ নেই। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের ফল এ-প্লাস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এভাবে সব বিষয়ে এ-প্লাস পেলে বলা হয় জিপিএ ৫ বা গোল্ডেন ৫; যদিও শিক্ষা বোর্ডের ফলাফলে গোল্ডেন ৫ বলে কিছু নেই। তবুও সব বিষয়ে এ-প্লাস পাওয়াকে অনেকেই গোল্ডেন ৫ বলে অভিহিত করেন। এটা এক ধরনের আত্মতৃপ্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন জিপিএ ৫ পাওয়া একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি জিপিএ ৫ পাওয়াদের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। একই সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগও বাড়ছে সমান তালে। কয়েক যুগ আগের পড়ালেখার পদ্ধতি ও মানের সঙ্গে বর্তমান সময়ের পদ্ধতি ও মানের এখানেই পার্থক্য!
আজকাল জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে তেমন কোনো হইচই হয় না। কারণ জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে কে কাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠবে? বেশি জিপিএ ৫ পাওয়া দোষের কিছু নয়। সমস্যা হল, এত বেশিসংখ্যক জিপিএ ৫-ধারীদেরও উচ্চশ্রেণীতে ভর্তি নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। তাদের ভর্তি করার মতো ভালো প্রতিষ্ঠান কিংবা পর্যাপ্ত আসন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। দুর্মুখেরা বলেন, আগের মতো দিনরাত পড়ালেখা না করে, পরিশ্রম না করেই যেভাবে এখন জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ভর্তির সংকট থেকেই যাবে। কেউ কেউ ঢালাওভাবে জিপিএ ৫ পাওয়ার পেছনে প্রশ্নপত্র ফাঁসকে দায়ী করেন। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই যে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বাড়বে এটা সব সময় ঠিক নয়। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়িয়ে পড়লে ভালো মানের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘœ ঘটে, তারা হতাশ হয়, এটা ঠিক। এসব কারণে কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যায় সেটাই হল আসল প্রশ্ন।
এখন এসএসসি, এইচএসসি উভয় ক্ষেত্রেই দীর্ঘ বিরতি দিয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার্থীরা যাতে কোনোরকম মানসিক ও শারীরিক চাপের মুখে না পড়ে সে জন্য কয়েক দিনের গ্যাপ দিয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে। এর ফলে একদিকে পরীক্ষার্থীরা যেমন চাপমুক্ত থেকে পরীক্ষা দিতে পারে, তেমনি পরীক্ষার দিনগুলোয় পর্যাপ্ত বিরতি থাকায় তারা সব বিষয়ে যথেষ্ট সময় নিয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতিও নিতে পারে। এটা এখনকার পরীক্ষার্থীদের জন্য একটি সুযোগ। কিন্তু এ ধরনের সুযোগ-সুবিধার অবসান হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এর প্রধান কারণ বলে অনুমান করা যায়।
৩.
অনেক দিন ধরেই দেশে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে আসছে। এসব অভিযোগের মুখে সরকারি কর্তৃপক্ষ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ২০১৪ সালের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের উৎস শনাক্ত করা এবং ভবিষ্যতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কার্যকর হবে এমন সুপারিশ প্রণয়ন করা। এ কমিটি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করলেও তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল উৎস চিহ্নিত করতে পারেনি বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। তবে ভবিষ্যতে যাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয় সে জন্য কমিটি বেশকিছু সুপারিশ পেশ করেছে কর্তৃপক্ষের কাছে। এখন এসব সুপারিশের কতটুকু গ্রহণ ও কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব হবে সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তার আগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বিকল্প কী পথ অনুসরণ করা হয় সেটাও দেখার বিষয়।
তদন্ত কমিটি সাধারণ সুপারিশ হিসেবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষার সময়সূচি পুনঃনির্ধারণ করে সম্ভব হলে প্রতিদিন দুটি করে, একান্ত সম্ভব না হলে অন্তত প্রতিদিন একটি করে একনাগাড়ে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে পরীক্ষার ব্যাপ্তি কমিয়ে আনার যে সুপারিশ করেছে তা নিয়ে এখন দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রপত্রিকায় এমন খবরও প্রচারিত হয়েছে যে, আগামীতে পাবলিক পরীক্ষায় কোনো গ্যাপ থাকবে না। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে কি পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই সাড়ে তিন দশক আগের দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছে? এরই মধ্যে এটা নিয়ে বিভিন্ন মহল নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের বিকল্প কি বিরতিহীন পরীক্ষা? তবে এ ধরনের পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শেষ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেটা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। তবে আমাদের মনে প্রশ্ন, পাবলিক পরীক্ষায় কোনো বিরতি না থাকলেই কি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে? এভাবে কি পরীক্ষার্থীরা আরও মানসিক চাপের মুখে পড়বে না?
৪.
অব্যাহতভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের মুখে প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতিই এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বিভিন্ন মহল থেকে নানা পরামর্শ ও সুপারিশ দেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের কাছে সম্ভবত কোনোটিই জুতসই মনে হচ্ছে না। কারণ এখনও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের কার্যকর উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা চরম দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে। আমার নিজের অভিমত, এখন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। কোচিং সেন্টার নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি। এগুলো বন্ধ করার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু একটিও কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়েছে বলে জানা যায়নি আজ পর্যন্ত। কাজেই এখন সময় এসেছে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার করার। এটা যতদিন করা সম্ভব না হবে ততদিন পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আমাদের উদ্বেগ থাকবেই।
মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com