Thursday, September 12, 2013

শিক্ষা আইন ২০১৩ : কয়েকটি সুপারিশ



ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৩, ২৮ ভাদ্র ১৪২০ এবং ০৫ জিলক্বদ ১৪৩৪
(উপ-সম্পাদকীয়)
শিক্ষা আইন ২০১৩ : কয়েকটি সুপারিশ
মো. মুজিবুর রহমান
২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে খসড়া আকারে প্রণয়ন করা হয়েছে শিক্ষা আইন, ২০১৩এ আইন নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। আলোচনা হচ্ছে এ কারণে যে, বাংলাদেশে এর আগে ১৯৯০ সালের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন ছাড়া দেশে অন্য কোনো শিক্ষা আইন নেই। অন্যদিকে সমালোচনা হচ্ছে বিশেষ করে শিক্ষা আইনের 'তফসিল-: অপরাধ ও শাস্তি' অংশে বর্ণিত শাস্তির প্রকৃতি নিয়ে। তবে শিক্ষা আইনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কয়েকটি সুপারিশ এখানে তুলে ধরা হলো
. শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) শিক্ষায় অনার্স কোর্স পরিচালনা করে আসছে। ঢাকা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজেও শিক্ষায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে অনেক আগেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরও কয়েকটি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষায় অনার্স কোর্স চালুর বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু এ কোর্সটিকে অন্য সাধারণ কোর্সের মতো বিবেচনা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালনা করা উচিত নয়। কারণ সাধারণ কোর্স এবং প্রশিক্ষণ কোর্সের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত অনেক মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। এ কারণে শিক্ষা বিষয়কে স্বাধীন কোর্স হিসেবে পরিচালনা করতে হলে দরকার শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Education) স্থাপন করা। অন্য অনেক দেশেই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। লন্ডনে রয়েছে ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন। সিঙ্গাপুরে আছে National Institute of Education (NIE)জাপানে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাংলাদেশেও শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টি শিক্ষা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে দেশের সরকারি ও বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসা যাবে। এছাড়া প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং শিক্ষা নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করার সুযোগও সৃষ্টি হবে। প্রসঙ্গত, দেশের সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো শিক্ষা বিষয়ের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়ার কারণে এসব কলেজের নাম পরিবর্তন করে 'কলেজ অব এডুকেশন' করা যেতে পারে।
. এডুকেশন বোর্ড রিক্রুটমেন্টস অথরিটি (ইবিআরএ) গঠন : বর্তমানে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে আলাদাভাবে জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া সরকার প্রয়োজনমতো শিক্ষা ক্যাডার থেকে শিক্ষকদের প্রেষণে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে বদলি করে থাকে। কিন্তু শিক্ষা বোর্ডের নিজস্ব উদ্যোগে একবার কেউ বোর্ডে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তিনি অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত ওই একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার সুযোগ পেয়ে থাকেনফলে একদিকে ওই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে কাজ করার সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে বহু বছর একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। কেউ কেউ বেপরোয়াভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যান। এ পরিস্থিতির অবসানের লক্ষ্যে সব শিক্ষা বোর্ডে জনবল নিয়োগের জন্য শিক্ষা আইনের আওতায় একটি অভিন্ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা দরকার।
. স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ (এলইএ) গঠন : বর্তমানে আমাদের স্কুলপর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য কোনো স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ নেই। অথচ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আইনের মাধ্যমে গঠিত স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি। ইংল্যান্ডে স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ রয়েছে। সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইংল্যান্ডে শিক্ষা আইন, ১৯০২ অনুযায়ী প্রথম Local Education Authority (LEA) গঠন করা হয়। এলইএ তার অধিক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। বর্তমানে ইংল্যান্ডে ১৫২টি এবং ওয়েলসে ২২টি এলইএ রয়েছে। এসব এলইএ'র কার্যকর ভূমিকায় ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ আন্তর্জাতিকভাবে শীর্ষ গুণগত মানসম্পন্ন হয়েছে। আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য স্কুল ম্যানেজিং কমিটি (এসএমসি) প্রচলিত রয়েছে। এসএমসির দক্ষতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এ অবস্থায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ বা Local Education Authority (LEA) গঠন করা যেতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের স্বার্থেই বাংলাদেশকে এলইএ গঠনের বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
. আঞ্চলিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ (আরইএ) গঠন : এখানে প্রস্তাবিত স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠনের পাশাপাশি আঞ্চলিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ বা Regional Education Authority (REA) গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। বর্তমানে দেশে যে কয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার আঞ্চলিক অফিস রয়েছে সেগুলো ভেঙে আঞ্চলিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। অভিযোগ রয়েছে, আমাদের আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে খবরদারিমূলকভাবে অধীনস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। ফলে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের সুসম্পর্কের অভাব দেখা যায়। দেশে যতই আইন থাকুক না কেন, এভাবে শিক্ষার উন্নয়ন হতে পারে না।
শিক্ষা প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও আর্থিক বিষয়াদি ছাড়া অন্যান্য বিষয় যেমনছুটির অনুমোদন (বিদেশ গমনের অনুমতি ব্যতীত), বদলী ও উচ্চশিক্ষার বিষয়গুলো আরইএ'র হাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে একই অঞ্চলে বদলির এখতিয়ার আরইএ'র হাতে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বদলী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের হাতে এবং শুধু উচ্চতর পদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের বদলির ক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে রাখা যেতে পারে।
লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ
mujibur29@gmail.com

No comments:

Post a Comment